আগুনের লাল শিখা
উপন্যাস আহমদ মতিউর রহমান এপ্রিল ২০২৩
আজ রবিবার। বাংলা ক্যালেন্ডারে ১০ পৌষ। আরাকানের সমুদ্র সৈকত ছেড়ে বাংলাদেশে আসার পর অনেক দিন সমুদ্র দেখা হয়নি জুলহাসের। সমুদ্রঘেরা আরাকানের স্মৃতি ভুলে থাকবেন বলে ভাসানচরে চলে এসেছেন জুলহাস। সাথে তার স্ত্রী ও মেয়ে নাফা আর ভাবী আমিনা ও তার শিশুসন্তান মুনা। আমিনা ২০১৮ সালের শুরুর দিকে মা হওয়ায় অপেক্ষায় ছিলেন। অপেক্ষায় ছিলেন তার কোল জুড়ে আসবে ফুটফুটে একটি শিশু, আর তার দিনগুলো হয়ে উঠবে ঝলমলে। কিন্তু কী থেকে কী হয়ে সব তছনছ হয়ে গেল। আগের বছর আগস্ট মাসে মিয়ানমার সেনাদের গুলি, নারকীয় নির্যাতন, গণহত্যা থেকে বাঁচার আশায় সবাই যখন বাংলাদেশে দলে দলে চলে এসেছে তখন আসেননি আমিনা ও জুলহাস। মাটি কামড়ে থাকতে চেয়েছিলেন রোহিঙ্গাদের প্রিয় জন্মভূমি আরাকানে, আকিয়াব শহরে। বর্মী ভাষায় এখন যার নাম রাখাইন। শুধু তাই নয় তাদের প্রিয় আকিয়াব শহরটার নামও তারা পাল্টে দিয়ে করেছে সিত্তুয়ে। কোথায় আকিয়াব আর কোথায় সিত্তুয়ে। তবু পড়ে ছিল আমিনারা। নামে কিবা আসে যায়? তাদের অন্তরে খোদাই করা আছে যে নাম, যে ধর্ম বিশ্বাস তা তো কেড়ে নিতে পারবে না হায়েনারা।
এসব ভাবতে গিয়ে মনটা বিষিয়ে ওঠে আমিনার। তার শ^শুর শাশুড়ি ও স্বামী নেজারত আলী নেজারতের রাখাইন বন্ধু ইয়ং মিন্টের গুলিতে নিজ বাড়িতে প্রাণ হারায়। এই ঘটনা আড়াল থেকে দেখেছেন আমিনা। তাদের দোষ ছিল বাড়ির দখল নিতে আসা মিন্টের সাঙ্গোপাঙ্গদের সাথে তর্কের পর সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েছিলেন তারা। কেন তারা নিজের বাড়ি ছাড়বেন? মিন্ট কোন কথা শুনতে রাজি ছিল না। বন্ধুর এমন ব্যবহারে প্রথমে অবাক হয়েছিলেন নেজারত। মেরে তাড়িয়ে দেন মিন্টের লোকদের। সে দিনই সন্ধ্যার আগ মুহূর্তে এসে হামলা করে মিন্টের আরো বড় দল। পেছনে ছিল সেনার দল। প্রথমে তারা বাড়ির সবগুলো ঘরে আগুন দেয়। লাল আগুনের লেলিহান শিখা মুহূর্তে সব পুড়ে ছাই করতে থাকে। নিকট থেকে মিন্ট গুলি করে হত্যা করে তিনজনকেই। আমিনার দেবর জুলহাস তখন বাড়িতে ছিল না। সে রেহাই পায়। এর পর জঙ্গলের পথ দিয়ে পালিয়ে ছিলেন কিশোরী থেকে যুবতী হয়ে ওঠা আমেনা। এছাড়া কিছু করার ছিল না তার। আকিয়াবের উত্তর পাড়ার আফতাবুল আলমের বড় মেয়ে আমিনা। বাবা শিক্ষক ছিলেন। সেই সুবাদে আমিনা কিছু লেখাপড়া করেছে। বর্মী ইস্কুলের খাতায় তার নাম ছিল হ্লাইং জিয়ং। বাড়িতে আমিনা বেগম। বর্মী ইস্কুলে মুসলমানি নাম চলে না। ক্লাস এইট পর্যন্ত পড়েছেন। আমিনা নিজে বাড়িতে একটা মক্তব চালাতেন। গোপনে। আরবি আর বাংলা পড়াতেন। বাবা মাঝে মাঝে দেখাশোনা করতেন। আরাকানি বইও পড়ত ছেলে মেয়ের দল। তারা ই¯কুলে তো আর আরবি বা বাংলা পড়তে পারত না তাই ছিল এ মক্তব। মক্তব মানে বাসার একটি ঘর। ইস্কুল ঘর ছিল না। পাটিতে বা চাটাইয়ে বসে রোহিঙ্গা ছেলে মেয়েরা পড়ত। ছিল না ব্ল্যাকবোর্ড। এগুলো থাকলেই বিপদ। ধরা পড়ার ভয় হার্মাদদের হাতে। তা হলে আর রক্ষা ছিল না।
মাস তিনেক আগে আমিনার বাবাকে ধরে নিয়ে গেছে রেঙ্গুনে। আর ফেরেননি বাবা। কেউ বলে মেরে ফেলেছে, কেউ বলে ইস্কুলে মাস্টারি করাচ্ছে। তবে আটকাবস্থায়। বাড়ি ফিরে আসার সুযোগ নেই। আমিনারা সত্যিটা জানে না।
অজান্তেই একটা দীর্ঘ নিঃস্বাস ছাড়ে আমিনা।
আরাকানে ফেরার আর সুযোগ নেই।
মা হেদায়েতুননেছার স্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছিল। আরেক বোন ছিল দূরের গ্রামে। বোন রোশনারার কোন খোঁজ ৪ বছরেও নিতে পারেননি। হয় আছে বাংলাদেশের কোন শিবিরে না হয় মিয়ানমার সেনা কিংবা বর্মী হায়েনারা মেরে ফেলেছে। বাংলাদেশে আসার আগে পনেরো দিন কাটিয়েছে তারা নোম্যান্স ল্যান্ডে। জীবন মৃত্যুর মাঝখানে। দুই পারে উদ্যত সঙ্গিন। বর্মী সেনারা চায় বিতারণ করতে বা গুলি করে হত্যা করতে। বাংলাদেশের সেনারা বলেছে আর কাউকে ঢুকতে দেয়া হবে না। আর না, ৯ লাখ লোক নেয়া হয়ে গেছে। আর একজনও না। নো নো, গো ব্যাক টু ইউর হোম। পঞ্চাশ জনের মত নারী পুরুষ শিশু। তারা কি করবে বিপুল অস্ত্র ভাণ্ডারসহ পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা জন্তুর মত বর্মী সেনাদের সাথে। ভেবে পাননা কেউই। লড়াই করে প্রাণ দেয়াই উচিত ছিল। কিন্তু আর্মস কই। অ্যামুনিশন কই। ট্রেনিং কে দেবে। লড়াই কি কথার কথা? পনের দিনের মাথায় প্রচণ্ড গোলাগুলির মধ্যে দয়া হয় বাংলাদেশ আর্মী আর সীমান্ত রক্ষী বাহিনীর। আমিনারা ঢুকতে পারেন টেকনাফে। বাবার কাছে এই টেকনাফের গল্প শুনেছেন আমিনা। এর পর হাঁফ ছেড়ে বাঁচা। না, আসলে হাঁফ ছেড়ে বাঁচতে পারেননি আমিনা। কত না প্রশ্নের মুখে পড়তে হয়েছে। বাংলাদেশের শরণার্থী ক্যাম্পে তার মেয়ে মুনার জন্ম হয়। তারা স্থান পায় হাসপাতাল কর্নারের একটি ঘরে। তার পর নানা প্রশ্ন শুনতে হয়েছে আমিনাকে। বহু নারীর সম্ভ্রমহানির ঘটনা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জেনে নিয়েছে অফিসাররা। এসব বলতে বলতে ঘৃণা আর লজ্জায় ক্লান্ত, কুঁকড়ে যাওয়ার মত অবস্থা ছিল আমিনার। তারই মাঝে মুনার জন্ম। শেষে দেবর জুলহাস বিয়ে করলো মংডু থেকে আসা একটি মেয়েকে। ওদের সঙ্গে থাকা কিশোরী মায়মুনা আরেকটু বড় হলে দেবরের জন্য আনবেন ভেবেছিলেন। তা আর হলো কই। শত কষ্টের মাঝেও জীবন থেমে থাকে না। ভিন্ন একটি শরণার্থী ক্যাম্পের কষ্টের জীবন। তারই মাঝে শিশু জন্ম, রোহিঙ্গা তরুণ তরুণীর বিয়ে আটকে থাকে না। নানা লোকে নানা কথা বলে। নানা অপমানজনক কথা থেকে বাঁচতে দেবরের সাথে ভাসানচরে চলে আসেন আমিনা।
২.
