
শক্তিমান অ্যারন শেফার্ড -অনুবাদ : হোসেন মাহমুদ
অনুবাদ গল্প মার্চ ২০১৬
সে ছিল খুব শক্তিশালী। গ্রামে তার মতো শক্তিশালী লোক আর কেউ ছিল না। জঙ্গলে জ্বালানি কাঠ সংগ্রহ করতে গেলে অন্য একজন যা আনত সে আনত তার দ্বিগুণ। আবার শিকারে গেলে অন্যরা যখন একটি হরিণ মেরে আনত, সে আনত দু’টি। তার নাম ছিল শাদুসা। বউয়ের নাম শেতু। শরীর আর শক্তির জন্য সে খুব গর্ব বোধ করত। শাদুসা একদিন বউকে বলল, : শোন, আমার মাংসপেশিগুলোর দিকে তাকিয়ে দেখ। আমার সমতুল্য শক্তিমান লোক এ গ্রামে তো নেই-ই, আমার মনে হয় সারা দুনিয়াতেও নেই। এখন থেকে তুমি আমাকে মহাশক্তিমান বলে ডাকবে, ঠিক আছে? শেতু বোকা-সোকা কোন বউ ছিল না তো বটেই, বরং জ্ঞান-বুদ্ধিতে সে স্বামীর চেয়ে ভালো ছিল। তাই বলল- : বোকার মতো কথা বলো না, লোকে শুনলে হাসবে। তুমি যত শক্তিশালীই হও না কেন, তোমার চেয়েও শক্তিশালী লোক আছে। লক্ষ্য রাখ, খুব শিগগিরই হয় তো তার দেখা পাবে তুমি। পরদিন শেতু বেড়াতে গেল পাশের গ্রামে। বাড়ি ফিরে আসার সময় তার খুব তেষ্টা পেয়ে গেল। পথের পাশে একটি কুয়ো দেখতে পেয়ে সেদিকে এগিয়ে যায় সে। কুয়োর পাশেই একটি বালতি রাখা। সেটা সে নামিয়ে দিলো কুয়োর ভেতর। পানি ভরে যেতেই বালতিটা টেনে তুলতে থাকে। কিন্তু আশ্চর্য ব্যাপার! বহু টানাটানি করেও বালতিটি সে উঠাতে পারল না। এ সময় একটি মহিলা এলো সেখানে। তার পিঠে কাপড়ে বাঁধা একটি ছোট্ট ছেলে। মাথায় একটি খালি কলসি। বোঝা গেল, কুয়ো থেকে খাবার পানি নিতে এসেছে সে। তাকে দেখে শেতু বলল- : তুমি এখান থেকে পানি নেবে কিভাবে? কুয়ো থেকে বালতিটি তোলা যাচ্ছে না। তার কথা শুনে মহিলাটি কুয়োর কাছে এগিয়ে যায়। তারপর দু’জনে মিলে খানিকক্ষণ টানাটানি করে। কিন্তু বালতি ওপরে তুলতে ব্যর্থ হয় তারা। মহিলাটি বলে- : দাঁড়াও, এক কাজ করি। সে তার শিশু ছেলেটিকে পিঠ থেকে নামিয়ে মাটিতে দাঁড় করিয়ে দেয়। বলে- : যা তো বাবা, মা’র জন্য বালতিটি তুলে আন। শিশুটি কুয়োর কাছে গিয়ে বালতিটি টেনে তোলে ও তার মায়ের কলস ভরে দেয়। তারপর আরেক বালতি পানি তুলে শেতুকে দেয়। শেতুর চোখ ততক্ষণে বড় বড় হয়ে গেছে। মুখ থেকে বেরিয়ে আসে- : এ যে অবিশ্বাস্য ব্যাপার! মহিলা বলে- : এ আর কি! আর স্বামীর ব্যাপার-স্যাপার তো দেখেন-ই নি। সে হলো মহাশক্তিমান। শেতু বাড়ি ফিরে আসে। নিজের বিস্ময়ের ঘোর কেটে যাওয়ার পর স্বচক্ষে যা দেখে এসেছে তা বিশদভাবে স্বামীকে জানায়। স্ত্রীর মুখে সব শোনার পর দাঁত-মুখ খিঁচিয়ে বলে ওঠে