অদম্য ফিলিস্তিন

অদম্য ফিলিস্তিন

খেলার চমক আবু আবদুল্লাহ এপ্রিল ২০২৪

প্রতিনিয়ত ইসরাইলি বর্বরতা আর নিপীড়নের শিকার ফিলিস্তিনিরা। ৭ দশকেরও বেশি সময় ধরে দখলদার ইহুদিবাদীরা প্রতিনিয়ত গ্রাস করছে ফিলিস্তিনিদের জমি। মারছে নিরীহ ফিলিস্তিনিদের। প্রতিদিন তারা ঘুমাতে যায় পরদিন সকালে সূর্য দেখতে পাবে- না কি রাতেই কোনো ইসরাইলি মিসাইল এসে জীবন কেড়ে নেবে সেই অনিশ্চয়তা নিয়ে। তবে এত কিছুর পরেও জীবন থেমে থাকে না। যেমন থামেনি ফিলিস্তিন ফুটবল দলের যাত্রা। শত প্রতিকূলতার মাঝেও রাষ্ট্রহীন এই ফুটবল দলটি ফুটবলের মাঠে থাকছে নিয়মিত। মাঠে গোল করে তারা ফিলিস্তিনিদের ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ জীবনে কিছুটা হলেও আনন্দ নিয়ে আসার চেষ্টা করে।


যেভাবে শুরু

ফিলিস্তিন ফুটবল ফেডারেশনের যাত্রা শুরু হয়েছিল ১৯২৮ সালে। তখন অঞ্চলটি ছিল ব্রিটিশদের অধীনে। ১৯৪৮ সালে বিশাল ভূখণ্ড থেকে ফিলিস্তিনিদের উচ্ছেদ করে প্রতিষ্ঠা হয় ইসরাইল রাষ্ট্র। ওই সময় সাড়ে সাত লাখের বেশি ফিলিস্তিনিকে নিজেদের ঘর-বাড়ি থেকে উচ্ছেদ করা হয়। ফিলিস্তিন ফুটবল ফেডারেশনটি দখল করে নেয় ইসরাইলিরা। নাম দেয় ইসরাইল ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন।

এরপর ১৯৬২ সালে ফিলিস্তিনিরা আবার তাদের ফুটবল সংস্থা গড়ে তোলে। পশ্চিম তীর ও গাজা উপত্যকার ফুটবল ক্লাবগুলোকে নিয়ে কার্যক্রম শুরু করে প্যালেস্টাইন ফুটবল ফেডারেশন (পিএফএ)। নিয়মিত কার্যক্রম হিসেবে ফুটবল লিগ চালু করে সংস্থাটি। তবে ফিলিস্তিন যেহেতু স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি পায়নি, তাই তাদের ফুটবল সংস্থাকেও স্বীকৃতি দিতে গড়িমসি করে ফিফা। শেষ পর্যন্ত ১৯৯৮ সালে পিএফএকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি দেয় ফুটবলের বিশ^ সংস্থা ফিফা।

শুরুর দিকে ফিলিস্তিন ফুটবল দলকে সব ম্যাচই দেশের বাইরে খেলতে হতো। তবে ২০০৮ সালে পশ্চিম তীরের রামাল্লা শহরের কাছে আল-রাম এলাকায় ৬ হাজার দর্শক ধারণ ক্ষমতার একটি স্টেডিয়াম নির্মিত হয়। তবে রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে এরপরও তারা খুব বেশি ম্যাচ নিজেদের মাটিতে খেলতে পারেনি।


জীবন মৃত্যুর মাঝে ফুটবল

ইসরাইলি নিপীড়ন সহ্য করেও ফিলিস্তিনিরা ফুটবলকে নিয়মিত ভালোবেসে চলছে। শত ঝামেলার মাঝেও ঘরোয়া লিগ অনুষ্ঠিত হয় সেখানে। তবে সাধারণ ফিলিস্তিনিদের মতো বহু ফুটবলার ও ফুটবল সংগঠনকেও প্রাণ দিতে হয়েছে ইসরাইলি হামলায়।