বার্মা বলি আর মিয়ানমারই বলি দেশটা তো ছোট নয়। প্রায় ছয় কোটি লোকের দেশ। কত শহর কত গ্রাম। বামার নামক বৌদ্ধ জনগোষ্ঠীর লোক বেশি, তাই তার থেকে নাম হয়েছে বার্মা। ব্রহ্মদেশও বার্মার আরেক নাম। এখানকারই একটা প্রদেশ আরাকান। আরাকান এক সময় স্বাধীন মুসলিম রাজ্য ছিল। আরাকানের রাজসভায় বাংলা ভাষার খুবই প্রভাব ছিল। আরাকান রাজসভায় যে সকল কবি বিশেষ পৃষ্ঠপোষকতা অর্জন করেছিলেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম হলেন- মহাকবি আলাওল, দৌলত কাজী, মাগন ঠাকুর। মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে আরাকান রাজসভার নাম গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশের ভৌগোলিক সীমানার বাইরে বর্তমান মিয়ানমার তথা বার্মার অন্তর্ভুক্ত আরাকান রাজ্যে বাংলা কাব্য তথা সাহিত্য চর্চার বিষয়টি ইতিহাসের একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা। বাংলা সাহিত্যে আরাকানকে ‘রোসাঙ্গ’ বা ‘ রোসাং’ নামে উল্লেখ করা হয়। ‘আইন-ই-আকবরী’তে এ অঞ্চলটিকে ‘আখরঙ’ নামে অভিহিত করা হয়েছে। খ্রিস্টীয় আট-নয় শতকে আরাকানরাজ মহতৈং চন্দয় (৭৮৮-৮১০) এর রাজত্বকালে এ অঞ্চলে ইসলাম প্রচার শুরু হয়। সমসাময়িককালে চট্টগ্রামেও ইসলামের ব্যাপক প্রসার ঘটতে থাকে। মূলত সে কারণেই এই দুই অঞ্চলের লোকজনের মধ্যে ঘনিষ্ঠতা বাড়তে থাকে। চট্টগ্রাম ও আরাকানের নৈকট্য এবং একই রাজ্যভুক্ত থাকায় বৃহত্তর বঙ্গদেশ থেকে তার একটা স্বাতন্ত্র্য ছিল। সেই সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য, চাকরি ও রাজনীতির সূত্রে রোসাঙ্গে বসবাসরত বাঙালিদের একটি পৃথক প্রবাসী সমাজ গড়ে উঠতে থাকে। ফলে স্বাভাবিকভাবেই আরাকান রাজ্যে বাংলা ভাষায় সাহিত্য চর্চার একটা পরিবেশ গড়ে উঠেছিল। শরৎচন্দ্রের ‘শ্রীকান্ত’ উপন্যাসে এই প্রবাসী বাঙালি সমাজের পরিচয় পাওয়া যায়। তারা ব্যবসার জন্য গেছে আবার ফিরেও এসেছে। তারা আরাকানি নয়। আরাকানের রাজারা বৌদ্ধধর্মাবলম্বী হলেও তারা মুসলমানদের ব্যাপারে ছিলেন যথেষ্ট উদার। যোগ্যতার বিচারে বাঙালি মুসলমানগণ আরাকান রাজাদের শাসনকার্যে বিভিন্নভাবে সংশ্লিষ্ট থাকতেন। রোসাঙ্গের ইতিহাসে দেখা যায় এ রাজ্যের রাজাদের প্রধানমন্ত্রী, অমাত্য, সমরসচিব, কাজী বা বিচারক প্রভৃতি উচ্চপদে বিভিন্ন সময়ে মুসলমানরাই দায়িত্ব পালন করেছেন। রাজকার্যে মুসলমানদের এই প্রভাব সতেরো শতক পর্যন্ত পরিলক্ষিত হয়। আরাকানের রাজাদের মধ্যে মেঙৎ- চৌ-মৌন, থিরী-থু-ধুম্মা (শ্রী সুধর্মা), নরপদিগ্যি, সান্দ থুম্মা (চন্দ সুধর্মা), থদো মিন্তার (সাদ উমাদার) প্রমুখ রাজাগণের সময়কালে মুসলমানগণ রাজকার্যে সম্পৃক্ত ছিলেন। আরাকানের রাজারা পঞ্চদশ শতাব্দীতে যখন ক্ষমতা হারায়, তাদের সিংহাসন উদ্ধার করে দিয়েছে বাংলার রাজারা। এটা ১৪৩০ সনের কথা। এরপর থেকে আরাকান রাজসভায় বাংলাই ছিল বলা যেতে পারে এক নম্বর রাজ ভাষা। রোসাং থেকেই রোহিঙ্গা নামটি এসেছে। এত কিছুর পরও দেশটির কর্তৃপক্ষ আরাকানের রোহিঙ্গাদের সব সময় সন্দেহের চোখে দেখে এসেছে। তাদের বলা হয় তারা বাঙালি। আরাকানের মানুষের ভাষা আরাকানি, তবে তাদের সঙ্গে বাংলার একটি ঐতিহাসিক সংযোগ রয়েছে। ঠিক বাঙালি বলতে যা বুঝায় তা তারা নয়, তারা আরাকানি। তাদের পূর্বপুরুষরা বহু আগে থেকেই আরাকানে ছিল। তাদের ভাষা আরাকানি, চট্টগ্রামের ভাষার সাথে মিল আছে বটে তবে সেটা পৃথক খানিকটা। অধিকাংশ রোহিঙ্গা ইসলাম ধর্মের অনুসারী, যদিও কিছু সংখ্যক হিন্দু ধর্মের অনুসারীও রয়েছে। রোহিঙ্গারা আইনপ্রণেতা ও সংসদ সদস্য হিসেবে বার্মার সংসদে প্রতিনিধিত্ব করেছেন। পূর্বে যদিও বার্মা রোহিঙ্গাদের গ্রহণ করত, কিন্তু হঠাৎই বার্মার সরকারি মনোভাব বদলে যায়।
