বন্ধু

বন্ধু

গল্প মুহাম্মাদ দারিন মে ২০২৪

‘নাহ! আমি আর একটু ঘুমাবো।’ ঘুমের ঘোরে বলে ছোট্ট মেয়েটি।

‘না! তুমি এবার ওঠো।’ বলে অপরিচিত এক কণ্ঠ।

‘উঠবো না।’ একটু রেগে বলে ও।

‘ওঠো সোনা।’ বলে সেই কণ্ঠ।

‘বললাম তো উঠবো না।’ স্বাভাবিক হয়ে বলে ছয় বছর বয়সি ছোট্ট মেয়ে তায়রা।

‘আহা ওঠো তো।’ রাগতে পারছে না সে।

‘একবার বলেছি উঠবো না।’ দৃঢ়ভাবে বলে তায়রা।

‘তোমাকে উঠতে হবে।’ যেন ওকে ঘুম থেবে উঠাতে চায় সে।

‘বারবার বলেছি উঠবো না। আর একবার বলেছি উঠবো না।’ বড্ড জেদি মেয়ে ও।

‘তা কি হয়? ওঠো সোনা।’ নিজেকে স্বাভাবিক রেখে বলে সে।

‘আমি এখন উঠতে চাই না।’ কণ্ঠে দৃঢ়তা মেয়েটির।

‘তোমাকে যে উঠতে হবে।’ মেয়েটিকে ঘুম থেকে উঠাতে বদ্ধপরিকর সে।

‘উঠবো না, উঠবো না, উঠবো না।’ কিছুটা রেগে যায় তায়রা।

‘ওঠো, ময়না পাখি, ওঠো।’ মমতা ভরা কণ্ঠ তার।

‘উঠতে পারি যদি আমাকে একটা ময়না পাখি কিনে দাও।’ আবদারের সুরে বলে তায়রা।

‘আচ্ছা দেবো। এখন তো ওঠো।’

‘আগে দাও।’ নিজেরটা আদায় করতে চায় ও।

‘আগেতো ঘুম থেকে ওঠো।’ লোকটাও নাছোড় বান্দার মতো বলে।

‘না দিলে উঠবো না।’ চোখ বন্ধ রেখেই বলে মেয়েটি।

‘না উঠলে দেবো না।’ লোকটাও ওর জেদ দেখতে চায়।

‘তাহলে থাক আমি ঘুমাচ্ছি।’ নড়েচড়ে ঠিক হয় ও।

‘না সোনা তুমি ওঠো। বিকেলে বাজারে গিয়ে একটা ময়না পাখি কিনে দেবো তোমাকে।’ মেয়েটির কথায় পরাজিত হয়ে বাধ্য হয়ে বলে লোকটি।

‘এখনই দিতে হবে।’ তায়রা বলে।

‘এখন তো অনেক সকাল। এখনও বাজার খোলেনি। এত সকালে মানুষেরা বাজার খোলে না।’ লোকটা ওকে বোঝাতে চায়।

‘না, আমার এখনই চাই। এখনই দিতে হবে।’ আজব মেয়ের আজব আবদার।

‘সোনা ময়না, এখনও মানুষেরা বাজার খোলেনি। তাহলে তোমাকে কীভাবে কিনে দেবো?’

‘তাহলে আমি এখন ঘুমাচ্ছি।’

‘ঠিক আছে, ঘুমাও।’ যেন ওকে লোভ দেখাচ্ছে লোকটি। ‘তবে, তার আগে ময়না পাখির গল্প শুনতে চাও?’

‘তুমি ময়না পাখির গল্প বলবে?’ আগ্রহের সাথে বলে তায়রা।

‘তুমি শুনলে আমি বলবো।’

‘থাক। আমি এখন ঘুমাই। তুমি পরে গল্প বলো।’

‘হুম।’ বলে একটা নিঃশ্বাস ছাড়ে। তারপর ছোট্ট মেয়েকে বলে, ‘ময়না পাখি, তুমি আজ এমন করছো কেন?’

‘আর একবার ডাকলে আমি কিন্তু রেগে যাবো।’ রাগে নাক দিয়ে ফোস ফোস শব্দ বের করে তায়রা।

‘আমার টুনটুনি রাগতে নেই।’ কোমলভাবে বলে সেই কণ্ঠ।

‘আচ্ছা, টুনটুনি কি গান গায়?’ আগ্রহ নিয়ে জানতে চায় ঘুমন্ত মেয়েটি।

‘বলতে পারি যদি তুমি ঘুম থেকে ওঠো।’

‘আমি জানি। টুনটুনি গান গেতে পারে।’ সবজান্তার মতো করে বললো মেয়েটি।

‘এইতো ছোট্ট সোনা, তুমি তো অনেক কিছু জানো।’

‘হুম। এখন আর কথা বলো না, আমি ঘুমাবো।’ আবারও নড়েচড়ে শোয় ও।

‘আর ঘুমায়ো না ছোট্ট পরী।’ নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে স্বাভাবিকভাবে বলে সে।

‘তুমি পরী দেখেছো?’ জানতে চায় তায়রা।

‘হুম দেখেছি।’

‘দেখতে কেমন?’ যেন দেখতে চায় মেয়েটি।

‘ঠিক তোমার মতো।’

‘হুম, আমার আব্বুও আমাকে মাঝে মাঝে পরী বলে ডাকে।’

‘তাইতো। তুমিই এক ছোট্ট ফুলপরী।’

‘তা না হয় হলো।’ যেন আসল কথা মনে পড়েছে মেয়েটির এমনভাবে বললো, ‘আচ্ছা, তুমি কে? আমাকে ডাকছো কেন?’

