
স্বপ্নের সাইকেল, দুঃস্বপ্নের চোর! -মাহিন মুবাশশির
উপন্যাস ফেব্রুয়ারি ২০১৬
সাইকেলের বেলটা নিয়ে বেশ সমস্যা হচ্ছে। হঠাৎ করেই নষ্ট হয়ে গেলো। সামনে একটা বিশাল জ্যাম। এই জ্যামের মধ্যে বেল ছাড়া কিভাবে রাস্তা পার হবো ভেবে পাচ্ছি না। তা ছাড়া বেল বাজিয়েই বা লাভ কী? এভাবে বেল বাজিয়ে লোকজনকে সরিয়ে দেয়া খুবই লজ্জাকর। খুবই বিবেকহীন কাজ। কারো উপকার করার চিন্তা তো নেই-ই। এখন দেখছি নিজের সুবিধার জন্য অন্য লোকদেরকে তাচ্ছিল্য করা হবে। ইস্ কী অসহ্য! এ যে রীতিমতো অভ্রতা। প্রতিদিন এভাবে সবাইকে বিরক্ত করার বদলে একদিন সাইকেল চালানোই বন্ধ করে দিয়েছিলাম। কিন্তু এ নিয়ম বেশি দিন টিকিয়ে রাখতে পারিনি। কেননা, বাসা থেকে স্কুল অনেক দূরে। হেঁটে যেতে অনেক কষ্ট হয়। তা ছাড়া হেঁটে গেলে কোনো কোনো দিন ক্লাস ধরাই মুশকিল হয়ে পড়ে। তাই আমি নিজে সাইকেল চালাতে না চাইলেও সাইকেলই আমাকে বাধ্য করেছে একে চালাতে। আজ একেবারেই সমস্যায় পড়ে গেলাম। হয়তো স্কুলে যাওয়াই মিস হয়ে যাবে। ঠিক তাই। স্কুলে আর যাওয়া হলো না। রাগে-দুঃখে শরীর কসমস করতে লাগলো। কিছু না বুঝে বাসায় চলে এলাম। শান্ত হওয়ার জন্য একটু ঘুমুতে চেষ্টা করলাম। কিন্তু ঘুমতো এলোই না, বরং নানা টেনশন তীরের মতো এসে আমার মাথাকে অবশ করে দিতে চাইলো। কিছুতেই মাথা থেকে দূর করতে পারলাম না। মনে হতে লাগলো “ইস্ সাইকেল যদি না থাকতো, তাহলে কত্তো ভালো হতো! সবাই হেঁটে যেতো আর স্কুলও দেরিতে আরম্ভ হতো। চলার পথে কাউকে বিরক্ত হতে হতো না।.....” এ রকম নানা চিন্তা-ভাবনায় কিছুতেই কিছু করতে পারলাম না। না পারলাম ভালো চিন্তা মাথায় আনতে, না পারলাম কোনো সমাধান বের করতে। তবুও এক নাগাড়ে সমাধানের চিন্তা করতে লাগলাম। ভাবলাম, এ ঝামেলা থেকে মুক্তির একটা অভিনব উপায় আবিষ্কার করতে হবে। যেই না আবিষ্কারের কথা মাথায় এলো ওমনি মনে হলো জামি সায়েন্টিসের কথা। পুরোনাম ড. জামিউল হক জামি। তার নেশা ও পেশা জ্ঞানের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে গবেষণা করে প্রবন্ধ লেখা। সেই সাথে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির খন্ডকালীন লেকচারার হিসেবেও তার যথেষ্ট সুনাম রয়েছে। সবচেয়ে বড় কথা হলো তিনি একজন স্বভাববিজ্ঞানী। ছোটবেলা থেকে এটা-সেটা দিয়ে খেলনা তৈরি, বিজ্ঞানের নানা রকম প্রজেক্ট তৈরি ছাড়াও বিজ্ঞানের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে মাতামাতি করতেন। তাই টুকিটাকি প্রযুক্তিগত নতুন জিনিস উদ্ভাবন করা তার কাছে এক তুড়ির খেলা মাত্র। এইতো সেদিন তিনি আমার একটা জটিল সমস্যার কতো সুন্দর আর সহজ সমাধানটাই না দিলেন। আমার প্রতিদিন মাথা ধরে বলে তার কাছে গিয়েছিলাম পরামর্শ নিতে। আহ! বেচারা এতো