শত শত বছর ধরে থেকেও তারা ওখানকার নাগরিক হতে পারলো না। সংখ্যায় কতোই হবে রোহিঙ্গারা। দশ বার লাখ। আরো কতো জাতিগোষ্ঠী আছে মিয়ানমারে। কাচিন, হান, চিন ইত্যাদি। কই তাদের তো তারা তাড়িয়ে দিচ্ছে না। শান্তিতেই তো ছিল তারা আরাকানে। এর প্রতিটি অঙ্গে রোহিঙ্গাদের নাম মিশে আছে। এই লোকগুলো একটা দেশের জন্য বেশি হয়ে গেল? ভেবে পান না আমিনা। তারা পড়ে থাকা ভূমিকে তৃণভূমিতে পরিণত করেছে, নিচু জমিতে ধান গম আবাদ করে ফসলের মাঠে পরিণত করেছে। এ ছাড়া সমুদ্রে মাছ ধরে জীবন চালিয়ে আসছিল। হায় সে দিনগুলো কোথায় হারিয়ে গেল। বাবার কাছে ছোট বয়সে আমিনা শুনেছে এসব কথা। শুনেছে তাদের আরাকানের ইতিহাস বেশ সমৃদ্ধ। ২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের সামরিক অভিযানে দেশটির রাখাইন রাজ্যে হাজার হাজার রোহিঙ্গাকে হত্যার ঘটনা ঘটে। সে সময় সেনাবাহিনীর বর্বর নির্যাতনের মুখে প্রাণ বাঁচাতে আট লাখের বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। মিয়ানমারে আবার সামরিক অভ্যুত্থানের পর এ সংখ্যা আরও বেড়েছে। বর্তমানে উখিয়া ও টেকনাফের ৩৪টি আশ্রয়শিবিরে নিবন্ধিত রোহিঙ্গার সংখ্যা সাড়ে ১১ লাখ।
৩.
: ভাবী তোমারে একখান কতা কব? জুলহাস কোত্থেকে উদয় হয়।
: কি কস না। আবার রগর করের। ঝগড়া করছস নি রেহানার লাই। দেবর হলে কি হবে জুলহাসকে আমিনা নিজের ভাইয়ের মতই দেখেন।
: না গো ভাউজ। ওইডা শুধরাত ন। ওডারে নিয়া ন ভাবি। মাইয়াডার কতা ভাবি। নাফা। নাফা খাতুন। ছোট্ট ছয় মাসের শিশুর এত বড় নাম। হাসেন আমিনা।
: কি কবি কস না বাই।
: ভাসানচর আইছি হাউস কইরা। হাউস আর নাই ভাবীজান। ইহানে বন্দিজীবন ভালা না লাগের। যাউম গিয়া টেকনাফত। হিয়ানতন মাললেশিয়া। জাহাজত গরি। একবারে অনেকগুলো কথা বলে থামেন জুলহাস।
: দেখ বাই। মাতা গরম করিচ্চা। দেউতে দেউতে পাঁচটা বছ্ছ্র গেইল গিয়া। কি অইব আঁরা ন জানিয়ের। ইহান আডক থাইলিও দুখান ভাত ত জোডে। এরুইম্মা ভাবনা ছাড়ান দে। রেহানা যাবি তোর লগে?
: ওর কতা কইও না ভাবী। এক অফিসারের লগে ফিসফাস করে। মানু খারাপ কয়। কোন আকতা কইবে কে জানে। অরে নিতাম নায়। নাফারে নিয়া যামু। বেবাক ঠিক। টিয়াও বাও কইজ্জি। শাহপরির দ্বীপতযাতি পাইরলে নায়ে বাদাম দি ভাসান দিয়াম। মনে হচ্ছে এর পর তার চোখে ভাসছে ঝলমলে মালয়েশিয়া। চেহারায় সেই জৌলুস।
: আর কিডা যাবি?
: কত মানু? কয়ডার নাম গইউম।
: আঁর ডর লাগের বাই। হুনছি সাওরে ভাসন লাগে। মইরা যায় কত মানু? মুনা মুনা কই গেলি মারে? মুনার খোঁজ করে আমিনা।
মুনা আরেকটা মেয়ের সাথে ওদের রুমের বাইরে কুত কুত খেলছে। চার বছর। জুলহাস সুন্দর একটা ফ্রক কিনে দিয়েছেন। সেটা গায়ে। আর্মিরা দেয়, বিভিন্ন সংস্থা দিয়েছে। এমিনেহ এরদোগান আর এঞ্জেলিনা জোলি মেম সাহেবের দেয়া জামা ছোট হয়ে গেছে। জোলি সিনেমার নায়িকা। দেখতে পরীর মত। এমিনেহ তুরস্ক দেশের রানী। তারা দেখতে খুব সুন্দর। আরো সুন্দর তাদের মন। ওরা খুব আদর করতেন মুনাকে। মুনার তখন ছয় মাস বয়স। কোলে নিয়ে আদর করেছেন দু’ জনই।
: মুনা মুনা কন্ডে গেলি মা। মুনার খোঁজে এবর বের হন আমিনা। দেবরের কথাকে মোটেই গুরুত্ব দিতে চাইছেন না। এটা বুঝতে চান তিনি। জুলহাস বিরস বদনে ফিরে যায়। বলে যায়-
: আমি আবার কথা কমুনে বাবী। ভাইব কিন্তু।
কিছু দিন কেটে যায়। ভাসানচরে শীত পড়ে এসেছে। একটা লাল সোয়েটার পরে আছে মুনা। ওদের কোয়ার্টারের এক চিলতে বারান্দায় বসে রোদ পোহাচ্ছে। আমিনা মেয়ের দিকে তাকায়। দেবরের কথা ভাবতে বসে। আসলে জুলহাসের বউ রেহানা দেখতে তেমন সুন্দরী না হলেও অতো খারাপও না। তবে গোড়া থেকেই ওর প্রতি আমিনার মনটা বিষিয়ে আছে। জুলহাস সেটা বোঝে। ভাবীকে যুক্তি দিয়ে বোঝাতে আরো কত কথা বলেছেন। জুলহাস আরো বুঝাতে চান বাংলাদেশ আর তাদের জন্য নিরাপদ আবাস ভূমি নয়। প্রতিদিন টেকনাফ আর উখিয়া থেকে খারাপ খবর আসে। খুনোখুনি হচ্ছে সেখানে। মানুষ মারা যাচ্ছে। রোহিঙ্গাদের হাতে রোহিঙ্গা। যা এক বছর আগেও অকল্পনীয় ছিল। বাস্তব বড় কঠিন। জুলহাসের কথা, এখান থেকে বের হতে পারলে মন্দ হয় না। কত লোকইতো গেছে। মালয়েশিয়া। থাইল্যান্ড। ইন্দোনেশিয়া। আকিয়াবে, নো ম্যান্স ল্যান্ডে কঠিন মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে এসেছে তারা। এই জীবনের আর দাম কি? পৃথিবী বোধহয় রোহিঙ্গার্দে বেঁচে থাকা দেখতে চায় না। চাইলে পাঁচ বছরে কিছু তো হতো। এখান থেকে বের হতে গেলে সাগরে মৃত্যু হবে এই তো। ভাবী আমিনাকে এটাই বুঝাতে চান জুলহাস। পৃথিবীতে স্ত্রী সন্তান বাদে এই ভাবী ও তার মেয়ে মুনা ছাড়া আর কে আছে তার?