‘আগে ওঠো তারপর বলছি।’

‘তা হবে না। আগে তোমাকে বলতে হবে।’ জেদি কণ্ঠে বলে মেয়েটি।

‘আচ্ছা আম্মু সোনা, তুমি এত জেদি কেন?’

‘হুম।’ একটা শব্দ বের হয় ওর মুখ থেকে।

‘তুমি কি ফুল খুব ভালোবাস?’

‘তুমি কি ফুলের কথা বলছো?’ জানতে চায় ছোট্ট মেয়ে তায়রা।

‘ধরো গোলাপ।’

ডান কাত থেকে ঘুরে বাম কাতে শোয় মেয়েটি। তারপর বললো, ‘হুম গোলাপ খুব ভালো ফুল। সব ফুলই আমার পছন্দ।’

‘আর প্রজাপতি?’  লোকটি যেন আগ্রহ বাড়াচ্ছে মেয়েটির।

‘আরে, আমিতো প্রজাপতি হতে চাই।’ দু’চোখ বন্ধ রেখেই বলে যায় ছোট্ট মেয়েটি।

‘কেন?’ যেন বিস্ময় ঝরে পড়ে তার কণ্ঠে।

‘প্রজাপতি হলে একটা ফুল, দুইটা ফুল, সব ফুলের ওপর ঘুরে বেড়ানো যায়। আমি ফুল ভালোবাসি, প্রজাপতিও ভালোবাসি।’ ছোট্ট মেয়ে অথচ কথাগুলো সাবলীলভাবে গুছিয়ে বলে যায় ও।

‘আচ্ছা, এই কথা। তাহলে তো খুব ভালো। শোনো মনা।’ বলে একটু দম নেয়। তারপর বলে, ‘আজ তুমি আলসে মেয়ের মতো ঘুমাচ্ছো কেন?’

‘আলসে নয় সে ওঠে রোজ সকালে।’ বাম হাত উঁচু করে বাম পাশে ফেলে বাম কাত থেকে ঘুরে চিৎ হয়ে দু’চোখ বন্ধ রেখে বলে ছয় বছরের তায়রা।

‘ওরে বাবা, তুমি আবার কবিতাও জানো?’

‘হুম, আরও জানি।’

‘বলোতো?’ উৎসাহের জন্য বললো সে।

‘এখন আর বলবো না। পড়ার সময় পড়া, খেলার সময় খেলা আর ঘুমানোর সময় ঘুম। এখন আমার ঘুমের সময়। আর কিছু বলবো না। এখন আমি চুপ।’ বলে ও আবার ডান কাতে শুয়ে দুই হাত জোড় করে ডান চোয়ালের নিচে রাখে।

‘কে বলেছে এখন তোমার ঘুমের সময়।’

‘দেখো আজ আমার স্কুল বন্ধ। আমার স্কুল ঈদের বন্ধ দিয়েছে। তাই আজ আমি সকাল সকাল উঠবো না।’

‘তুমি কেন উঠবে না?’

‘শোনো বন্ধের দিন আমার স্কুলও বন্ধ থাকে। এই দিন আমার স্কুলে যাওয়া লাগে না। আর আমার আব্বা বন্ধের দিন বাড়ি থাকেন। তিনি তখন বাড়ির অনেক কাজ করেন। আম্মুকে কাজে সহযোগিতা করেন। তাই আমি বন্ধের দিন কোনো কাজ করি না। এই জন্য বেশি ঘুমাই, বুঝেছো?’ একনাগাড়ে বলে মেয়েটি।

‘হুম, বুঝলাম যে তুমি আলসে নও। খুবই কাজের।’

‘হ্যাঁ। আমি মোটেও আলসে না। আমি সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠি। নিজে নিজে ব্রাশ করি। নিজে নিজে খেতে পারি। নিজের স্কুল ব্যাগ নিজে গোছাই। আব্বুর সাথে স্কুলে যাই। সবার আগে ম্যাডামদের লেখা জমা দেই। পড়া বলি। বাসায় এসে আম্মুর কত কাজ করে দিই।’ বড়োদের মতো করে বললো ছোট্ট মেয়েটি দু’চোখ বন্ধ রেখে শুয়ে থেকে।

‘বাব্বাহ! তুমিতো খুব কাজের মেয়ে।’

‘না! মোটেও না! আমি আমার আব্বা-আম্মার মেয়ে।’ কিছুটা রেগে বলে মেয়েটি।

‘আচ্ছা, আচ্ছা ঠিক আছে। তুমি তোমার আব্বা-আম্মার মেয়ে।’

‘হুম। মনে থাকে যেন।’ শাসিয়ে দিলো যেন মেয়েটি।

‘আচ্ছা বাবা, আচ্ছা। মনে থাকবে।’

‘হেই্।’ হঠাৎ যেন সিরিয়াস হলো ছোট্ট মেয়ে তায়রা। বললো, ‘তুমি আমাকে এত কথা জিজ্ঞাসা করছো, তুমি কে?’

