ঈদ হোক সবার জন্য সমান খুশির -মামুন মাহফুজ
ফিচার জুন ২০১৭
আমরা সবাই জানি ঈদ অর্থ আনন্দ ঈদ অর্থ খুশি। একটি গান আছে এরকম- ঈদ মানে আনন্দ ঈদ মানে খুশি, ঈদ মানে সবার মুখে ফোটাতে চাই হাসি... ঈদ এর শাব্দিক অর্থ হলো বারবার ফিরে আসা। হতে পারে সবাই যেহেতু চায় দিনটি যেন সবার জীবনে বারবার ফিরে আসুক, তাই হয়তো একে ঈদ বলা হয়। অথবা এমনও হতে পারে মহান আল্লাহ এই দিনটিতে তার অনুগ্রহ নিয়ামত বারবার ফিরিয়ে দেন তাই এর নাম ঈদ। তবে একটি বিষয় জোরালোভাবে মনে হয় আর তা হলো এই ঈদের দিন মানুষ তার পুরনো অভ্যাসে ফিরে আসে। একটি মাস সিয়াম পালনের কারণে মানুষ সারাদিন না খেয়ে থাকে, পানাহার থেকে বিরত থাকে কিন্তু ঈদের দিন সে আবার সেই খাদ্যাভ্যাসে ফিরে আসে। আবার এওতো ঠিক; এদিন আমরা বারবার খাই। বারবার খাবারের দিকে ফিরে যাই। একবার নিজের বাসায়, তারপর চাচা-ফুপু-খালা-মামা আত্মীয়স্বজন প্রতিবেশী সবার বাসায় যাই আর বারবার কিছু খাই। তাই না? তবে ঈদের প্রচলন কখন কিভাবে এবং কেন হলো তা কিন্তু অনেক গভীর একটি ব্যাপার। অনেকে মনে করেন ঈদ অর্থ গাম্ভীর্যপূর্ণ আনন্দ। মহানবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ৬২২ খ্রিস্টাব্দে তাঁর অনুসারীদের নিয়ে মদিনায় হিজরত করেন। মদিনায় গিয়ে তিনি দেখলেন মদিনাবাসী পূর্ব থেকেই দু’টি উৎসব পালন করছেন, যা ছিল মূলত ইহুদিদের প্রচলন। কিন্তু মুসলমানদের কোনও কিছু না থাকায় তারাও না বুঝে সেই উৎসব পালন করে যাচ্ছেন। উৎসব দু’টি ছিল ‘নওরোজ’ ও ‘মেহেরজান’। নবী (সা)-এর আগমনের পর সাহাবারা দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়লেন। তারা নিজে থেকেই ভাবতে লাগলেন মুসলমান হওয়ার পরও তারা ওই উৎসব পালন করবে কি না। অর্থাৎ তারা ঈমান গ্রহণের সাথে এটাও গ্রহণ করে নিয়েছেন যে এর মাধ্যমে তাদের সংস্কৃতিও আলাদা হয়ে গেছে। সাহাবাদের এই দ্বিধার জবাবে মহান আল্লাহর তরফ থেকে রাসূল (সা) তাদের জানিয়ে দিলেন আল্লাহ তায়ালা তোমাদের জন্য এর পরিবর্তে আরও উৎকৃষ্টতর দু’টি দিন দান করেছেন। এর একটি হলো ঈদুল ফিতর ও অপরটি হলো ঈদুল আজহার দিন। প্রত্যেক জাতির নিজস্ব ঈদ রয়েছে, আর এটা আমাদের ঈদ (বুখারি ও মুসলিম) আনাস ইবনে মালিক (রা) হতে বর্ণিত: রাসূলুল্লাহ (সা) যখন (মদিনায়) এলেন, তখন তাদের দুটো উৎসবের দিন ছিল। তিনি (সা) বললেন, “এ দুটো দিনের তাৎপর্য কী?” তারা বলল, ‘জাহিলিয়াতের যুগে আমরা এ দুটো দিনে উৎসব করতাম।’ রাসূলুল্লাহ (সা) বললেন, “আল্লাহ তোমাদেরকে এদের পরিবর্তে উত্তম কিছু দিয়েছেন: ইয়াওমুদ্দুহা ও ইয়াওমুল ফিতর।” (সুনান আবু দাউদ) প্রচলিত নওরোজ ও মিহিরজান উৎসবের তুলনায় এই দুই ঈদ যে সত্যিই উৎকৃষ্ট তাতে কোনও সন্দেহ নেই। কেননা নওরোজ ছিল শ্রেণিবৈষম্য, ধনী ও দরিদ্রদের মধ্যে ভেদরেখা তৈরি, বিত্তশালীদের অহঙ্কার ও অশালীনতা প্রকাশের উৎসব। নওরোজ এবং মিহিরজান দুটোই হতো (৬+৬) ১২ দিন ধরে। আর তা ছিল বিভিন্ন শ্রেণির জন্য আলাদা আলাদা। যেমন নওরোজ এ হাসানা কিংবা নওরোজ এ বুজুর্গ ছিল শুধু ধনীদের জন্য। ওই দিন দরিদ্ররা অংশ নিতে পারবে না। আবার একটি দিবস ছিল অশ্লীল নৃত্যের জন্য। ওই দিনটি থাকতো বিশেষভাবে নর্তকীদের জন্য। আর একটা দিন ছিল নওরোজ এ আম্মা। এ উৎসব ছিল আ’মভাবে সাধারণ মানুষদের জন্য। তবে এ দিনকে খুব তাচ্ছিল্য আর ঘৃণার চোখে দেখা হতো। অত্যন্ত লাঞ্ছনার সাথে দিবসটি পালন করতো দরিদ্র ও সাধারণ শ্রেণির মানুষ। ইসলাম এসে এই রীতির মূলে কুঠারাঘাত করলো। বছরে দু’টি দিন নির্ধারণ করা হলো যেখানে উঁচু-নিচু, ধনী-গরিব, সবশ্রেণি পেশার মানুষ সমান। সবারই অংশ আছে ঈদে। ধনী যেমন আনন্দ করবে তেমনি ধনীদের অর্থে আনন্দ করবে দরিদ্ররা। হোয়াট এ আইডিয়া! কোন সমাজকে কোন সমাজে পরিবর্তন করে ফেললেন রাসূল (সা)। তাঁর মতো মানবদরদি এই বিশ্বভুবনে কেউ নেই। আজ আমরা যদি টাকা আছে বলে শুধু নিজেরাই আনন্দ করি আর দরিদ্রদের খোঁজ না রাখি তাহলে কি সেই ঈদকে আল্লাহর দেয়া নিয়ামত ঈদ বলা যাবে? তাহলেতো তাকে ইহুদিদের প্রবর্তিত নওরোজ টাইপের কিছু বলতে হবে! তাই সাবধান! ঈদ উপলক্ষে অসহায় দরিদ্র মানুষের প্রতি দৃষ্টি রাখতে হবে কিন্তু। ঈদের আনন্দ পৌঁছে দিতে হবে সবার ঘরে ঘরে... আর ক’দিন বাদেই তো ঈদ। রেডিও-টিভিতে বেজে উঠবে “ও মন রমজানের ওই রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ... ” জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের এই গান ছাড়া যেন আমাদের ঈদ শুরুই হয় না। ছোটবেলা থেকেই যখন আকাশে ঈদের চাঁদ দেখতে পেতাম না, তখন অপেক্ষা করতাম কখন এই গানটি বাজবে। আর তখনই বুঝে ফেলতাম চাঁদ দেখা গেছে। কাল ঈদ। চাঁদ দেখা কিন্তু ভালো। রাসূল (সা) বলেছেন, তোমরা