শাদুসা- : মহাশক্তিমান! অসম্ভব। আমি থাকতে আর কারো এ নাম হতে পারে না। মহাশক্তিমান হলাম আমি। লোকটাকে উচিত শিক্ষা দেবো। শেতু ভয় পেয়ে যায়। স্বামীকে অনুনয়-বিনয় করে সে বলে- : খবরদার, এ রকম কাজ করতে যেও না। যার এতটুকু ছেলেই এমন শক্তি রাখে সে না জানি কত শক্তিমান। তার সাথে লাগতে গেলে বেঘোরে মারা পড়বে তুমি। শাদুসা বলে- : ঠিক আছে, দেখা যাক। ২. পরদিন খুব সকালে উঠে রওনা হয় শাদুসা। সেই কুয়োটির কাছে পৌঁছে। বালতিটি কুয়ায় নামিয়ে দেয় সে। কিন্তু টেনে তোলার সময় বাধে বিপত্তি। অনেক টানাটানি করেও সে বালতি তুলতে পারে না। এ সময় সেই মহিলাটি ছেলেকে পিঠে বেঁধে হাজির হয়। শাদুসা সেখানে তাকে জিজ্ঞেস করে- : তুমি এখানে কেন এসেছ ? : পানি নিতে এসেছি। : কিন্তু তুমি পানি নেবে কিভাবে? বালতি কুয়ো থেকে তুলতে পারছি না। মহিলাটি ছেলেকে পিঠ থেকে নামিয়ে দিলে সে কুয়ো থেকে বালতি তুলে আনে। : কী আশ্চর্য ! এটুকু বাচ্চা এটা কিভাবে করতে পারল? মহিলাটি জবাব দেয়- : এটা তার জন্য খুবই সহজ। কারণ তার বাবা হচ্ছে ‘মহাশক্তিমান’। একটা ঢোক গেলে শাদুসা। বাড়ি ফিরে যাওয়ার কথা ভাবে। কিন্তু হঠাৎই সে বুক চিতিয়ে দাঁড়ায়। মহিলাকে বলে- : আমি তোমার স্বামীর সাথে দেখা করতে চাই। তাকে দেখিয়ে দিতে চাই যে কে প্রকৃত ‘মহাশক্তিমান’। : আমি এ কাজ করতে পারব না। সে তোমার মতো লোককে খেয়ে ফেলে। তুমি এখান থেকে চলে যাও। কিন্তু শাদুসা নাছোড়বান্দা। সে মহিলাটির পিছে পিছে তার বাড়িতে গিয়ে হাজির হয়। উঠোনের চারদিকে বেড়া দেয়া। এক পাশে বিরাট এক চুলা। তার পাশে হাড়গোড়ের বিশাল স্তূপ। শাদুসা বিস্মিত হয়ে মহিলাটিকে জিজ্ঞেস করে- : এসব কী? সে জবাব দেয়- : আমাদের ঘরটা খুব ছোট। তাই আমার স্বামী এখানে বসে হাতি খায়। ঠিক তখনি প্রচন্ড গর্জন শোনা যায়। এমন আওয়াজ যে শাদুসা কানে হাত চাপা দিতে বাধ্য হয়। এরপর মাটি এমনভাবে কাঁপতে শুরু করে যে তার পক্ষে দাঁড়িয়ে থাকা কঠিন হয়ে পড়ে। সে চিৎকার করে বলে- : এসব কী হচ্ছে? : মহাশক্তিমান আসছে। আঁতকে ওঠে শাদুসা- : কী সর্বনাশ! তুমি আমাকে বোকা বানাচ্ছ না তো! এখান থেকে আমার এখনি পালানো দরকার। কোন পথে যাবো বল? মহিলা বলে- : এখন আর পালানোর সময় নেই। তুমি বাঁচতে চাইলে জলদি আমার সাথে এসো। কোথাও তোমাকে লুকিয়ে রাখি। উঠোনের বেড়ার এক পাশে বেশ কয়েকটি বিরাট মাটির পাত্র রাখা। প্রত্যেকটিই মানুষ সমান উঁচু। তারই একটির গা বেয়ে শাদুসাকে উঠে পড়তে বলে মহিলা। সে উপরে উঠে পাত্রের