৪.
২০১৯ সালের মার্চ মাস থেকে ট্রলারে করে যাওয়া বেড়েছে। ২০২০ সালে ঘটে কিছু ভয়ঙ্কর ঘটনা। এপ্রিল ২০২০। সাগরপথে মালয়েশিয়া যেতে ব্যর্থ হয়ে টেকনাফে ফেরত আসা ৩৯৬ জন রোহিঙ্গাকে উদ্ধার করে কোস্টগার্ড। প্রায় দুই মাস ধরে সাগরে ভাসমান থাকায় অনেকেই অসুস্থ হয়ে পড়ে। করোনাভাইরাস আতঙ্কের মধ্যেই কক্সবাজারের টেকনাফ উপকূলে আসা ৩৯৬ জন রোহিঙ্গাকে কোয়ারেন্টিনে পাঠানো হয়। এই ঘটনায় সাগরে অভুক্ত থেকে ৩২ রোহিঙ্গার মৃত্যু হয়। প্রায় দুই মাস আগে ৪৮২ রোহিঙ্গা নারী পুরুষ উন্নত জীবন ও বিয়ের আশায় মালয়েশিয়া রওনা হয়েছিল। কিন্তু মালয়েশিয়ার নৌবাহিনী তাদের সেখানে ভিড়তে না দেওয়ায় তারা আবার টেকনাফ উপকূলে ফিরে আসে। উদ্ধার রোহিঙ্গারা সবাই উখিয়া ও টেকনাফের বিভিন্ন শিবিরের বাসিন্দা। ২০১৫ সালে থাইল্যান্ডের জঙ্গলে গণকবর আবিষ্কৃত হওয়ার পর বিষয়টি বিশ্বজুড়ে ব্যাপকভাবে আলোচিত হয়। দুই বছর যাওয়া প্রায় বন্ধ থাকে। ২০১৮ সালে এই অঞ্চল থেকে থেমে থেমে শুরু হলেও করোনাভাইরাসের প্রেক্ষাপটে কোনো দেশ রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিতে রাজি হয়নি। উদ্ধার রোহিঙ্গারা জানিয়েছেন, প্রথমে মালয়েশিয়ার নৌবাহিনী, এরপর থাইল্যান্ড ও মিয়ানমারের নৌবাহিনীর বাধার মুখে তাঁরা বাংলাদেশের উপকূলে ফিরে আসতে বাধ্য হন। রোহিঙ্গা লিয়াকত আলী উখিয়ার থাইংখালী শিবিরের বাসিন্দা। ভালো চাকরির আশায় ট্রলারে মালয়েশিয়া রওনা দেন। টেকনাফের জেটিঘাটে বিলাপ করতে করতে লিয়াকত বলেন, ট্রলারে চার দিন অভুক্ত থেকেই তাঁর ছোট ভাই মোহাম্মদ নছিম মারা গেছে। জানাজা ছাড়াই ভাইয়ের লাশ সাগরে ভাসিয়ে দিতে হয়েছে। কি ভয়ঙ্কর কথা। জুলহাস ভাবেন। অভুক্ত থেকে ট্রলারে মারা গেছে জানে আলমের চার বছরের মেয়ে। সাগরেই হারিয়ে গেল আদরের মেয়ে। শোকে পাথর হয়ে গেছেন আলম।
যাওয়ার ইতিহাসটা এরকম। মালয়েশিয়ায় ভালো চাকরির প্রলোভন দেওয়া হয় পুরুষদের। তরুণীদের দেওয়া হয় ভালো পাত্রের সঙ্গে বিয়ের প্রতিশ্রুতি। তবে সব সময় পৌঁছানো সহজ হয় না। শিবিরের জীবন বিষিয়ে ওঠায় শিবির থেকে পালিয়ে রোহিঙ্গাদের সমুদ্রপথে মালয়েশিয়া যাওয়ার চেষ্টা বাড়ছে। এর মধ্যে ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে সেন্ট মার্টিনে সাগরে ১৩৮ জন রোহিঙ্গা বোঝাই আরেকটি ট্রলার ডুবির ঘটনা ঘটে। এতে ১৯ রোহিঙ্গার মৃত্যু হয়। এ সময় কোস্টগার্ড সদস্যরা ৭৩ রোহিঙ্গাকে জীবিত উদ্ধার করলেও ৪৬ জন নিখোঁজ ছিল। ১ মার্চ থেকে দু মাসে সমুদ্রপথে মালয়েশিয়া যাওয়ার চেষ্টাকালে চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, মহেশখালী, উখিয়া, রামু, টেকনাফ ও সেন্টমার্টিন থেকে ৪৯ দফায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা ১ হাজার ৫৫১ জন রোহিঙ্গা নারী, শিশু ও পুরুষকে উদ্ধার করে। জুলহাস এসব তথ্য সংগ্রহ করেছেন আর আতঙ্কিত হয়েছেন। টেকনাফেও আছে আতঙ্ক।
২৭ ডিসেম্বর ২০২২। আরো একটি ঘটনার খবর জানতে পারে জুলহাস। ইঞ্জিন নষ্ট হয়ে প্রায় এক মাস সাগরে ভাসার পর রোহিঙ্গাবাহী নৌকা ইন্দোনেশিয়ার উপকূলে পৌঁছেছিল। ওই নৌকায় ১৮০ জনের বেশি রোহিঙ্গা ছিল। তাদের মধ্যে কয়েকজনকে আচেহ প্রদেশের তীরে নামতে দেওয়া হয়। দুই দিনে আচেহ প্রদেশের তীরে রোহিঙ্গাদের নিয়ে পৌঁছানো দ্বিতীয় নৌকা ছিল এটি। কাঠের তৈরি মাছ ধরার নৌকাটি রোহিঙ্গা নারী, পুরুষ ও শিশুদের নিয়ে ২৫ নভেম্বর বাংলাদেশ উপকূল থেকে রওনা করে। ছয় দিন পর এর ইঞ্জিন নষ্ট হয়ে যায়। নৌকাটি তখন ভাসতে ভাসতে মালয়েশিয়ার জলসীমা থেকে ইন্দোনেশিয়ার উত্তরাঞ্চলীয় উপকূলে পৌঁছায়। এরপর এটি নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের দক্ষিণে ভারতীয় জলসীমায় ঢুকে পড়ে। মানবাধিকারকর্মী ও পরিবারের সদস্যরা হঠাৎ হঠাৎ ওই নৌকার যাত্রীদের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করতে