চমৎকার আর সহজ একটা বিষয় শিখিয়ে দিলেন, পরীক্ষা না করে দেখলে সত্যি অবিশ্বাস্য মনে হতো । তিনি বললেন- “তোমার যখন মাথা ধরবে বা কোনো কারণে মন খারাপ থাকবে কিংবা কোনো কাজ ভালো লাগবে না, মন অস্থির অস্থির লাগবে, পড়ালেখায় মনোযোগ আসবে না বা পড়তে ইচ্ছে করবে না, তখন দেরি না করে তৎক্ষণাৎ ঘুমিয়ে পড়বে। দেখবে ঘুম থেকে ওঠার পর তোমার সব কিছু ভালো লাগছে।” কী তাজ্জব ব্যাপার! যে কথা সেই কাজ। আমার একদিন প্রচন্ড মাথা ব্যথা হলো, ঘুমিয়ে পড়লাম। অন্য একদিন মন খারাপ হলেও ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। ঘুম থেকে উঠে দেখি সব ঠিক হয়ে গেছে। ঘুমের মাঝে মাথা ব্যথা আর অভিমান কোথায় যে পালিয়ে গেলো টেরই পেলাম না। বিকেলেই রিকশাযোগে রওনা দিলাম জামি সায়েন্টিসের বাড়িতে। গিয়ে দেখি তিনি একটা মাছ নিয়ে গবেষণা করছেন। তাই প্রথমে আমাকে দেখে একটু ইতস্ততবোধ করলেন। পরে অবশ্য বললেন- “তুমি এসেছো ভালোই হলো। গল্প করা যাবে। এখন একটু ড্রইং রুমে গিয়ে বোস। আমি আসছি।” আমি ড্রইং রুমে খানিকক্ষণ বসে থাকার পর তিনি এলেন। মৃদু হেসে বললেন- “তো কী খবর? কোনো সমস্যা-টমস্যা হয়েছে নাকি?” আমি একটু কেশে নিয়ে বললাম- “আর বলবেন না, আমার সাইকেলের বেলটা নিয়ে বেশ ঝামেলায় আছি।” জামি আঙ্কেল আগ্রহের সুরে আমার চোখে চোখ রেখে বললেন- “কেন কেন কী হয়েছে?” আমি জোর গলায় বলতে লাগলাম- “এই যে সাইকেল চালানোর সময় আমরা অযথা বেল বাজিয়ে আলাভোলা পথচারীদের পূর্বাভাস দিয়ে বোঝাচ্ছি- “তাড়াতাড়ি কেটে পড়েন, নইলে খবর আছে! এটা কি ঠিক হচ্ছে?” “আচ্ছা! আচ্ছা!” জামি আঙ্কেল মজা পাচ্ছেন। “ক্রিং-ক্রিং-ক্রিং- কী একটা অভদ্র শব্দ!” জামি আঙ্কেল আমার কথা মন দিয়ে শুনলেন। তারপর অনেকক্ষণ নীরব হয়ে কিছু একটা ভাবছিলেন। হঠাৎ যেন লাফিয়ে উঠলেন। আনন্দে আত্মহারা হয়ে বললেন- “পেয়েছি! পেয়েছি!” “কী পেয়েছেন?” “সমাধান!” “কিসের?” “তোমার বেলের।” “আমার বেলের!” “সরি-সরি তোমার নয়, তোমার সাইকেলের বেলের।” “কী?” “সাইকেল কথা বলবে!” “মানে!” “আহ! সহজ কাথাটাই বুঝতে পারছো না?” “না, খুলে বলুন।” “খোলা-খুলির কিছু নেই। অপেক্ষা করো একাই বুঝে যাবে।” বলে তিনি বিষয়টা আমাকে বোঝানোর চেষ্টা করলেন। আমি কিছু না বুঝেই বোঝার ভান করে বললাম- “কিভাবে সম্ভব?” “মোটেই অসম্ভব নয়। একটুখানি ধৈর্য ধরো আর দেখো কী করি।” জামি আঙ্কেলের সাথে কথা বলতে বলতে কখন যে বিকেল গড়িয়ে রাত হয়েছে টেরই পাইনি। তাই আরো কিছুক্ষণ থাকার ইচ্ছে থাকলেও থাকতে পারলাম না। তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে এলাম। পরের দিন। ফজরের আজান দেয়ার সাথে সাথে ঘুম থেকে জেগে উঠলাম। উঠে মুখ-হাত ধুয়ে, নামাজ-কালাম পড়ে তড়িঘড়ি কিছুটা খেয়ে নিলাম। ঘড়িতে