ভেতরে নেমে পড়লে মহিলাটি ঢাকনা নামিয়ে দিয়ে চলে যায়। কিছুক্ষণ পর ঢাকনা সরিয়ে উঁকি দেয় শাদুসা। দেখে, একটি মৃত হাতি কাঁধে করে এক বিশালদেহী লোক উঠোনে এসে দাঁড়িয়েছে। তার বুঝতে বাকি থাকে না যে এ লোকটিই হচ্ছে মহাশক্তিমান। মহিলাটি জিজ্ঞেস করে- : হ্যাঁগো, তোমার সারাদিন ভালো কেটেছে তো? কন্ঠস্বর তো নয় যেন মেঘের গর্জন শোনা গেল- : হ্যাঁ, তবে আমি তীর-ধনুক নিতে ভুলে গিয়েছিলাম। তাই খালি হাতেই হাতিটা শিকার করতে হয়েছে। শাদুসা আতঙ্কিত চোখে এর পরের ঘটনাগুলো দেখে যেতে থাকল। লোকটি চুলায় বড় করে আগুন জ্বালিয়ে হাতিটি ঝলসাতে শুরু করে। পুরোপুরি ঝলসানো হয়ে গেলে খেতে বসে সে। এক সময় তার পাশে শুধু হাড়ের স্তূপ পড়ে থাকে। হঠাৎ নাক টেনে বাতাসে কিসের যেন গন্ধ অনুভব করে সে। স্ত্রীকে বলে- : বউ! আমি মানুষের গন্ধ পাচ্ছি। ব্যাপার কী? : কী বলছ তুমি! এখানে এখন কোন মানুষ নেই। তুমি যখন বাইরে ছিলে তখন এক লোক এখান দিয়ে গেছে। হয়ত সে গন্ধই পাচ্ছ তুমি। : এহ্! লোকটাকে চলে যেতে দেয়া ঠিক হয়নি। খেতে বোধ হয় সুস্বাদু ছিল সে। মহাশক্তিমান হাত-পা ছড়িয়ে টানটান হয়ে মাটির ওপর শুয়ে পড়ে। তার নিঃশ্বাসের তোড়ে আশপাশের গাছের পাতায় ঝড় বইতে থাকে। এ সময় মহিলাটি দৌড়ে এসে ঢাকনা খুলে চাপাস্বরে শাদুসাকে ডাকে। বলে- : জলদি কর, যেখানে পারো পালাও। শাদুসা চটজলদি বেরিয়ে আসে। বাড়ি থেকে বেরিয়ে দ্রুত চলতে থাকে। কিন্তু বেশি দূরে যাওয়ার আগেই তার কানে গর্জনের আওয়াজ ভেসে আসে। পায়ের নিচে কাঁপতে থাকে মাটি। বুঝতে পারে, তার পালানোর ব্যাপারটি মহাশক্তিমান টের পেয়ে গেছে। এখন তাকে ধরার জন্য ছুটে আসছে। প্রাণে বাঁচতে ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়াতে থাকে শাদুসা। ৩. অনেকটা পথ দৌড়ে আসার পর সে দেখে, একটি মাঠে পাঁচজন লোক ফসলে নিড়ানি দিচ্ছে। তারা শাদুসাকে ওভাবে ছুটতে দেখে অবাক হয়। তাদের মধ্য থেকে একজন জিজ্ঞেস করে- : আরে কী ব্যাপার! তুমি এ রকম দৌড়াচ্ছ কেন? : মহাশক্তিমান আমাকে ধরতে আসছে। হাঁফাতে হাঁফাতে বলে শাদুসা। : আরে রাখো তোমার মহাশক্তিমান। তুমি দাঁড়াও এখানে। আমরা থাকতে কেউ তোমার ক্ষতি করতে পারবে না। এ সময় দূর থেকে ভয়ঙ্কর গর্জন ভেসে আসে। চাষিদের সবাই তাদের হাতের নিড়ানি ফেলে দুই কানে হাতচাপা দিতে বাধ্য হয়। এক চাষি জিজ্ঞেস করে- : এ কিসের আওয়াজ? শাদুসা বলে- : এই হচ্ছে মহাশক্তিমান। কৃষকটি বলে- : তাহলে তোমার পালানোই উচিত। চাষিরা নিজেরাও মাঠের