পারছিলেন না। তাঁরা জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থার সঙ্গে যৌথভাবে ভারতীয় ও ইন্দোনেশীয় কর্তৃপক্ষের প্রতি সহায়তার আবেদন জানান। নৌকার যাত্রীরা বলেছেন, তাঁরা না খেয়ে আছেন এবং অনেকে মারা গেছেন। ভারতীয় নৌবাহিনী তখন তাদের কিছু পরিমাণে খাবার ও পানি সরবরাহ করে এবং নৌকাটিকে ইন্দোনেশিয়ায় ফেরত পাঠায়। ইন্দোনেশিয়ার উপকূলে নৌকাটি আরও ছয় দিন ধরে ভাসার পর শেষ পর্যন্ত এটিকে তীরে ভিড়তে দেওয়া হয়। তারা যেখান থেকে যাত্রা শুরু করেছিল, সেখান থেকে প্রায় ১২ শ মাইল দূরে নৌকাটি ভিড়েছে। এর আগে ৫৭ জন আরোহী নিয়ে আরও একটি কাঠের নৌকা ইঞ্জিন নষ্ট হয়ে যাওয়া অবস্থায় আচেহ উপকূলে নোঙর করে। ওই নৌকাও এক মাস ধরে সাগরে ভেসেছে। জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা আশঙ্কা আরও একটি নৌকায় থাকা ১৮০ জন শরণার্থী সম্ভবত মারা গেছেন। ওই নৌকার আরোহীদের স্বজনেরা বলেছেন, নৌকাটিতে ফাটল ধরেছিল বলে তাঁরা জানতে পেরেছেন। দুই মাসে এসব গন্তব্যের উদ্দেশে এমন পাঁচটি নৌকা যাত্রা করে। এ ভাবেই প্রতি বছরই অনেক রোহিঙ্গা ঝুঁকি নিয়ে সাগরপথে মিয়ানমার থেকে ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়ায় পালিয়ে যায়। কয়েকটি ট্রলার ভিড়তে পেরেছে মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়ায়। এই খবরে আশা জাগে জুলহাসের মনেও।
৫.
২২ মে ২০২১। নতুন জীবনের স্বপ্ন নিয়ে ভাসানচরের উদ্দেশে যাত্রা করে আমিনারা। বঙ্গোপসাগরের দুর্গম দ্বীপ ভাসানচরে বাংলাদেশ সরকার যে বিশাল শরণার্থী শিবির নির্মাণ করেছে। ভাসানচর দ্বীপটি কতটা মানববসতি স্থাপনের উপযোগী তা নিয়ে অনেকে প্রশ্ন তুলেছেন। বাংলাদেশ সরকার যখন কক্সবাজারের শিবিরগুলো থেকে এক লাখ রোহিঙ্গাকে ভাসানচরে নিয়ে আসার জন্য পরিকল্পনা নিয়েছিল, তখন তার বিরোধিতা করেছিল জাতিসংঘ এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক ত্রাণ সংস্থা। তাদের মূল আপত্তি এই দ্বীপ কতটা মানব বসতির উপযোগী তা নিয়ে। কিন্তু তারপরও সরকার ২০২১ সালের মে মাস হতে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ভাসানচরে স্থানান্তর শুরু করে। তত্ত্বাবধান করেছে বাংলাদেশ নৌবাহিনী। ভাসানচরে রোহিঙ্গারা এখন ভালো নেই। সেখানে পাকা ঘর, কাজের সুযোগ, ভালো পরিবেশ পাবে। লোকের গঞ্জনা থাকবে না। এ জন্যই তো আসা। কিন্তু সুখ সইলো না। এ যেন আরেক বন্দিখানা। কোথাও শান্তি নেই। না আরাকানে, না টেকনাফে ভাসানচরে তো নয়ই। তাদের একই কথা সরকার কথা রাখেনি, আমরা ফিরে যেতে চাই। ক্যাম্পের জীবনকে অনেকে তুলনা করেছেন পুরো পরিবার নিয়ে জেলখানায় থাকার মতো অভিজ্ঞতা বলে। ভাসানচরে প্রথম যাদের নিয়ে আসা হয়েছিল, তাদের একজন দিলারা। এই রোহিঙ্গা তরুণী তার পরিবারের আরও দুই সদস্যের সঙ্গে সমুদ্রপথে অবৈধভাবে মালয়েশিয়া যাওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু প্রায় তিনশো রোহিঙ্গাকে বহনকারী নৌকাটি মালয়েশিয়ায় পৌঁছাতে ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসে। বঙ্গোপসাগর থেকে মে মাসে এই শরণার্থী বোঝাই নৌকাটি উদ্ধারের পর বাংলাদেশের কর্তৃপক্ষ তাদের কোয়ারেন্টিনে রাখার কথা বলে নিয়ে যায় ভাসানচরে। কিন্তু দিলারার এখন মনে হচ্ছে তাকে যেন এখানে সারাজীবনের মত নির্বাসন দেয়া হয়েছে। দিলারা আগে থাকতেন কক্সবাজারের বালুখালি ক্যাম্পে। তার বাবা-মা এবং পরিবারের বাকি সদস্যরা সেখানেই আছেন। ক্যাম্পের ভেতর ছোটখাটো দোকান দিয়েছে অনেক রোহিঙ্গা শরণার্থী। হালিমা ক্যাম্পের বাইরে যেতে পারেন না, নিষেধ আছে। সাগর তীরে যেতে পারেন না। পুলিশ পাহারা দেয়। এখানে কিছু মানুষ আছে। ওদের গলায় কার্ড ঝোলানো। যাদের কার্ড আছে তারা যেখানে খুশি যেতে পারে। রোহিঙ্গাদের কার্ড নাই, তারা পারে না।
৬.