‘জানাটা কি খুব দরকার?’

‘বলো বলো, তুমি কে?’ জানতে চায় তায়রা।

‘ধরে নাও আমি তোমার বন্ধু।’

‘বন্ধু।’

ঠিক তখন তায়রার কানে আসে তার আব্বার ডাক।

‘তায়রা সোনা, জলদি জলদি ওঠো। আমার মানিক সোনা জলদি ওঠো। ব্রাশ করে খেয়ে-দেয়ে রেডি হও, আজ তোমার ঈদের জামা-কাপড় কিনতে যেতে হবে।’

তায়রা ডান কাত হয়ে ঝিম মেরে কথাগুলো শোনে।

পায়ে পায়ে আব্বা ওর বিছানার পাশে এসে ওর সিল্কি কালো-সোনালি চুলে হাত বুলিয়ে বলতে থাকেন, ‘তায়রা ময়না সোনা, জলদি ওঠো, ঈদের জামা-কাপড় কিনতে যেতে হবে।’

তায়রা এবার দু’চোখ খুলে পিটপিট করে ওর আব্বার দিকে তাকায়।

আব্বা আবার বলেন, ‘আমার ময়না সোনা, ওঠো ওঠো।’

তায়রা কাত থেকে উঠে বসতে বসতে বলে, ‘আব্বা বন্ধু কোথায় গেল?’

আব্বা বুঝতে না পেরে বলেন, ‘কোন বন্ধু?’

‘না, আমার বন্ধু।’ তায়রা ওর আব্বার মুখের দিকে তাকিয়ে বলে।

তায়রা তার দুই হাত কোলের ওপর আনে। ওর ডান হাতে সুন্দর একটা গোলাপ ফুল। গোলাপটা না কুঁড়ি না ফোটা। অপরূপ দেখতে লাগছে। ওর বাম হাতে আর একটা নাম না-জানা ফুটন্ত সুন্দর ফুল। দুইটা ফুলের ওপর দুইটা ছোট্ট প্রজাপতি বসে ডানা নাচাচ্ছে।

তায়রা এবার ওর দুই হাত খেয়াল করলো। ওই চারটি জিনিস দেখে ওর মুখ থেকে বের হলো, ‘ওয়াও! এটাইতো চাই।’

ওগুলো দেখে ওর আব্বার মুখও বিস্ময়ে হাঁ হয়ে গেল। নিজেকে নিয়ন্ত্রণে এনে ওর আব্বা বললো, ‘ময়না পাখি আমার, তুমি এগুলো পেলে কোথায়?’

তায়রা দু’চোখ বন্ধ করে এক মুহূর্ত ভাবলো। তারপর চোখ খুলে বললো, ‘আমার বন্ধু দিয়েছে।’

‘পাগলি মেয়ে আমার, বলে আব্বা ওর মাথার চুল এলোমেলো করে দিয়ে দরজা দিয়ে বাইরে বেরিয়ে যেতে যেতে ভাবলেন মেয়ে তার ফুল খুব ভালোবাসে। হয়তো ওর মা গতকাল এগুলো কিনে দিয়েছেন। কিন্তু প্রজাপতি!

তিনি দরজা পর্যন্ত এসে থমকে দাঁড়িয়ে ঘুরে মেয়ের দিকে তাকালেন। দেখলেন, মেয়ে দুই হাতে দুই ফুল ধরে বিছানার ওপর দাঁড়িয়ে নাচানাচি শুরু করেছে আর প্রজাপতি দু’টি ফুলের ওপর মহা আনন্দে বসছে আর উড়ছে। মেয়ে ও দুটো ধরার কোনো চেষ্টা করছে না বরং প্রজাপতির সাথে যেন খেলা করছে ও। আর এতে মেয়ে তার মহাখুশি। তিনি মেয়ের দিকে অপলক তাকিয়ে থাকলেন। ত্রিশ সেকেন্ডের মতো, পরে প্রজাপতি দু’টি খোলা জানালা দিয়ে বাইরে বেরিয়ে গেল।

তায়রা তখন প্রজাপতিদের লক্ষ করে বললো, ‘যাও প্রজাপতি তোমরা আমার বন্ধুকে বলো আমি খুব খুশি হয়েছি।’

বাবা অনুচ্চস্বরে বলেন, ‘পাগলি মেয়ে আমার।’ বলে ঘুরে তিনি আবার হাঁটা শুরু করেন।

আপনার মন্তাব্য লিখুন
অনলাইনে কিশোরকন্ঠ অর্ডার করুন
লেখকের আরও লেখা

সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

আরও পড়ুন...

CART 0

আপনার প্রোডাক্ট সমূহ