ওপর দিয়ে দৌড়ে পালাতে থাকে। শাদুসা আবার দৌড়াতে থাকে। এক সময় তার দেখা হয় দশজন বোঝাবহনকারী কুলির সাথে। তাদের একজন জিজ্ঞেস করে- : এই যে ভাই তুমি এভাবে দৌড়াচ্ছ কেন? : মহাশক্তিমান আমাকে ধরতে আসছে। কুলিটি বলে- : শান্ত হও, আমরা এতগুলো লোক থাকতে কেউ তোমার কিছু করতে পারবে না। ঠিক তখনই মাটি কাঁপতে শুরু করে, দাঁড়িয়ে থাকতে না পেরে কুলিরা সবাই তাদের বোঝা নিয়ে মাটির ওপর আছড়ে পড়ে। : কী ব্যাপার ? কুলিটি জিজ্ঞেস করে। : মহাশক্তিমান আসছে- বলে শাদুসা। : তাহলে জীবন বাঁচাতে পালাও। বলে তারা নিজেরাও পালাতে থাকে। শাদুসা দৌড়াতে দৌড়াতে পথের এক বাঁকে পৌঁছে। সেখানে সে এক অচেনা লোককে দেখতে পায়। তার পাশে হাতির হাড়ের এক বিশাল স্তূপ জমেছিল। লোকটি তাকে ডেকে থামায়। গলায় মেঘের গর্জন তুলে সে জিজ্ঞেস করে- : কী ব্যাপার ! তুমি এভাবে দৌড়াচ্ছ কেন? : মহাশক্তিমান আমাকে ধাওয়া করেছে। কাতরকণ্ঠে জানায় শাদুসা। : তুমি বোধ হয় ঠিক বলছ না। কারণ আমার চেয়ে পৃথিবীতে আর কেউ শক্তিশালী নেই। আমি মহাশক্তিমান। শাদুসার পেছন থেকে গর্জন ভেসে আসে, মাটি প্রচন্ডভাবে কাঁপতে থাকে। সে দাঁড়িয়ে থাকতে না পেরে আরেকবার মাটিতে পড়ে যায়। অচেনা লোকটি তাকে টেনে তোলে। ওদিকে মহাশক্তিমান তাদের দিকে দৌড়ে আসতে থাকে। : ওকে আমার হাতে ছেড়ে দাও- গর্জন করে বলে সে। : এসো, আমার কাছ থেকে ওকে নিয়ে যাও- পাল্টা গর্জন করে বলে অচেনা লোকটি। মহাশক্তিমান অচেনা লোকটির দিকে এগোতেই সে শাদুসাকে একটি গাছের ওপর ছুড়ে দেয়। তারপর মহাশক্তিমান এবং সে পরস্পরকে জড়িয়ে ধরে মল্লযুদ্ধে লিপ্ত হয়। দু’জনের ভয়ঙ্কর হুঙ্কারে কানে তালা লেগে যায় শাদুসার। দু’জনের পায়ের আঘাতে ওড়া ধুলায় সে ঢাকা পড়ে। অন্যদিকে মাটির কম্পনে গাছও প্রচন্ডভাবে কাঁপতে থাকায় পড়ে যাবার অবস্থা হয় তার। সে দেখতে পায়, দু’জন ভীষণ বিক্রমে লড়ে চলেছে। একজন অন্যজনকে এমনভাবে আঁকড়ে ধরেছে যে আর কোনদিনই বুঝি তারা বিচ্ছিন্ন হবে না। হঠাৎ দু’জনই প্রচন্ড এক লাফ দিয়ে অনেকখানি ওপরে উঠে যায়। তারপর উঠতেই থাকে। এক সময় তারা হারিয়ে যায় মেঘের আড়ালে। তাদের আর দেখা যায় না। শাদুসা তাদের অপেক্ষায় থাকে। কিন্তু অনেক সময় কেটে গেলেও তারা ফেরে না। আরো কিছুক্ষণ অপেক্ষার পর সে সাবধানে গাছ থেকে নেমে আসে। তারপর দৌড় দেয়- দৌড় আর দৌড়। একবারে বাড়িতে পৌঁছে তবেই সে নিরাপদ বোধ করে। এরপর সে আর কখনোই নিজেকে মহাশক্তিমান বলে জাহির করার চেষ্টা করেনি।
আরও পড়ুন...