সর্বশেষ গত বছর অক্টোবরে গাজা উপত্যকায় হামাসের সাথে ইসরাইলি বাহিনীর যে যুদ্ধ শুরু হয় তাতেও বহু ফুটবলারকে প্রাণ দিতে হয়েছে। যুদ্ধের শুরু থেকেই ইসরাইল নির্বিচারে নিরীহ বেসামরিক লোকদের ওপর হামলা চালিয়েছে। যুদ্ধের দুই মাসের মাথায় অন্তত ৮৫ জন ক্রীড়াবিদকে প্রাণ দিতে হয়েছে। এদের মধ্যে বেশির ভাগই ফুটবলার। পরের কয়েক মাসের যুদ্ধে এই সংখ্যা আরো বেড়েছে। জানুয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহে গাজায় ইসরাইলি বিমান হামলায় প্রাণ হারান ফিলিস্তিন অলিম্পিক ফুটবল দলের কোচ হানস আল মাজদার। ওই সময় ফিলিস্তিন ফুটবল ফেডারেশন জানায়, ইসরাইলি হামলায় এক হাজারের বেশি ক্রীড়াবিদ নিহত হওয়ার কথা। জানুয়ারি মাসে ৫৫ জন ফুটবলার নিহত হওয়ার খবর পাওয়া যায়।

এছাড়া অনেকগুলো ক্লাব, ফুটবল মাঠ, জিমনেসিয়াম বোমা ও মিসাইল হামলায় উড়িয়ে দিয়েছে ইসরাইলি বাহিনী। বেশ কয়েকটি ক্লাবকে টর্চার সেল বানিয়েছে দখরদার সেনারা।

গত বছর নভেম্বর মাসে বিবিসি জানিয়েছে, ফিলিস্তিন জাতীয় দলের মোট তিন ফুটবলার গাজায় উপত্যকায় যুদ্ধের মাঝে আটকা পড়েন। ফলে তাদের ছাড়াই বিশ^কাপ বাছাইপর্ব ও এশিয়া কাপ খেলতে হয়েছে ফিলিস্তিনকে। তিন ফুটবলারের একজন ২১ বছর বয়সি ডিফেন্ডার ইব্রাহিম আবুমেইর। অন্য দু’জন আহমেদ কুল্লাব ও খালেদ আল নাবরিস। ৩০ অক্টোবর ইব্রাহিমের পাশের বাড়িতে বড়ো ধরনের হামলা চালায় ইসরাইল। ১৭ জন নিহত হয়েছেন সেখানে। ভাগ্যক্রমে বেঁচে গেলেও ইব্রাহিমের বাড়িটিও ধ্বংস হয়েছে হামলায়। স্থানীয় রাফা স্পোর্টস ক্লাবে ইব্রাহিমের দুই টিমমেট নিহত হয়েছেন পৃথক হামলায়। ডিসেম্বরের ২০ তারিখে পশ্চিম তীরের নাবলুস শহরে এক ফুটবলারকে গুলিতে হত্যা করে ইসরাইলি বাহিনী।

ফিলিস্তিনি ফুটবলারদের ওপর অতীতেও অনেক হামলা করেছে ইসরাইলি বাহিনী। ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে ফিলিস্তিনি ছাত্রদের একটি বাসে ইসরাইলি মিসাইল হামলায় গুরুতর আহত হন তখনকার ১৯ বছর বয়সি উদীয়মান ফুটবলার হাজেম আলরেখাবি। এতটাই আহত হয়েছিলেন যে, মৃত ভেবে মর্গে রাখা হয় তাকে। অত্যন্ত আশ্চর্যজনকভাবে হাজেম সেবার বেঁচে ফিরলেও এবারের যুদ্ধ কেড়ে নিয়েছে তার ফুটবলার ভাইকে। হাজেমের ভাই মোহাম্মাদ খেলতেন শাবাদ রাফাহ ক্লাবের স্ট্রাইকার হিসেবে। ১১ই অক্টোবর বাড়িতে ইসরাইলি হামলার পর ধ্বংসস্তূপের ভেতর থেকে মোহাম্মাদের লাশ বের করা হয়।

খালিদ জাল্লালাহ নামের এক ফিলিস্তিনি ভাষ্যকার ও বিশ্লেষক বলেন, এবারের যুদ্ধে কত ফুটবলার নিহত হয়েছেন তার সঠিক হিসাব পাওয়া কঠিন। কারণ যত মানুষের মৃত্যু হয়েছে সবার তালিকা রাখা সম্ভব হয়নি।


