
রাজকন্যা
গল্প আহসান হাবিব বুলবুল আগস্ট ২০২৩
নাদির আলী রিকশায় উঠলেই রিকশাওয়ালার সাথে গল্প জুড়ে দেন। এটা তার অভ্যাস বলতে পারেন। রিকশাওয়ালাদের জীবনের অনেক গল্পই তার জানা। ভেবেছেন, এসব খেটে খাওয়া মানুষের সুখ-দুঃখ নিয়ে কখনো কিছু একটা লিখবেন। স্কুলজীবন থেকেই তার লেখালেখির একটা ন্যাক আছে। কর্মজীবনে এসে তাতে কিছুটা ভাটা পড়লেও মাঝে মধ্যে লেখেন। পত্র-পত্রিকায় ছাপাও হয়। নাদির আলীর এমনও হয়েছে, রিকশাওয়ালার কষ্টের কথা শুনতে শুনতে নেমে যাবার সময় নির্ধারিত ভাড়ার চেয়ে দশ-বিশ টাকা বেশি দিয়ে চলে গেছেন।
নাদির আলী খিলগাঁও রেলগেট থেকে রিকশায় চেপেছেন। আজ তিনি চুপচাপ। অন্যদিনের মত চালকের সঙ্গে কথা বলার প্রসঙ্গ টানছেন না। তার কারণ হলো, মেয়ে সঙ্গে আছে। মেয়েকে কলেজ গেটে নামিয়ে দিয়ে তিনি অফিসে যাবেন। কিছুদূর অগ্রসর হতেই রিকশাচালক নিজে থেকেই কথা শুরু করলেন। ষাটোর্ধ্ব এই চালক বয়সের ভারে, জীবন যন্ত্রণার চাপে কিছুটা হলেও নুয়ে পড়েছেন। নাদির আলী ভাবলেন, ভালোই হলো আমাকে প্রসঙ্গ টানতে হয়নি। তা-উনি বললে শুনতে আপত্তি কী?
নাদির আলীর মেয়ের নাম উর্মি।
উর্মি বলল, চাচা এত কথা বললেতো এক্সিডেন্ট করবেন। মনোযোগ দিয়ে রিকশা চালান। রিকশাওয়ালা মেয়েটার কথায় কোনো কর্ণপাত করলেন না। কথা বলেই চললেন। কথাতো নয় যেন জীবনের গল্প। নাদির আলী এবার মাঝে মধ্যে অনুসন্ধানী দু’একটি প্রশ্নও করছেন।
‘স্যার! বড় ইচ্ছা ছিল পোলাডারে লেখাপড়া শিখায়্যা মানুষ করব। তা আর হইল না। হে বছর নদী ভাঙনে জমি-জিরাত ঘর-বাড়ি সব যমুনায় গ্যালো। পেটের দায়ে গেরাম ছাইড়া ঢাকায় আইলাম। রিকশার প্যাডেলে পা উঠলো। পোলাডা গাড়ির কারখানায় কাম করে। অল্প বয়সেই বিয়া করচে। যা কামাই-রোজগার করে তাতে তাগোরেই চলে না। আমাগো কী দ্যাখবো। বিয়ার এক বছর না যাইতই আলাদা থাকে, আলাদা খায়। আমরা বুড়া-বুড়ি শুধু চাইয়া থাকি- কখ্খন একটু আইসা চোখ্খের দ্যাখা দিয়া যাইবো। বুড়ির সময় কাটে না। তাই একডা মাইয়া বাচ্চা ‘পালক’ নিছে। হে নাকি বড় হইয়া তারে দ্যাখবো। প্রথ্থম প্রথ্থম আমার মত ছিল না। পরে মত দিছি। কয়েকদিন হইল মাইয়া বাচ্চাডার জ্বর। ডাক্তার বলচে ডেঙ্গুতে ধরচে। মা মাইয়্যা দুনোজনই এহুন হাসপাতালে। আমি রিকশা নিয়া নামচি ওষুধ-পত্তরের পয়সাতো যোগাড় করতে হইবো।” সামনে ঈদ মাইয়াডার জন্য একটা নতুন জামাও কিনতে হইবো।
কলেজগেট আসতেই উর্মি বলে, চাচা রিকশা ঘুরান। মেডিক্যালে যাবো। আপনার মেয়েকে দেখতে যাবো।”
রিকশাওয়ালা এই প্রথম পিছন ফিরে উর্মিকে দেখল; ‘কী কন মা। না, আফনের দেরি হইয়া যাইবো। আফনে ইস্কুলে যান।
: চাচা রিকশা ঘুরান।
- উর্মির কণ্ঠে এক কলস মমতা ঢলে পড়ে।
নাদির আলী হকচকিয়ে যান। একি উর্মি কথা বলছে; তার মেয়ে উর্মি!
তিনি মেয়েকে না বলতে পারেন না। তিনি মেয়ের জন্য গর্ববোধ করেন। এই না হলে আমার মেয়ে।
পথিমধ্যে রিকশা থামিয়ে কিছু ফল কিনে নেয় উর্মি। হাসপাতাল বেডে খুকিকে দেখে ফেরার সময় উর্মি রিকশাওয়ালা চাচা’র হাতে এক হাজার টাকার একটা নোট তুলে দেয়। রিকশাওয়ালা ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে উর্মির দিকে। তার মুখে কোনো ভাষা নেই, শুধু মাথার গামছা দিয়ে দু’চোখ মুছতে থাকেন।
নাদির আলী বলেন, মা উর্মি আজ থেকে আমি আমার ভুবনের রাজা, তুমি রাজকন্যা।
আরও পড়ুন...