রমজানের চাঁদ দেখে রোজা রাখা শুরু করো এবং শাওয়ালের চাঁদ দেখে রোজা রাখা বন্ধ করো। অতঃপর শাওয়ালের প্রথম দিনটিই হবে ঈদুল ফিতর। “তোমরা (রমজানের) চাঁদ দেখে রোজা শুরু করবে এবং (ঈদের) চাঁদ দেখেই রোজা ছাড়বে। যদি আকাশ মেঘাচ্ছন্ন হয় (এবং চাঁদ দেখা না যায়) তাহলে মাসের ৩০ দিন পূর্ণ করবে।” সহিহ বুখারি ১/২৫৬, হাদিস : ১৯০৬ সেই ঈদ শুরু হতে আর ক’দিন বাকি। এরইমধ্যে সবাই হয়তো কেনাকাটা শুরু করেছে। কেউবা হয়তো কেনাকাটা শেষও করে ফেলেছে। কিন্তু আমাদের আত্মীয়স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী কিংবা অন্তত যে মানুষটি আমাদের ঘরের কাজ করে দেয় তার অথবা তার বাচ্চার কী অবস্থা? তারা কি কিছু কিনেছে? তারা কি ঈদের দিন আনন্দ করতে পারবে? কিংবা তাদের কী লাগবে সেই খোঁজটি কে নেবে? অবশ্যই সেই দায়িত্ব আমাদের। মহান আল্লাহ পৃথিবীতে আমাদেরকে তার প্রতিনিধি করে পাঠিয়েছেন, অতএব তাদের ব্যবস্থা আল্লাহ করবেন এমনটি ভেবে আমরা যেন হাত গুটিয়ে বসে না থাকি। আমাদেরকে অবশ্যই সাধ্যমত চেষ্টা করতে হবে। তারপর আল্লাহর সাহায্য। নিজেরা চেষ্টা না করে শুধু আল্লাহর কাছে হাত তুলে বসে থাকা ঈমানের পরিচায়ক নয়। তবে এ ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের ভূমিকা সবচেয়ে জরুরি। কেননা আমার যদিওবা সম্ভব এক-দু’জন বা দু’চারজন মানুষের চাহিদা মেটানো কিন্তু অসহায় মানুষের সংখ্যাতো অনেক। প্রতিদিন কতো হাজার মানুষ ফুটপাথে ঘুমায়। তাদের থাকার কোনও জায়গা নেই, তাদের যাওয়ার কোনও জায়গা নেই। সেইসব ভাসমান মানুষদের কে দেখবে? অবশ্যই সরকারকেই দেখতে হবে। সরকার জনগণের দেখভালের দায়িত্ব নিয়েছে। তাদের ভরণপোষণের দায়িত্বও তার। কিন্তু একটা কথা আমরা বলে থাকি তা হলো বাংলাদেশ দরিদ্র দেশ। সরকারও বলে থাকে ভাসমান দুস্থ অসহায় মানুষদের পুনর্বাসন করার মতো অর্থনৈতিক অবস্থা বাংলাদেশের নেই। কিন্তু সত্যিই কি নেই? অপ্রয়োজনীয় ব্যয় বন্ধ করলেই এসব মানুষের একটা ব্যবস্থা কিন্তু সরকার করতে পারে। যেমন- অমুক এই ব্রিজ বানিয়েছেন বা ফ্লাইওভার বানিয়েছেন এই লেখাটা পাথর খোদাই করে লিখতে যে খরচ হয় তার কি কোনও দরকার আছে? সরকার কি নিজের টাকায় কিছু করছেন? নাকি জনগণের টাকায় করছেন? তাহলে নিজের নামে এতো বড় ভিত্তিপ্রস্তর তিনি কেন করবেন? সত্যি বলতে