সকাল সাতটা বাজতেই রওনা হলাম জামি আঙ্কেলের বাড়ির উদ্দেশে। গিয়ে তাকে পেলাম তার ল্যাবরেটরি ঘরে। দেখলাম তিনি গবেষণায় মগ্ন। আমি আস্তে করে একবার ডাকলাম- “আঙ্কেল!” তিনি শুনতে পেলেন না। এরপর একটু জোরে ডাকলাম। তাও তিনি শুনতে পেলেন না। এবার চেঁচিয়ে উঠলাম- আঙ্কেল চমকে গিয়ে বললেন- “কে- কে- কে!” আমি বললাম- “আঙ্কেল আমি!” “অঃ, তুমি! তা কখন এলে? ভয়’ই পেয়ে ছিলাম!” “সরি আঙ্কেল! আমি অনেকক্ষণ ধরে আপনাকে ডাকছি। আপনি শুনছিলেন না তাই...” “ঠিক আছে। যাও ড্রইং রুমে গিয়ে টিভি দেখ। আমার আসতে দেরি হবে।” “আচ্ছা।” বলে আমি ড্রইং রুমের দিকে পা বাড়িয়েছি। ওমনি তিনি আমাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন- “শোনো, শোনো!” “বলেন।” “তোমার সাইকেলটা কি নিয়ে এসেছো?” “না আঙ্কেল।” “বলো কী? ওটাই তো এখন লাগবে! গতকাল রাত তিনটা পর্যন্ত তোমার সাইকেল সমস্যা সমাধানের একটা পদ্ধতি আবিষ্কার করেছি। কাথাটা শুনে উত্তেজনায় আমি আত্মহারা হয়ে বললাম- “কী সেটা? বলা যাবে কি?” “অবশ্যই যাবে, তবে তোমার সাইকেলটা যে লাগবে!” “আচ্ছা, তাহলে সাইকেল আনতে আমি এখনই বাড়ি যাচ্ছি।” “কতক্ষণ লাগবে?” “এই যাবো, আর সাইকেলটা নিয়ে আসবো।” “হ্যাঁ, হ্যাঁ তাই যাও।” আমি বাড়ি যাবার জন্য জামি আঙ্কেলের বাসা ছেড়ে রাস্তায় এসে রিকশার জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম। কিন্তু কোনো রিকশা পেলাম না। এদিকে আমার এক মুহূর্তও দেরি সহ্য হচ্ছিলো না। তাই সেখানে আর দাঁড়িয়ে না থেকে এক দৌড়ে বাড়ি চলে এলাম। সাইকেলটা সাথে করে জোরে জোরে প্যাডেল করে আবার রাস্তায় এসে জামি সায়েন্টিসের বাড়ির দিকে রওনা দিলাম। এতো জোরে চালাচ্ছিলাম যে সম্মুখ থেকে ছুটে আসা একটা বাইকের সাথে ধাক্কা লেগে এক ঝটকায় পড়ে গেলাম পিচঢালা রাস্তায়। ফলে হাঁটু আর ডান হাতের কনুইয়ে চোট লেগে জ্বালা করতে লাগলো। সঙ্গে সঙ্গে খানিকটা রক্তও বের হলো। কিন্তু এসব উপেক্ষা করে আমি সাইকেলটা রাস্তা থেকে তুলে পুনর্বার রওনা হলাম জামি সাহেবের বাড়ি অভিমুখে। জামি আঙ্কেল আমার এ দশা দেখে রীতিমতো ভরকে গেলেন। বললেন- “কাব! তোমার একি অবস্থা! কিভাবে হলো?” আমি অ্যাকসিডেন্টের ঘটনা তাকে খুলে বললাম। তিনি জিব দিয়ে চুক চুক শব্দ করে বললেন- “ইস, কী ব্যথাটাই না পেয়েছো! দাঁড়াও ড্রেসিন করে ব্যান্ডেস বেঁধে দিচ্ছি।” বলে তিনি ল্যাবরেটরি ঘর থেকে কিছু তুলো আর স্যাবলন এনে আমার ট্রিটমেন্ট করতে লাগলেন। তার এমন আনকোরা ট্রিটমেন্ট দেখে মনে হলো : তিনি পূর্বে ডাক্তারি করেছেন। ইচ্ছে হলো তাকে এ ব্যাপারটি নিয়ে জিজ্ঞেস করি। করেও ফেললাম- “আঙ্কেল!” “বলো কাব।” “আপনি কি ডাক্তার?” “না-না! তবে গবেষণার প্রয়োজনে এক বছরের মেডিক্যাল প্রশিক্ষণ নিয়েছিলাম। তাই