১৩ রোহিঙ্গার মৃত্যুর ঘটনায় গ্রেফতার
এটা একটা পত্রিকার খবরের শিরোনাম। খবরে বলা হচ্ছে- ১৩ রোহিঙ্গার মৃত্যুর ঘটনায় মানবপাচার চক্রের সন্দেহভাজন ১২ সদস্যকে গ্রেফতারের কথা জানিয়েছে মিয়ানমার সেনাবাহিনী। মঙ্গলবার এক বিবৃতিতে সেনাবাহিনী জানায়, ৯ ডিসেম্বর বঙ্গোপসাগরের একটি এলাকায় অভিযান চালিয়ে তাদের গ্রেফতার করে পুলিশ। এ সময় একটি ট্রলার জব্দ করা হয়। গত ৫ ডিসেম্বর ওই ১৩ রোহিঙ্গার মরদেহ হ্লেগু শহরের কাছে সমুদ্রে ভাসমান অবস্থায় উদ্ধার করা হয়। তাদের মৃত্যুর কোনো কারণ জানায়নি মিয়ানমার সেনাবাহিনী। তবে স্থানীয় সংবাদমাধ্যম ও রোহিঙ্গাদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, তাদের একটি ট্রলারে করে মালয়েশিয়ায় পাচার করা হচ্ছিল।
উদ্ধার করা লাশের মাঝে জুলহাস নিজেকে খুঁজে পায়। আছে রেহানা ও নাফা। ১৩ একটি সংখ্যা। তারাও তাদের মতোই একটি সংখ্যা। কোন মানব মানবী নয় কেবলি সংখ্যা।
স্বপ্ন ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে। কল্পনার জগৎ থেকে বাস্তবে ফেরেন জুলহাস।
আরো কয়েক মাস কেটে যায়। এরই মাঝে বিষয়টা ভুলেও যান জুলহাস। আমিনা ভাবেন, যাক ভাইটার সুমতি হয়েছে। রেহানাও গৃহকর্মে মন দিয়েছে। রেহানা মুনার সঙ্গে খেলে, দুষ্টুমি করে। একদিন রেহানাকে প্রশ্ন করে আমিনা-
: তুমার মনত এই কতা কিম্বায় আইয়ের? মোগর ফালাই যাবি গই।
: না বুজি। আই যাইতাম ন গরি। আমনের কথা ন হোনের উনি।
: চুপ গর। তুয়ারে আই চিনি। বেকগিন খালি নিজর খতা ভাবস। আঁরার জন্যি তুয়ার ভাবনা নাই। তুরা স্বার্থপর। স্বার্থপর কথাটার উপর জোর দেন আমিনা।
এবার কোন কথা বলে না রেহানা। মালয়েশিয়া যাবার খোয়াব যে সে দেখে না তাতো নয়। তার স্বামী তাকে এসব খোয়াব দেখায়। এর মধ্যে হঠাৎ একদিন নিরুদ্দেশ হয়ে যায় রেহানা। দৌড়ে আসে জুলহাস আমিনার কাছে।
: ভাবী, রেহানাকে টোহাই ন ফাই। নাফা খালি কান্দন গইরে।
: কি কস? হেতি কই জাইয়ের?
রেহানার চাল চলন ভালো লাগে না। একটা খারাপ ইঙ্গিত দেন আমিনা।
জুলহাস মাথা চুলকায়। তার পর বের হয়ে যায়। পাগলের মত লাগছে তার কাছে।
দু দিন পরে ফিরে আসে রেহানা। কিছুই বলে না কোথায় ছিল কি খেয়েছে। লোকলজ্জার ভয়ে জুলহাসও কিছু বলে না। আমিনাতো কথা বলাই বন্ধ করে দিয়েছে। ঘটনাটা সাধারণই। রেহানা তার বাবার খবর জানতে মংডু থেকে আসা একটি পরিবারের কোয়ার্টারে গিয়েছিল। সেটা ভাসানচরের আরেক প্রান্তে। না, তারা তার বাবাকে চেনে ভালো করে, কিন্তু তার কোন খবর জানে না। জানে এটুকু মংডুর যত মুসলমানের দোকানপাট বাড়ি ঘর ছিল তা দখল করে নিয়েছে রাখাইনরা। ফিরে আসার পথে রোহিঙ্গা দলের বিক্ষোভের মধ্যে পড়ে যায় রেহানা। নিরাপত্তা বাহিনী সাথে সাথে কার্ফু দিয়ে ধরপাকড় শুরু করে। আরো কুড়ি জন মেয়ের সাথে রেহানা দুরাত আটক ছিল একটি ক্যাম্পে। আজ সকালেই ছাড়া পেয়ে ফিরে এসেছে।
এ পাড়ারই মনসুরা সাক্ষ্য দেয়,
: রেহানা যা বলতিছে সব হাছা। আঁইও আডক আছিলাম ক্যাম্পত।
: কও কি? আমরা ত কিছু ন জানিয়ের। আমিনা অবাক হয়ে বলেন। সব শুনে গম্ভীর হয়ে যান। এখন আর অবিশ^াস হয় না এসব কথা। জুলহাসেরও বিশ^াস না করে উপায় নেই। নাফা তার মাকে ফিরে পেয়ে স্বাভাবিক হয়েছে। তার মুখে হাসি ফুটেছে। সে আর কি চায়? শিশুর হাসির চেয়ে সেরা কিছু আছে কি? এমন ভাবনা জাগে তার মনে। রেহানার দু দিনের হাজতবাস তার কাছে তেমন কিছু মনে হয় না। তিনি এখন নিজের কথাই ভাবছেন। এর মাঝে ঘটেছিল আরেকটি ঘটনা। তত্ত্বতালাশ করতে জুলহাস যেতে চেয়েছিলেন টেকনাফ। কিন্তু ধরা পড়ে যান। তার এক মাসের সাজা হয়েছে পালানোর চেষ্টা করার অভিযোগে। সে কারণে রেহানাকে খুঁজতেও তিনিও বের হতে পারেননি। সাজা মানে ঘর বন্দী থাকা। বাইরে পাহারায় ছিল নৌবাহিনীর লোক। জুলহাস নিজ ইচ্ছায় এসেছেন ভাসানচর। তার পালানোর কাহিনী অদ্ভুত শোনায় বটে। আসলে জুলহাস মালয়েশিয়া পাড়ি দেয়ার জন্যই মেয়ে আর বৌকে নিয়ে টেকনাফে ফিরে যেতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ভাগ্যের ফেরে ধরা পড়ে যান। আর কারাবন্দীর শাস্তি মাথায় জোটে। রেহনাকে কোন শাস্তি দেয়া হয়নি কোলে সন্তান আছে বলে। আর সে অকপটে স্বীকারও করেছে সে পালাতে চায়নি। স্বামী বাধ্য করেছে। জুলহাসের উপর দায় চাপানো হলেও তিনি এতে রাগ করেন নি। বরং বুদ্ধির তারিফ করেছেন। মেয়ের দিকে তাকিয়ে তার সাধারণ ক্ষমা।
৭.