কি রাস্তাঘাটে যখন দেখি না খেয়ে থাকা মানুষগুলো, কিংবা আশ্রয়হীন মানুষগুলো কী মানবেতর জীবন যাপন করছে আর ঠিক তখনই যদি দেখি কিছু মানুষ মানুষের দায়িত্ব নিয়ে এমন বিলাসিতায় মগ্ন তখন নিজের প্রতি নিজের ধিক্কার আসে। এ কেমন মানুষ আমরা? আমাদের নবী (সা) রাষ্ট্রনায়ক ছিলেন। তিনি নিজে না খেয়ে থেকেছেন দিনের পর দিন, অথচ তার কাছে কেউ এলে তিনি খালি হাতে ফেরত দিতেন না। এমনকি নিজের ঘরে কিংবা নিজের কন্যা বা স্বজনদের ঘরে কিছু না থাকলে সাহাবীদের ডেকে বলতেন কে আছো যে আজ রাসূলের মেহমানকে মেহমানদারি করাতে পারবে? তখন সাহাবীরা যতো কষ্টই হোক এমনকি নিজের সন্তানদের অভুক্ত রেখে হলেও মেহমানদারি করতেন। অথচ আজ কী হচ্ছে? আমাদের রাষ্ট্র পরিচালকেরা একেকজনের একদিনের নাস্তার বাজেট দিয়ে ২ হাজার মানুষের ভরপেট খাবার হয়। এছাড়া মন্ত্রীরা যখন দেশের বাইরে যান তখন তাদের আপ্যায়ন বাজেট থাকে ৭০০ ডলার। চমকে ওঠার মতোই বটে। দেশের জনগণের টাকায় কেউ বিলাসিতা করছে আর কেউ না খেয়ে মরছে, ঘুমাচ্ছে ফুটপাথে। কিন্তু তাই বলে আমাদেরতো চোখ কান বন্ধ করে থাকলে চলবে না। আমাদের আশপাশের মানুষের কথা ভাবতে হবে। আমরা আমাদের সুখটুকু ভাগাভাগি করে নেবো তাদের সাথে। যে পথশিশুটির একটি জামাও নেই, যাদের ৪-৫টি জামা তাদের থেকে একটি দিয়ে দিলে নিশ্চয়ই আল্লাহ এর প্রতিদান দেবেন। একটা ব্যাপার কিন্তু বরাবরই দেখা যায়। ঈদ এলেই শহরের বিপণিবিতানগুলোতে ক্রেতাদের উপচে পড়া ভিড় লেগেই থাকে। এতো মানুষ নতুন জামা-কাপড়-জুতা-স্যান্ডেল ইত্যাদি কিনছে অথচ তাদেরই পাশে পাশে ঘুরে বেড়ায় ছেঁড়া জামা গায়ে, শতচ্ছিন্ন জামা গায়ে তাদের মতোই কোনও শিশু। একই অবয়ব-হাতপা নিয়ে জন্মানো ওই শিশুটির কেন কিছু নেই? কে দেবে এর জবাব? প্রতিটি মানুষের মৌলিক চাহিদা মেটাবার শপথ নিয়েছে সরকার। সংবিধান বলছে মানুষের বাঁচার জন্য ৫টি মৌলিক চাহিদা খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান ও চিকিৎসার ব্যবস্থা করবে রাষ্ট্র। এটা রাষ্ট্রের অন্যতম মৌলিক দায়িত্ব। সংবিধানের ১৫ নম্বর ধারায় উল্লেখ আছেÑ “রাষ্ট্রের অন্যতম মৌলিক দায়িত্ব হইবে পরিকল্পিত অর্থনৈতিক বিকাশের মাধ্যমে উৎপাদনশক্তির ক্রমবৃদ্ধিসাধন এবং জনগণের জীবনযাত্রার বস্তুগত ও সংস্কৃতিগত মানের দৃঢ় উন্নতিসাধন, যাহাতে নাগরিকদের জন্য