এই একটু-আধটু আরকি-!” আমি একগাল হেসে বললাম- “ভালো-ভালো, খুব ভালো!” আমার এমন প্রশংসাসূচক বাক্য শুনে তিনি আপত্তি তুলে বললেন- “কী ভালো?” আমি অনায়াসে বলে দিলাম- “এইযে আপনি একাধারে একজন বিজ্ঞানী, সুলেখক। সেই সাথে একজন চিকিৎসকও। যাকে এক কথায় বলে সবজান্তা। বাহ, বাহ!” তিনি জোর আপত্তি তুলে বললেন- “না- কাব, এভাবে বলো না! আসলে সবজান্তা বলে কোনো কথা নেই। আমরা মানুষ। আমাদের জ্ঞান খুবই সীমিত। এইযে বিশ্ব ব্রহ্মান্ড দেখছো; এর যিনি স্রষ্টা তিনিই কেবল সবজান্তা। তিনি আলিমুল গায়েব। আমাদের খালিক- মালিক। তিনিই আমাদের জ্ঞান দিয়েছেন। তবে আমরা খুব মূর্খ। আসল জ্ঞানী তো তিনিই। তাই এসো আমরা নিজেদের প্রশংসা না করে তাঁরই প্রশংসা করি। বলি- “আলহামদুলিল্লাহ!” আমিও বললাম- “আলহামদুলিল্লাহ!” অনেক কথা হলো। অতঃপর এলাম আমাদের মূল আলোচনায়। যে বিষয়টি নিয়ে আজকে এতো কান্ড ঘটে গেলো ইতোমধ্যে সেই সাইকেলের বেলের বিকল্প আবিষ্কার করে ফেলেছেন জামি সায়েন্টিস। সহসা তিনি আমাকে চমকে দিয়ে বললেন- “কাব!” আমি থতমতো খেয়ে বললাম- “জি-জি!” “আমার হাতে এটা কী দেখতে পাচ্ছো?” আমি তার হাতে একটি সুইচ, কয়েক গজ ক্যাবল আর মাইক্রোফোন অথবা মাউথপিসের মতো একটি ইলেকট্রনিক যন্ত্র দেখতে পেলাম। আমি নির্বিঘ্নে বলে দিলাম- “এই তো একটা সুইচ, কিছু তার, সেই সাথে মাইক্রোফোন বা মাউথপিস জাতীয় একটা যন্ত্র।” “সাবাস!” “কিন্তু এগুলো তো পরিচিত জিনিস। এসব দিয়ে কী হবে?” “হবে- হবে- হতেই হবে!” “মানে?” “মানে সরল। পানির মতো তরল।” “বুঝলাম না।” “বুঝলে না?” “না!” “এগুলো দিয়েই তোমার সাইকেলকে কথা বলাবো।” “কী বলছেন!” “ঠিকই বলছি!” “না- না!” “কেন নয়? অবশ্যই!” “কিভাবে?” “এক পলক অপেক্ষা করো। এক্ষুনি দেখাচ্ছি।” বলে তিনি ল্যাবরেটরি ঘর থেকে একটি খুদে ক্যাসেট আর একটি ছোট টেপরেকর্ডার নিয়ে এলেন। তারপর তিনি কাজ শুরু করলেন। প্রথমে ক্যাসেটটি টেপরেকর্ডারে ভরলেন। অতঃপর আমার সাইকেলটি ভেতরে আনতে বললেন। আমি সাইকেলটি বাহির থেকে ভেতরে আনলাম। সাইকেল আনা হলে তিনি সাইকেলের হ্যান্ডেলের সাথে সুইচ শক্তমতো লাগালেন। এরপর ক্যাবল পেঁচালেন। মাইক্রোফোনটি লাগালেন সামনের দিকে। সুইচের পাশাপাশি ক্যাসেটসহ টেপরেকর্ডার লাগালেন ঠিকঠাক। স্ক্রু-ড্রাইভ দিয়ে টেপরেকর্ডার আর সুইচের সাথে সংযোগ দিলেন। একটু পর সুইচ আর মাইক্রোফেনের সংযোগ পরীক্ষা করে দেখলেন। সবকিছু জুতসই লাগানো হলে জামি সায়েন্টিস আমাকে ডাকলেন- “কাব, এবার এসো। সুইচটা চাপ দাও।” আমি একবুক উৎসাহ নিয়ে সুইচে চাপ দিলাম। আর দিতেই যা হলো তা নিজ কানে শুনে বিশ্বাস করতে পারলাম না। আমি সুইচে হাত লাগাতেই মাইক্রোফোন থেকে ভেসে এলো একটি কণ্ঠস্বর। যেটা বললো- Please, আমাকে side দিন!” আমি উদ্দীপিত কন্ঠে জিজ্ঞেস করলাম- “কিভাবে সম্ভব হলো?” জামি আঙ্কেল হাসতে হাসতে বললেন- “বললাম না- সম্ভব! সম্ভব মনে করলেই সম্ভব।” “তবু?” “কিছুই না। তুমি তো সবই দেখলে।