আবার সব স্বাভাবিক হয়ে আসে। রেহানার বিষয় নিয়ে এত ভাবার সময় নেই ভাসানচরবাসীর। নিরাপত্তা বাহিনী লাগে না, রোহিঙ্গাদের মধ্যেই দুষ্ট চরিত্রের লোকের অভাব নেই। তবে ভাসানচরে এখনো কেই কাউকে খুন করেনি। অন্যান্য অপরাধ হচ্ছে না বলা ঠিক হবে না। আবার মুনাদের পরিবারের সাথে মিলিত হয় রেহানা। পাশাপাশি দেড় রুমের দুটো হাউজ। তবু যাতায়াত কম রেহানার। সে জানে আমিনা তাকে সহ্য করতে পারেন না। আজ আর কিছু বলেন না আমিনা। ভুরু কুঁচকালেও দেবরের বউকে তো আর ফেলে দেয়া যায় না? মুনাকে খুব আদর করে রেহানা। নিজের মেয়ে নাফার চেয়ে আলাদা করে দেখে এমনটা মনে হয় না আমিনার।
মুনাকে পড়াতে বসেন আমিনা। গণনা শেখান। বাংলা ও আরবি অক্ষর শেখান। রোহিঙ্গা বা আরাকানি ভাষার বই থেকে কবিতা পড়ে শোনায়। গান শেখান। গানে আরাকানি শব্দ বেশ ভালো লাগে মুনার। মাকে বলে-
: আমরা আরাকান কবে যাবো মা।
: যাইম মা। সবুর কর এট্টু। কোনদিনই হয়তো আরাকানে ফেরা হবে না। আমিনা তবু মেয়েকে আশ^াস দেন। বাবা বলতেন আশায় বসতি।
: মা, বাবা দেখতে কেমন ছিল? একটু বল না? মুনাও নাছোড়বান্দা।
: তোরে না কইজ্জি ইরুইম্মা জিগান জিগাইবি না? এসব প্রশ্ন করবি না। ধমকের সুরে মেয়েকে বলেন আমিনা। এতে কাজ হয়। মুনা এবার থামে। মুনা এখন ভালো বাংলা বলতে পারে।
আমিনার মুনাকে নিয়ে ভাবনার শেষ নেই। সে বড় হচ্ছে। স্কুলে দেয়া দরকার। ভাসানচরে স্কুল এখনো চালু হয়নি। কবে হবে কেউ কিছু বলতে পারে না। শুধু বলেন হবে। হবে।
তাই মুনাকে বাসায় অক্ষরজ্ঞান আর নামতা যোগ বিয়োগ গুণ আর ভাগ শেখান। নাফা অবাক তাকিয়ে থাকে। এগুলো শেখার বয়স হয়নি তার।
ছাত্রছাত্রী এসেছে আরো দু’জন। তানিয়া ও আকবর। পাশের একটি রোহিঙ্গা কোয়ার্টারে থাকে। তিন ছাত্রছাত্রী নিয়ে আবার স্কুল খুলেছেন আমিনা। মুনাকে নিয়ে চারজন। এক ছাত্রী আজ আসেনি। এদের পড়াতে পড়াতে মনে হয় তিনি যেন আরকানেই আছেন। তাদের নিজ বাড়িতে। তার স্বামী গেছেন কাজ করতে। শ^শুর শাশুড়ি দাওয়ায় বসে চা খাচ্ছেন বা রোদ পোহাচ্ছেন। একটু পর মনে হয় সব মিথ্যে, কল্পনা। তারা তো আসলে বেঁচে নেই।
তার ছাত্রী তানিয়াও মংডুর এক বিখ্যাত পরিবারের মেয়ে। তার দাদার বিশাল দোকান ছিল। বাবা, চাচারা ও দাদা সেই দোকান সামলাতেন। হঠাৎ কি থেকে কি হয়ে গেল। সাত বছরের তানিয়ার সব মনে আছে। সে বলেছে আমিনাকে। তারা সবাই প্রাণ বাঁচাতে সেই ব্যবসা প্রতিষ্ঠান আর ঘরবাড়ি ছেড়ে চলে এসেছে বাংলাদেশে। তারা যে রোহিঙ্গা। মিয়ানমারে রোহিঙ্গা কোন অধিকার নেই থাকার। নিঃস্ব দাদা বোরহান উদ্দিন এখন উখিয়ার একটি ক্যাম্পের এক শরণার্থী। আছেন স্ত্রী, দুই ছেলে ও ছেলের বউরা। তার কোন মেয়ে নেই। তারা আগেভাগে খবর পেয়ে মংডু থেকে পালাতে পেরেছেন। রয়ে গেছে জমিজমা, ব্যবসাপাতি ও ঘরবাড়ি। এখন সেগুলো দখল করে নিয়েছে তাদের দোকানের এ সময়ের কর্মচারী রাখাইন খিউ মিয়ান ইয়ং ও তার সাঙ্গোপাঙ্গরা। বড় ছেলে তানিয়ার বাবা নঈমুদ্দিন এসব মেনে নিতে পারেননি। তিনি তানিয়ার দুই ভাইকে নিয়ে লড়াই করে বাড়িঘর রক্ষার আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন। কিন্তু পারেননি। মাঝখান থেকে খিউর লোকদের ব্রাশ ফায়ারে প্রাণ হারিয়েছেন। মাকে নিয়ে কোন মতে দাদার সাথে বাংলাদেশে চলে এসেছে তানিয়া। মা রোখসানা ছিলেন পুকুরঘাটে। সেখান থেকেই এক কাপড়ে চলে এসেছেন। আমিনার সাথে সখ্য গড়ে ওঠে তানিয়ার মা রোখসানার। ছিলেন পাশাপাশি বস্তিঘরে। সেটাই শরণার্থী ক্যাম্প। বর্ষায় পানি ঝরে। শীতে ঠাণ্ডা হাওয়া ঢোকে। একটু ভালো থাকার আশায় আমিনার সাথে এসেছেন ভাসানচর। অবস্থা ভালো হলে সবাইকে নিয়ে আসবেন। কিন্তু তা আর বোধ হয় হবে না। এখানকার জীবন আরো কষ্টের।
আকবরের কাহিনী আরো করুণ। সে একা এসেছে বুচিডং শহরের সাহেব আলী পাড়া থেকে। তার কেউ বেঁচে নেই। মিয়ানমার সেনাদের নিক্ষিপ্ত গোলার আঘাতে ধ্বংস হয়েছে তাদের বাড়ি। লাল আগুনের লেলিহান শিখা সব কেড়ে নিয়েছে তার। মা বাবা দাদা দাদি কেউ বেঁচে নাই তার তার। সেসব মনে হলে কান্না পায়। তখন নীরবে কাঁদে। মায়ের মুখটা ভেসে ওঠে তার কল্পনায়। সানোয়ারা বেগম। তার মা বুচিডংয়ের রূপসী কন্যা ছিলেন। কি অপরাধে তাদের বাড়িতে মর্টারের গোলার লাল আগুন জ¦লেছিল সে জানে না। আমিনাই এখন তার মা। কয়েকটি এতিম ছেলে মেয়ের সাথে ভাসানচরের একটি কোয়ার্টারে থাকে আকবর। মায়ের কাছে পড়তে আসে। আমিনাও মাঝে মাঝে দেখতে যান। একদিন আমিনাকে বলেছিল সে-
: আচ্ছা মা ওরা আমাদের বড়িতে কামানের গোলা মারল কেন? আমরা কি অপরাধ করেছি। এখন কয়েক বছরে ভালো বাংলা শিখেছে আকবর।
: না বাবা ওসব মনে করিস না। ওসব ভেবে আর লাভ নাই। আমি আছি না !
: আমরা আরাকানে কবে যাবো?
: সময় হলে যাব বাপ। বড় হলে লেখাপড়া করে সব জানতে পারবি। কবে সময় হবে জানা নেই আমিনারও। তবু একটু বুঝ দেয়া। আমিনা বাবার কাছ থেকে শুনেছে শিশুদের স্বপ্ন দেখতে জানতে হবে। স্বপ্ন না থাকলে কেউ বড় হতে পারে না।
৮.