নিম্নলিখিত বিষয়সমূহ অর্জন নিশ্চিত করা যায়: ক. অন্ন, বস্ত্র, আশ্রয়, শিক্ষা ও চিকিৎসহ জীবনধারণের মৌলিক উপকরণের ব্যবস্থা; খ. কর্মের অধিকার, অর্থাৎ কর্মের গুণ ও পরিমাণ বিবেচনা করিয়া যুক্তিসঙ্গত মজুরির বিনিময়ে কর্মসংস্থানের নিশ্চয়তার অধিকার; গ. যুক্তিসঙ্গত বিশ্রাম, বিনোদন ও অবকাশের অধিকার; এবং ঘ. সামাজিক নিরাপত্তার অধিকার, অর্থাৎ বেকারত্ব, ব্যাধি বা পঙ্গুত্বজনিত কিংবা বৈধব্য, মাতাপিতৃহীনতা বা বার্ধক্যজনিত কিংবা অনুরূপ অন্যান্য পরিস্থিতিজনিত আয়ত্তাতীত কারণে অভাবগ্রস্ততার ক্ষেত্রে সরকারি সাহায্য লাভের অধিকার।” অথচ কতো হাজার মানুষ আশ্রয়হীন, মাথাগোঁজার ঠাঁই নেই, তাদের খাবার নেই, নেই চিকিৎসা উপকরণও। আর নিরাপত্তা? সেতো কারোরই নেই বলতে গেলে। ঠিক এরকমই একটি অবস্থায় যখন ঈদ এলো তখন আমাদের কারোরই কি আনন্দিত হবার মতো অবস্থা থাকে? তারপরও আমাদের চেষ্টা করে যেতে হবে আমাদের যতটুকু সামর্থ্য ততটুকু দিয়েই সবাইকে নিয়ে সুখী হবার। তবেই মহান আল্লাহর নির্দেশনায় নবী হযরত মুহম্মদ (সা)-এর প্রবর্তিত ঈদুল ফিতর সত্যিকারের ঈদ হয়ে উঠবে। ঈদের দিনের করণীয় ঈদের দিন সকালটা হয় সবচেয়ে মধুর সকাল। সকাল বলছি কেন? ভোর থেকেইতো শুরু হয়ে যায় নানা আয়োজন। মা-খালাদের মশলা পেষা, চাল পিষে গুঁড়ি করা, রুটি বানানো, গোশত রান্না করা, কত্তো কাজ! আর পুরুষদের ব্যস্ততা শুরু হয় চাঁদরাত থেকেই। যতো কেনাকাটাই হোক না কেন চাঁদরাতে কিছু কেনাকাটা করা চাই। লম্বা সেমাই, চিকন সেমাই, লাচ্ছা সেমাই, জর্দার জন্য হাজার পাওয়ার রং, পোলার চাল, গরম মশলা, কাজু বাদাম, কিশমিশ, চিনি এমন কতো বাজারই করতে হয়। কারওবা সব কেনা হয়েছে কিন্তু জুতো জোড়া বাকি, কারও বা টুপি কেনা হয় নাই, কারওবা মেহেদি কেনা বাকি। সবমিলে চরম ব্যস্ততার একটি রাত হলো চাঁদরাত। এতো ব্যস্ততার মাঝেও কারও মনে এতটুকু ক্লান্তি নেই। গভীর রাত পর্যন্ত খোলা থাকে শহরের বিপণিবিতানগুলো। সবার মুখে হাসি লেগে থাকে। মোবাইলে একটার পর একটা মেসেজ আসতে থাকে ‘ঈদ মুবারক’। এক মুহূর্তের জন্য সবাই ভুলে যায় অভাব, দুঃখ, শোক, অপ্রাপ্তির খেদ, শত্রুতা, ঝগড়া-বিবাদ সব। আর এ জন্যই এটা ঈদ। দিনটি সবার জন্যই খুশির। যারা দরিদ্র তাদের জন্য আর কিছু দাও না দাও একটা জিনিস দিতেই হবে; সেটা হলো ফিতরা। পরিবারের সদস্য