very simple ব্যাপার। এগুলো সবই খুব পরিচিত যন্ত্রপাতি। সবকিছুই হাতের নাগালেই পাওয়া যায়। চাই একট-আধটু গবেষণা। অর্থাৎ সামান্য বুদ্ধি খাটানো।” “তাই?” “হ্যাঁ, তাই। আসলে আমাদের সবার মাঝেই কমবেশি প্রতিভা আছে। একটু চিন্তা-ভাবনা করলে আমরা তা কাজে লাগিয়ে দেশ ও জাতির কল্যাণ করতে পারি।” “পারি বৈকি! অবশ্যই পারি!” উচ্ছ্বসিত হয়ে বলতে বলতে আমি একটা ডিগবাজি দিলাম। দুুই. বেশ কিছু দিন হলো জামি সায়েন্টিসের বাড়িতে আর যাওয়া হয় না। এর পেছনে অবশ্য একটি কারণ আছে। সেদিন সাইকেল কথা বলার পর থেকে আমি তো রীতিমতো সবার আকর্ষণের কেন্দ্র হয়ে গেছি। সবাই কেবল আমার কথা বলা সাইকেল দেখে অবাক হয়ে যায়। অনেকে বলাবলি করে- ‘যন্ত্র কথা বলতে পারে? তাও আবার সাইকেল! তাজ্জব ব্যাপার!’ কেউ কেউ আবার বিদ্রুপ করে বলে- “ফুটানি! পিপীলিকার পাখা গজাইছে। উড়তে চায়!” কথাগুলো শুনে অল্প একটু কষ্ট লাগলেও আমি কিছু মনে করি না। অন্য দিকে যারা আমার সাকেলটির প্রশংসা করে শুনতে ভালোই লাগে। আমি তাদেরও কিছু বলি না। তবে স্কুলে আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু জয়কে সবকিছু কিছু খুলে বলেছি। জয় অবশ্য ওর ডাক নাম। আসল নাম জাহিদুল। পুরো নাম জাহিদুল জয়। ও ওর নামের মতো অন্যকেও যেন জয় করে ফেলে। সে জন্যই বুঝি ও আমার মন জয় করে সবকিছু জেনে নিয়েছে। তাতে অবশ্য আমার ভালোই হয়েছে। জয় আমার বন্ধু হওয়াতে স্কুলের সবাই আমার বন্ধু হয়ে গেছে। এর পুরো অবদানটা আলবাত জামি সায়েন্টিসের। তিনি সাইকেলে এমন প্রযুক্তি লাগিয়ে না দিলে হয়তো আমার এ সুদিন আসতো না। কেননা, বরাবরই আমি ছিলাম সবার উপেক্ষার পাত্র। এতোদিন কেউ আমাকে পাত্তা দিতো না। কী জানি আমি গরিব পোস্ট মাস্টারের ছেলে বলে ওরা আমার সাথে দুর্ব্যবহার করতো। যাই হোক চলতি দিনগুলো আমার পরমানন্দে কেটে যাচ্ছে। তিন. আমাদের স্কুলের নাম- বেতিল বহুমুখী উচ্চবিদ্যালয়। এ স্কুলে আমি সপ্তম শ্রেণীতে পড়ি। আজ স্কুলে বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা। প্রতিযোগিতা উপলক্ষে নানারকম খেলার আয়োজন করেছে স্কুল কর্তৃপক্ষ। এসব খেলার মাঝে অন্যান্য বছরের মতো এ বছরও আছে- ক্রিকেট, ফুটবল, ভলিবল, ১০০ মিটার দৌড়, বস্তা দৌড়, বিস্কুট দৌড়, লৌহ বল নিক্ষেপ, জাম্প ইত্যাদি খেলা। তবে এ বছর নতুন একটা খেলা যোগ হয়েছে। সেটা হলোÑ সাইকেল রেইস। সব খেলার মধ্যে এই খেলাটা আমার মনে ধরেছিলো। তাই আমি বিনা বাক্যব্যয়ে কেবল এই খেলাটিতে নাম দিয়েছিলাম। আজ এই সাইকেল রেসে আমি অংশ নিতে যাচ্ছি। আর কিছুক্ষণ পর প্রতিযোগিতা