অঙ্গীকার    -ইকবাল কবীর মোহন

অঙ্গীকার -ইকবাল কবীর মোহন

গল্প নভেম্বর ২০১৭

ইউরোপের নামকরা দেশ স্পেন। এক সময় এখানে ছিল মুসলিম শাসন। স্পেনের এক বিখ্যাত শহরের নাম কর্ডোভা। সেই শহরে বাস করতেন একজন আরবীয় শেখ। তিনি বিপুল ধন-সম্পদের মালিক ছিলেন। লোকেরা তাকে সরদার বলে মান্য করত। তার বাসভবনের সামনে ছিল সাজানো গুছানো বাগান। একদিন তিনি বাগানে আপনমনে পায়চারি করছিলেন। এমন সময় ঘটল এক অবাক কান্ড! অপরিচিত এক যুবক হন্তদন্ত হয়ে শেখের বাগানে ঢুকে পড়ল। হাঁফাতে হাঁফাতে যুবকটি শেখের দু’পা জড়িয়ে ধরে বলল,
‘আমাকে বাঁচান হুজুর! আমি মহাবিপদে পড়েছি, আমাকে বাঁচান।’
যুবকের আকস্মিক আবদারে শেখ সাহেব খানিকটা থতমত খেয়ে গেলেন। তিনি এবার যুবককে টেনে তুলে বললেন,
‘কী হয়েছে তোমার? তুমি ভয় পাচ্ছ কেন?’
প্রচন্ড ভয়ে যুবক কোনো কথাই বলতে পারছিল না। সে হাঁফাচ্ছে আর পেছনে রাস্তার দিকে বারবার তাকিয়ে কাঁপছে।
এর মধ্যেই সে কাঁপা কাঁপা গলায় বলল,
‘জনাব, আমি বিপদে পড়েছি। আপনি আমাকে রক্ষা করুন। না হয় ওরা আমাকে মেরে ফেলবে।’
শেখ যুবকের কথার কিছুই বুঝতে পারলেন না। তিনি আবারও প্রশ্ন করলেন,
‘আচ্ছা বুঝলাম তুমি বিপদে পড়েছ। তবে বলবে তো কী তোমার বিপদ। কে তোমাকে মারতে চায়- খুলে বল।’
যুবক এতক্ষণে খানিকটা স্থির হলো। সে রাস্তার দিকে বারবার তাকাল আর বলল,
‘আমি ভুল করেছি। আমার সাথে এক যুবকের ঝগড়া হয়েছে। রাগের মাথায় আমি তাকে আঘাত করেছি। আর অমনি যুবকটি মারা গেছে। ওর সঙ্গীরা আমাকে ধাওয়া করেছে। ঐ যে ওরা মনে হয় আসছে। ওরা আমাকে এখনই ধরে ফেলবে। আমাকে ওরা মেরে ফেলবে।’
এ কথা বলেই যুবকটি আবারও শেখের দু’পা জড়িয়ে ধরল।
মহানুভব শেখ আবার যুবকটিকে টেনে তুললেন। বললেন,
‘তোমার ভয় নেই। আমি ওদের সামলাব। তুমি ভয় পেও না। আমি সব দেখছি।’
এবার শেখ যুবকটিকে বাড়ির ভেতরে নিয়ে একটি গোপন কক্ষে তালাবদ্ধ করে রাখলেন।
এর পর শেখ বাইরে বেরিয়ে বাগানে এসে দাঁড়ালেন। এরই মধ্যে তিনি দেখলেন এক ভয়ানক দৃশ্য। কয়েকটা যুবক সুঠামদেহী এক যুবকের লাশ নিয়ে বাগানে ঢুকছে। এগিয়ে গিয়ে লাশ দেখেই শেখ চিৎকার করে উঠলেন। এ যে তারই স্নেহের একমাত্র পুত্রের লাশ।
উত্তেজিত যুবকরা বলল,
‘সরদার! একটা বখাটে যুবক এই হত্যাকান্ড ঘটিয়েছে। আমরা দেখলাম সে আপনারই বাগানে ঢুকেছে। আমরা তাকে ধরার চেষ্টা করলাম। কিন্তু ওকে পাচ্ছি না।’