গুনে এই ফিতরা দেয়া ওয়াজিব। আর ফিতরা দেয়ার কারণেও এই ঈদের নাম ঈদুল ফিতর। কী বিস্ময়ের ব্যাপার! নওরোজ ছিল বড়লোকদের, বিত্তবানদের সাথে দরিদ্রশ্রেণির পার্থক্যকে আরও বড় করে দেখানোর একটি দিন। আর ঈদ হচ্ছে সম্পূর্ণ বিপরীত। বিত্তবানরা নিজেরা আনন্দ করবে, অসহায় দরিদ্র মানুষও আনন্দ করবে। আর দরিদ্রদের দূরে ঠেলে দিতে পারবে না, বরং তাদের খুঁজে খুঁজে ফিতরা দেবে, পোশাক দেবে, সেমাই, দুধ, চিনি দেবে। সুবহানাল্লাহ। কতো মহান বিধান এই ইসলাম। কতো ভারসাম্যপূর্ণ এবং মানবিকতাপূর্ণ এই জীবনবিধান। ঈদের দিনটিতে কিছু করণীয় আছে। যেমন হাদিস শরিফে এসেছে, হজরত রাসূলুল্লাহ (সা) দুই ঈদের দিন গোসল করতেন। মুসনাদে বাযথযার, হাদিস : ৩৮৮০ গোসল করা, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ও পবিত্রতা অর্জন করা, সুগন্ধি ব্যবহার করা মোস্তাহাব। কেননা এ দিনে সব মানুষ নামাজ আদায়ের জন্য মিলিত হয়। ইবনে উমর (রা) ঈদুল ফিতরের দিন ঈদগাহে যাওয়ার পূর্বে গোসল করতেন। মুয়াত্তা ইমাম মালেক, হাদিস: ৬০৯ ঈদগাহে হেঁটে যাওয়া এবং এক পথ দিয়ে যাওয়া ও অন্য পথ দিয়ে ঘরে আসা সুন্নত। হজরত রাসূলুল্লাহ (সা) ঈদগাহে এক পথ দিয়ে গিয়ে অন্য পথ দিয়ে ঘরে ফিরে আসতেন। মুসনাদে বাযযার, হাদিস: ১১১৫ গোসলের পর সুন্দর ও সর্বোত্তম পোশাক পরে ঈদুল ফিতরের নামাজ আদায় করতে যেতে হবে, কিন্তু তার আগে মিষ্টি জাতীয় কিছু খাওয়া সুন্নত। আর ঈদুল আজহার দিন ঈদের নামাজের পূর্বে কিছু না খেয়ে নামাজ আদায়ের পর কোরবানির গোশত খাওয়া সুন্নত। হাদিস শরিফে এসেছে, হজরত বুরাইদা (রা) থেকে বর্ণিত, নবী করিম (সা) ঈদুল ফিতরের দিনে না খেয়ে বের হতেন না, আর ঈদুল আজহার দিনে ঈদের নামাজের পূর্বে খেতেন না। নামাজ থেকে ফিরে এসে কোরবানির গোশত খেতেন। মুসনাদে আহমাদ, হাদিস: ১৪২২ ঈদের নামাজে যেতে যেতে তাকবির পাঠ করতে হবে। “আল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ। ওয়াল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার ওয়ালিল্লাহিল হামদ।” রাসূল (সা) ঈদের নামাজের জন্য ঘর থেকে বের হয়ে এই তাকবির পড়তেন এবং ঈদের নামাজ শেষ হওয়া পর্যন্ত তাকবির পড়তেন। ঈদের দিন আরও একটি কাজ করা উত্তম, আর তা হলো ঈদের নামাজ আদায়ের পর নিজের জন্য ও জীবিত-মৃত সব মুসলমানদের জন্য দোয়া করা। -সুনানে