শুরু হবে। সে জন্য আমার বুকের ভেতরটা কেমন যেন ধুকপুক করছে। কারণ আমি এর আগে কখনো সাইকেল রেসে অংশ নেইনি। তা ছাড়া সাইকেল চালাতে আমি ততটা পটুও নই। তাই বোধ হয় নানা রকম ভয় এসে আমাকে অবশ করে দিতে চাইছে। কিন্তু আমাকে যে ভয় পেলে চলবে না। তাই সাহস করে সাইকেলে চেপে বসলাম। ক্রীড়া শিক্ষক বাঁশি ফুঁ দিলেন। আমি অন্যান্য প্রতিযোগীদের সাথে সাইকেল চালাতে শুরু করলাম। আমার সাথে আরো পাঁচজন প্রতিযোগিতা করছে। সবাই আমাকে ছাড়িয়ে গেছে। আমি সবার পেছনে পড়ে গেছি। নাহ! কিছুতেই ওদের অতিক্রম করতে পারছি না। তবুও প্রাণপণ চেষ্টা করছি। আমার কপাল বেয়ে দর দর করে ঘাম ঝরছে। আমি হাঁফাতে শুরু করেছি। কিন্তু কিছুতেই ওদেরকে পেছনে ফেলতে পারছি না। হায়! আজ আমার মান-সম্মান কিছুই রইলো না। হঠাৎ কী মনে হলো, আমি সাইকেলের সুইচে চাপ দিলাম। অমনি সাইকেল তার সদ্য প্রযুক্ত যন্ত্র দিয়ে কথা বলতে শুরু করলোÑ “চষবধংব, আমাকে ংরফব দিন!”...... ভাগ্যিস! এর আগে আমি সাইকেলটি স্কুলে আনিনি। তাই এ স্কুলের কেউই আমার কথা বলা সাইকেলের ব্যাপারে জানতো না। কেবল আমার বন্ধু জয় আর আমার পাড়ার দু-একজন ছেলে এ ব্যাপারটি জেনেছিলো। এ জন্য আমার সাথে অংশ নেয়া অন্যান্য প্রতিযোগী সবাই অবাক হয়ে হোক আর ভয় পেয়ে হোক সাইকেলের গতি থামিয়ে পেছনে তাকাতেই আমি ওদের পেছনে ফেলে ফার্স্ট হলাম। হর্ষধ্বনি আর করতালিতে মুখর হয়ে উঠলো মাঠের চারপাশ। আমি লক্ষ্য করলাম দর্শকমন্ডলী হাঁ করে আমার সাইকেলের দিকে তাকিয়ে আছেন। আমার আর বুঝতে বাকি রইলো না যে, দর্শকদের আনন্দ-উৎসাহের আকর্ষণ আমি নই, আমার কথা বলা সাইকেল। বিষয়টা উপলব্ধি করতেই আমার লজ্জা করতে লাগলো। যাহোক একটু পরেই অন্যান্য প্রতিযোগিতা শেষ হলো। সব শেষে এলো ফলাফল ঘোষণার পালা। বিভিন্ন প্রতিযোগিতার প্রতিযোগীরা তাদের পারফরম্যান্স অনুযায়ী ফার্স্ট, সেকেন্ড, থার্ড হলো। এবার বরাবরের মতো চ্যাম্পিয়ন অব দ্য ইয়ার ঘোষণার পালা এলো। অথচ এখনো কাউকে ঘোষণা করা হয়নি। আশ্চর্য আমাকেও ফার্স্ট, সেকেন্ড, থার্ড কোনো কিছুই ঘোষণা করা হয়নি। ফলে আমি চিন্তিত হয়ে পড়লাম। নিমিষে মনটা আমার খারাপ হয়ে গেলো। কিন্তু পলকে আমাদের ক্রীড়া অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি সাংবাদিক ডা. সেলিম রেজা মাইক দিয়ে ঘোষণা করলেন- “এ বছরে সাইকেল প্রতিযোগিতায় চমক দেখানোর জন্য এবং প্রতিযোগিতায় ফার্স্ট হওয়ার জন্য সপ্তম শ্রেণীর ছাত্র ‘কাব কাতাদাহকে’ চ্যাম্পিয়ন অব দ্য ইয়ার ঘোষণা করছি।” আমি ঘোষণা শোনা মাত্র আবেগাপ্লুত হয়ে পড়লাম। আমি মনে মনে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করলাম- “আলহামদুলিল্লাহ!” সাথে সাথে আমার চোখ দিয়ে দু’ফোঁটা আনন্দাশ্রু গড়িয়ে পড়লো। আমি