যুবকদের কথা শুনে শেখ খানিকটা বিব্রত হয়ে গেলেন। তিনি বুঝতে পারলেন তার কাছে যে যুবক ধরা দিয়েছে সে-ই তার ছেলের ঘাতক। অথচ এখন সে তার আশ্রয়ে রয়েছে। তিনি তাদেরকে বলতেও পারছেন না যুবকের কথা। কেননা, তিনি যে যুবকটিকে রক্ষা করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। শেখের বুক ফেটে যাচ্ছে। অথচ তিনি নীরব থাকা ছাড়া আর কিছুই করতে পারলেন না।
এদিকে যুবকরা বাগানটির পুরোটা তন্ন তন্ন করে খুঁজল। কিন্তু বখাটে যুবকটিকে ধরতে পারল না। তাই তারা হতাশ হলো। তারপর লাশটি দাফনের ব্যবস্থা করে সঙ্গীরা যার যার মতো চলে গেল। কিন্তু শেখের বাড়িতে চলল শোকের মাতম। দিন গড়িয়ে রাত এলো। ধীরে ধীরে রাত গভীর হলো। বাড়ির সবাই ঘুমিয়ে পড়ল। কিন্তু শেখের চোখে ঘুম নেই। তিনি জেগে রইলেন। এক সময় সবার অগোচরে শেখ তালা খুলে ঘাতক যুবকের কক্ষে ঢুকলেন।
এতক্ষণ সবকিছু দেখছিল ও শুনছিল ওই যুবক। এতে যুবকের ভয় আরও বেড়ে গেল। শেখের ছেলেকে মেরেছে সে। আর এখন সে শেখের কাছেই ধরা পড়েছে! সে বুঝতে পারছিল, মৃত্যু ছাড়া তার ভাগ্যে আর কিছু নেই।
তবে কয়েক মিনিট পরেই যুবকের সব ভয় দূর হয়ে গেল। শেখের কথা শুনে যুবক যেন জীবন ফিরে পেল। শেখ বললেন,
‘শোন যুবক! তোমার নিরাপত্তার দায়িত্ব আমি নিয়েছি। তাই তোমার ভয় নেই। তুমি আমার মেহমান। আর আমি একজন মুসলমান। আমি আগেই তোমাকে রক্ষা করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছি। মুসলমান কোনোভাবেই তার অঙ্গীকার ভঙ্গ করে না। তুমি আমার ছেলেকে হত্যা করেছ। তবে এই নাও এই পুঁটলি। এখানে কিছু খাবার আছে। এটা ক্ষিধের সময় তোমার কাজে লাগবে। আর এই নাও ঘোড়া। এটাতে চড়ে তুমি দ্রুত এখান থেকে চলে যাও। শয়তান যে কোন সময় আমাকে খারাপ মন্ত্রণা দিতে পারে। আর শয়তানের প্ররোচনায় পড়ে আমি তোমার ওপর প্রতিশোধও নিতে পারি। তাই তুমি আমার চক্ষুর আড়ালে চলে যাও। বিলম্ব করো না। যাও, এক্ষুনি চলে যাও।’
যুবক আর কী করবে। একজন মহানুভব শেখের আচরণ ও অঙ্গীকার রক্ষার মহত্ত্ব দেখে যারপরনাই অভিভূত হলো সে। কৃতজ্ঞতায় যুবকের মন বিগলিত হলো। কিন্তু শেখের সীমাহীন শোকে সান্ত¡না দেয়ার ভাষা তার ছিল না। তাই সে শেখকে সালাম জানিয়ে ঘোড়ায় চেপে বসল। তারপর ঘোড়া দ্রুত হাঁকিয়ে যুবক তার গন্তব্যের পথে ছুটে চলল।
                        
আপনার মন্তাব্য লিখুন
অনলাইনে কিশোরকন্ঠ অর্ডার করুন
লেখকের আরও লেখা

সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

আরও পড়ুন...

CART 0

আপনার প্রোডাক্ট সমূহ