তিরমিজি, হাদিস: ৫৩৯ কী চমৎকার বিধান তাই না? তুমি যখন আনন্দে থাকবে সেই আনন্দে অন্যদের ভুলে যাবে না। বরং মৃত মানুষকেও দোয়ার ভাগীদার করে তাদের আত্মার মাগফিরাত চাইবে। ঈদের দিনের প্রধান গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো ঈদুল ফিতরের নামাজ। যে আল্লাহ এতো নিয়ামত দিয়ে আমাদের পরিপূর্ণ করে দিয়েছেন, এতো আনন্দ দিয়েছেন, সবগুলো রোজা সঠিকভাবে পালনের তৌফিক দিয়েছেন তার প্রতি কৃতজ্ঞতা না জানালে আনন্দ পরিপূর্ণ হয়? পরীক্ষায় ভালো ফলাফল করলে কার কথা আমাদের সবার আগে মনে পড়ে? মা-বাবার কথা, তাই না? কতো কষ্ট করে, কতো স্বপ্ন নিয়ে তারা আমাদের এই ভালো ফলাফলের দিকে তাকিয়ে আছেন। বন্ধু-বান্ধবদের নিয়ে হইহুল্লোড় বেশিক্ষণ ভালো লাগে না। কখন বাসায় যাবো, কখন বাবা-মাকে খবরটা দেবো এই পেরেশানিই কাজ করে। অথবা যাদের মোবাইল আছে তারা কিন্তু প্রথম ফোনটা করে বাবা-মাকেই। এটাই নিয়ম। ঠিক তেমনি ঈদের মতো আনন্দের দিনটি আমাদের শুরু হয় সকল সৃষ্টির স্রষ্টা, সকল করুণার আধার, সবচেয়ে দয়ালু ও দয়াবান মহান আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপনের মাধ্যমে। এইসময় কি চোখে পানি আসার কথা না? আনন্দের আতিশয্যে মানুষ কেঁদে ফেলে। ঈদের দিনও যদি এই অনুভূতি কাজ করে দেখবে অনায়াসেই চোখ দিয়ে আনন্দাশ্রু বেরিয়ে আসবে। আর ঠিক তখন যদি মনে পড়ে এই আনন্দের দিনে অমুক নেই তমুক নেই; তখন কিন্তু তাদের জন্যই মন থেকে গভীর দোয়া চলে আসবে। তাই এবারের ঈদ যেন হয় আমাদের অনুভূতির ঈদ। এবারের ঈদ যেন হয় স্রষ্টার প্রতি কৃতজ্ঞতার ঈদ। এবারের ঈদ যেন হয় সবাইকে সাথে নিয়ে সুখী হবার ঈদ। তবেই পরিপূর্ণ হবে আমাদের ঈদের আনন্দ। একটা কথা কিন্তু বলা হয়নি; যদিও আমাদের দেশে এর খুব একটা প্রচলন নেই কিন্তু এটাও আল্লাহর রাসূলের নির্দেশ। আর তা হলো- মহিলাদেরকেও ঈদের মাঠে নিয়ে আসা। এমনকি রাসূল (সা) এও বলেছেন, ঋতুমতী মহিলারাও ঈদের মাঠে আসবেন। তারা নামাজ পড়বেন না কিন্তু খুতবা শুনবেন। সব বয়সের মহিলাদেরকেই ঈদগাহে আসার কথা বলেছেন রাসূল (সা)। যদি কারও ওড়না না থাকে সে যেন কারও থেকে ওড়না ধার নিয়ে হলেও ঈদগাহে আসে। তার মানে কতো গুরুত্ব দিয়েছেন বিষয়টাকে রাসূল (সা)। অতএব এই বিষয়টাকে আমাদেরও বিশেষভাবে গুরুত্ব দেয়া উচিত। হ
আরও পড়ুন...