জীবনে অনেক কেঁদেছি। কিন্তু আজকের কান্না সম্পূর্ণ ভিন্ন রকমের, ভিন্ন স্বাদের। চোখ মুছে আমি প্রধান অতিথির হাত থেকে চ্যাম্পিয়ন ট্রফিটি বুকে তুলে নিলাম। সাথে সাথে সাংবাদিকরা আমার ছবি তুলতে লাগলেন। তাদের মাঝ থেকে আমার পূর্বপরিচিত সাংবাদিক রফিক মোল্লা আমার কথা বলা সাইকেল সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করলেন। ইতোমধ্যে মাইক দিয়েও ঘোষণা করে আমাকে কিছু বলার জন্য আহ্বান করা হলো। তাই আমি সাংবাদিক রফিক মোল্লা সাহেবের জিজ্ঞাসাবাদের কোনো উত্তর দেবার সময় পেলাম না। তবে আমি সকল সাংবাদিক, অতিথিবৃন্দ, ছাত্রছাত্রী এবং সাধারণ দর্শকদের অবগতির জন্য আমার কথা বলা সাইকেল ও জামি সায়েন্টিসের কথা বলতে লাগলাম। লক্ষ্য করলাম সবাই আমার কথা খুব মনোযোগ দিয়ে শুনছেন। কিছুটা অবাক হচ্ছেন। সাংবাদিকরা নোট করছেন। রফিক মোল্লা বড় বড় করে আমার দিকে তাকাচ্ছেন। আমি বুঝতে পারছি সবাই জামি সায়েন্টিস সম্পর্কে কৌতূহলী হচ্ছেন। দর্শকসারিতে উপস্থিত টুপি-দাড়িওয়ালা হুজুররা জামি সায়েন্টিসের জন্য দোয়া করছেন। আমি মনে মনে তাদের সাথে শরিক হয়ে দোয়া করতে লাগলাম। মনে মনে বললাম, তিনি যেন আরো নব নব আবিষ্কার দিয়ে দেশ ও জাতির কল্যাণ সাধন করতে পারেন। আমি বুঝতে পারলাম না কতকগুলো কাজ আমি একসাথে করে ফেললাম। একেতো আমি মঞ্চে উঠে মাইকে জামি সায়েন্টিসের আবিষ্কারের কাহিনী বলে যাচ্ছি, আবার দর্শক সাড়া কেমন তা উপলব্ধি করছি। সেই সাথে জামি সায়েন্টিসের জন্য হুজুরদের সাথে দোয়া করছি। আমি যেন নিজের মাঝে এক নতুন আমিকে খুঁজে পেলাম।... অতঃপর আমার বক্তব্য শেষে অন্যান্য প্রতিযোগীদের পুরস্কার বিতরণ শেষ হলে অনুষ্ঠানের সভাপতি বিশিষ্ট সমাজসেবক আরিফুল ইসলাম সোহেল সবাইকে ধন্যবাদ জানিয়ে ক্রীড়া অনুষ্ঠানের সমাপ্তি ঘোষণা করলেন। সেই সাথে স্কুলের প্রধান শিক্ষক এম এ মুমিন সিরাজী আগামী এক মাসের জন্য স্কুলের গ্রীষ্মকালীন ছুটি ঘোষণা করলেন। ছুটির কথা শুনে আমার আনন্দ যেন আরো বেড়ে গেলো। আমি আনন্দে বিগলিত হয়ে মনে মনে বললাম, ‘স্কুল ৩০ দিন বন্ধ থাকবে! যাক এবার পুরো এক মাস নানাবাড়ি গিয়ে মজা করবো। র্হুরে!’ চার. স্কুল ছুটির পর আমি নানাবাড়ি বেড়াতে এসেছি। আমার মামাতো ভাই সিয়ামের সাথে বেশ মজায় মজায় দিনগুলো কাটিয়ে দিচ্ছি। দু’জনে সারাদিন টো-টো করে ঘুরে বেড়াচ্ছি। গাছে চড়ে পেয়ারা, আম, লিচু পেড়ে পেড়ে খাচ্ছি। আমার নানাবাড়ির বাগান হওয়ায় কেউ আমাদের কিছু বলছে না। নানাবাড়ির পেছন দিয়ে কুলু কুলু কলরোলে বয়ে যাচ্ছে যমুনা নদী। আমি ও সিয়াম সে নদীতে প্রতিদিন গোসল করি। আজও আমরা গোসল করতে এসেছি। অন্যান্য দিনের চেয়ে আজকে আমরা একটু বেশি সময় নিয়ে গোসল করছি। কারণ আজ আমরা নদীতীরে বালু দিয়ে নানা