এশিয়ান কাপে ফিলিস্তিন

শত বাধার মাঝেও অদম্য এক দল ফিলিস্তিন। যুদ্ধের মধ্যেই এবার তারা খেলেছে এএফসি এশিয়ান কাপ ফুটবলে। জানুয়ারিতে কাতারে অনুষ্ঠিত হয় এশিয়ার ফুটবলের সর্বোচ্চ এই আসর। সেখানে দারুণ ফুটবল খেলেছে দলটি। প্রথম ম্যাচে ইরানের বিরুদ্ধে হারলেও দ্বিতীয় ম্যাচে সংযুক্ত আরব আমিরাতের বিরুদ্ধে ড্র করে মুসাব আল বাত্তাতের দল। এরপর গ্রুপ পর্বের শেষ ম্যাচে হংকংকে বড়ো ব্যবধানে হারিয়ে প্রথমবারের মতো এশিয়ান কাপের দ্বিতীয় রাউন্ডে ওঠে দলটি। হংকংয়ের বিরুদ্ধে জয়ের পর অধিনায়ক বাত্তাব বলেছেন, আমাদের একমাত্র লক্ষ্য ফিলিস্তিনি দর্শকদের মুখে হাসি ফোটানো।

দ্বিতীয় রাউন্ডে তারা মুখোমুখি হয় স্বাগতিক কাতারের। সেই ম্যাচে শুরুতে গোল করেও শেষ পর্যন্ত ২-১ গোলে হেরে যায় ফিলিস্তিনিরা।

যুদ্ধের কারণে এবার গাজার ফুটবলারদের ছাড়াই এশিয়ান কাপে খেলতে হয়েছে ফিলিস্তিন দলকে। গাজায় বসবাস করেন দলটির অন্তত ৩ জন নিয়মিত সদস্য। যুদ্ধের কারণে গাজা থেকে বের হতে পারেননি তারা। তারা বেঁচে আছেন কি না সে কথাও আপাতত জানা নেই। তবুও অদম্য ফিলিস্তিনিরা এশিয়া কাপে নিজেদের সেরা সাফল্য দেখিয়েছে এবার।


আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ফিলিস্তিন

১৯৯৮ সালে ফিফার স্বীকৃতি পাওয়ার পর ওই বছরই নিজেদের প্রথম আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলে ফিলিস্তিন দল। দলটির বেশির ভাগ সদস্য স্থানীয় বাসিন্দা। আর কিছু ফুটবলার আছে প্রবাসী কিংবা উদ্বাস্তু ফুটবলার, যারা বিশে^র বিভিন্ন দেশে বসবাস করছেন। ২০১৪ সালে এএফসি চ্যালেঞ্জ কাপের শিরোপা জেতে দলটি। এশিয়ার দ্বিতীয় সারির দলগুলোকে নিয়ে এই টুর্নামেন্ট অনুষ্ঠিত হয়। এর ফলে ২০১৫ সালে প্রথম বারের মতো এশিয়ান কাপে খেলার সুযোগ পায় দলটি। এরপর ২০১৯ সালেও এশিয়ান কাপ খেলে ফিলিস্তিন। আর এ বছর তৃতীয়বারের মতো খেলতে গিয়েই ওঠে নকআউট পর্বে।

২০১৮ ও ২০২০ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত বঙ্গবন্ধু গোল্ডকাপে পরপর দুইবার শিরোপা জেতার কৃতিত্ব দেখিয়েছে ফিলিস্তিন। ১৯৯৯ সালে আরব গেমসে তৃতীয় হয় দলটি। বর্তমানে ফিফা র‌্যাঙ্কিংয়ে ফিলিস্তিনিদের অবস্থান ৯৯। ২০১৮ সালে ৭৩ নম্বরে উঠেছিল দলটি। ফিফা র‌্যাঙ্কিংয়ে বর্তমানে ভারতের অবস্থান ১০২, বাংলাদেশের ১৯১। কাজেই শত সংকট পাড়ি দিয়েও ফিলিস্তিন ফুটবল দলটি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নিজেদের পদচারণা ধরে রেখেছে সে কথা বলার অপেক্ষা রাখে না।

আপনার মন্তাব্য লিখুন
অনলাইনে কিশোরকন্ঠ অর্ডার করুন
লেখকের আরও লেখা

সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

আরও পড়ুন...

CART 0

আপনার প্রোডাক্ট সমূহ