রকম ঘরবাড়ি বানাচ্ছি। আবার পায়ের ওপর বালু মেখে স্বযতেœ পা-টা বের করে আনছি। ফলে পাখির বাসার মতো নীড় তৈরি হচ্ছে। তাকে আমরা পাখির বাসা বলে মিছা-মিছি পাখি পাখি খেলছি। মনে মনে ভাবছি- এখানে সত্যি সত্যি পাখি এসে থাকবে। তারপর তারা ডিম পাড়বে। ডিমে তা দেবে। ডিম থেকে বাচ্ছা ফুটবে। আর সে বাচ্ছা নিয়ে আমরা ফুড়ুত ফুড়–ত খেলবো। কিন্তু চোখের পলকে নদীর বড় বড় ঢেউ এসে আমাদের তৈরি করা পাখির বাসা, কৃত্রিম ঘরবাড়ি, দালান-কোঠা বারবার ভেঙে দিয়ে যাচ্ছে। তবুও আমরা একটার পর একটা বানিয়েই চলেছি। এগুলো করে আমরা বেশ মজা পাচ্ছি। বালু দিয়ে নকল ঘর-বাড়ি তৈরি করে আমরা যেন আমাদের আগত দিনের স্বপ্ন বুনে চলেছি। তাই আমি ঘর বানাতে বানাতে সিয়ামকে জিজ্ঞেস করলাম- “সিয়াম তুই বড় হয়ে কি হতে চাস রে?” সিয়াম জবাব দিলো- “তেমন কিছু ভাবিনি। তবে আমার জেলে হতে খুব ইচ্ছে করে।” “বলিস কী! কেন?” “জেলেরা সবসময় পানিতে থাকে। পানিতে থেকে হরেক রকম মাছ ধরে। আমারও পানিতে থাকতে ভাললাগে। পানিতে নেমে সারাদিন মাছ ধরতে ইচ্ছে করে।” “তাই নাকি! তবে লেখাপড়া শিখে কী করবি? লেখাপড়া শিখে কী কেউ জেলে হয়?” “না-না ঠিক তা নয়। আসলে আমি হতে চাই জেলেদের মতো স্বাধীনচেতা। জেলেদের মতো স্বাধীনভাবে নদীর স্রোতে ভেসে ভেসে নদীর সাথে বন্ধুত্ব করতে চাই। মাছের সাথে কথা বলতে চাই।” “ও আচ্ছা!” “কিন্তু তুই তো বল তুই কী হতে চাস?” “আমি? আমি হতে চাই ইঞ্জিনিয়ার। সাইকেল ইঞ্জিনিয়ার।” “কী বললি? ইঞ্জিনিয়ার? তাও আবার সাইকেল ইঞ্জিনিয়ার! হাসালি..... হাঃ হাঃ হাঃ! “এতে আবার হাসির কী হলো? সাইকেল ইঞ্জিনিয়ার কি খারাপ?” “না খারাপ না। কোনো কাজই ছোট নয়। কিন্তু এগুলো তো মেকারি কাজ।” “আরে না মেকারি না, তুই আসল ব্যাপারটা বুঝতে পারছিস না। তাই এমন ভাবছিস।” “ঠিক আছে, তুই বল আসল ব্যাপারখানা কী?” “এই ধর-আমি যা বলতে চাইছি তা হলো- আমি সাইকেলকে আরো আধুনিক করতে চাই।” “যেমন......?” “যেমন ধর- সাইকেল নিজে কথা বলবে। যে রকম আমারটা বলে.....” “বলিস কী! সত্যি?” সিয়াম অবাক হলো। আমিও সিয়ামের অবাক বনে যাওয়া দেখে প্রসঙ্গ পাল্টে ফেলে আমার সাইকেলের প্রসঙ্গ টেনে বলতে থাকলাম- “হ্যাঁ, সত্যি বলে। শুধু তাই নয়, আমি কিছু দিন ধরে ভাবছি সাইকেল নিয়ে যদি আকাশে উড়া যেত তাহলে খুব মজা হতো!” “তাজ্জব ব্যাপার?” “তাজ্জবের দেখছিস কী? কেবল শুরু!” “শুরু?” “হ্যাঁ বাছা, কেবল শুরু। চল আজকেই আমাদের বাড়ি যাই। আমার কথা বলা সাইকেলটা দেখে আসবি।” বলে তৎক্ষণাৎ আমরা নদীতে ঝুপঝাপ গোসল সেরে দ্রুত নানা বাড়ি ফিরলাম। তারপর ঝটপট দুপুরের খাওয়াটা সেরে মামা-মামীকে বলে সিয়ামকে সাথে নিয়ে ট্রেন যোগে আমাদের বাড়ির উদ্দেশে রওনা হলাম। (আগামী সংখ্যায় সমাপ্য)
আরও পড়ুন...