পনের দিন কেটে গেছে। আর কেউ নৌকা করে ভাসানচর থেকে পালিয়ে যাবার চেষ্টা করেনি। নিরাপত্তা বাহিনীর কড়াকড়ি তাই কমে এসেছে। যাদের কার্ড দেয়া হয়েছে সেসব পুরুষরা এখন সবজি ক্ষেতে কাজ করতে যেতে পারে। মেয়েরাও টুকটাক যায়। তবে খাদ্যের কষ্ট এখানে বড় কষ্ট। যা রেশন দেয়া হয় তাতে চলে না। তেমন টাকা পয়সা কারো কাছেই নেই যে জিনিসপত্র কিনবে। কয়েকটা দোকান আছে বটে। দুপাশে দালানের সারি। মাঝখানে রাস্তা। মুনা ও নাফার সাথে নতুন আসা এক নিরাপত্তা রক্ষীর বেশ ভাব হয়েছে। দুজনই তাকে আংকেল বলে ডাকে। মুনা নাম দিয়েছে বন্দুক আংকেল। তার কাঁধে সব সময় একটা রাইফেল থাকে। সব নিরাপত্তা রক্ষীরই যেমনটা থাকে।
বন্দুক আংকেল ওদের চকোলেট আর চিপস খেতে দেয়। বয়স কম বরকতে আলমের। রংপুরের ছেলে। সদ্য নেভিতে পোস্টিং হয়েছে। আর নতুন কর্মস্থল হয়েছে তার ভাসানচর। মা বাবা আর ভাইবোনের টানটা তার রয়ে গেছে। তাই হৃদয়টা এখনো ¯েœহার্দ্র। নইলে এই পোশাক ধারণ করলে রুক্ষতাই যেখানে সবার মধ্যে বাসা বাঁধে, সবাইকে অপরাধীর বাইরে ভাবাটা কঠিন হয়ে পড়ে, তার বেলাতে সেটা হয়নি এখনো।
শাস্তির মেয়াদ শেষ হতে জুলহাস আবার বাইরে যাওয়া শুরু করেন। কার্ডটা পেতে বেশ বেগ পেতে হয়েছে। আজ তার পেঁয়াজ ক্ষেত নিড়ানোর দায়িত্ব পড়েছে।
পেঁয়াজের ক্ষেত তাকে আবার নিয়ে যায় আরাকানে। আকিয়াবে। সেখানে ধান গম পেঁয়াজ লাগাত তারা নিজেদের জমিতে। সেসব ছবি ভেসে ওঠে চোখে। সেই জমি কি আর এখন নিজেদের বলা যাবে? ভাবেন জুলহাস। মনটা ভার হয়ে আসে। দেখতে দেখতে ছয়টা বছর পার হয়ে গেছে। আর বোধ হয় কখনো ফেরা হবে না আরাকানে।
আবার তার মাথায় ঢোকে মালয়েশিয়া। মাঝখানে সমুদ্র- জাহাজ-নীল পানি- পাখির ঝাঁক- জেলে নৌকা- সবশেষে ঝলমলে মালয়েশিয়া। জাজাহডুবি, ট্রলারে করে সমুদ্রে ভাসতে থাকা, না খেতে পাওয়া, মৃত্যু এবং পানিতে লাশ নিক্ষেপ এসবও আসে ভাবনায়। এগুলোকে ছাপিয়ে যায় ঝলমলে মালয়েশিয়া। সেখানে সুন্দর পোশাক পরে নাফা হাঁটছে, রেহানাকেও ভারি মিষ্টি লাগছে, আমিনা এ সাজে দেখলে তাকে আর নিন্দে মন্দ করতে পারবে না, এমনটাই মনে হতে থাকে তার। একা যাবার ভাবনাটা আগেই বাদ দিয়ে রেহানা ও নাফাকে যোগ করে নিয়েছেন জুলহাস। ওদের না নিয়ে গেলে বাঁচবেন কি নিয়ে?
৯.
২৬ এপ্রিল ২০২২। এ দিন উখিয়া রোহিঙ্গা শিবির পরিদর্শনে যান ডেনমার্কের রাজকুমারী মেরি এলিজাবেথ ডোনাল্ডসন। খবরটা আমিনা পান কিভাবে যেন। রাজকুমারী কুতুপালং ৫ নম্বর ক্যাস্পে যান। এই ক্যাম্পেই ছিলেন আমিনারা। বুঝতে অসুবিধা হয় না উনিও বেশ সুন্দরী হবেন। রাজকুমারীরা সুন্দরী হয়। তাদের মনও হয় নরম। আরো দুজনের কথা মনে আসে আমিনার। একজন তুরস্ক দেশের রানী এমিনেহ এরদোগান আরেকজন সিনেমা জগতের রানী এঞ্জেলিনা জোলি। কুতপালং ক্যাম্পে থাকতে তাদের সাথে আমিনা ও মাইমুনার দেখা হয়েছিল। আরো একজন এসেছিলেন, তিনিও সিনেমা জগতের রানী। প্রিয়াংকা চোপড়া। তারা কতনা আপন করে নিয়েছিলেন বুকে জড়িয়ে ধরেছিলেন আমিনাকে। তখন মুনার জন্ম হয়নি। তাই যে কোন বিদেশী মেহমান এলে নির্যাতিতা মহিলা হিসেবে তাকে হাজির করা হতো সামনে। এমিনেহ অনেকক্ষণ আমনিাকে বুকে টেনে নিয়ে বোন বলে সান্ত¡না দিয়েছেন, তাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদেছেন। এসব ভাবতে গিয়ে চোখটা ঝাপসা হয়ে আসে আমিনার। এমিনেহ বলেছিলেন,
: ‘‘বোন আমার, তোমার কষ্ট বুঝতে পারছি। চোখ মোছ। আমরা আছি না! তোমাদের আর না খেয়ে থাকতে হবে না।’’ কান্নায় বুক ভেসে গিয়েছিল আমিনার।
জোলিও তাকে বুকে জড়িয়ে ধরে একই কথা বলেছিলেন। মায়মুনাসহ শিশুদের সঙ্গে খেলা করেছেন জোলি। তিনি ছিলেন জাতিসংঘের শুভেচ্ছা দূত। শিশুর মতো মিশেছেন সবার সাথে। সাবানের বুদবুদ তুলে ফুঁ দিয়ে বাতাসে উড়িয়ে দিয়েছেন। ওদেরকে দিয়েছেন এত এত চকোলেট আর জামা কাপড়। মায়মুনা এখন মনে হয় বড় হয়ে গেছে। ক্লাস নাইনে ওঠবার কথা। নো ম্যানন্স ল্যান্ডের সেই মায়মুনা। ডেনমার্কের রাজকুমারীর সাথে কি তাদের দেখা হয়েছে? কই ভাসানচরে তো কোন রাজকুমারী আসেন না।
১০.
জুলহাসের মনে শান্তি নেই। মালয়েশিয়ার ঝলমলে আলো তাকে ডাকছে। ট্রলারে না খেতে পাওয়া, দু’মাস ধরে ট্রলারে করে ভাসতে থাকা, সমুদ্রের নীল পানিতে ডুবে ৩২ জনের মৃত্যু, সাগরে লাশ ভাসিয়ে দেয়া কোন কিছুই তার মধ্যে আর ক্রিয়া করছে না। এসব তুচ্ছ হয়ে যায় তার কাছে। এখানে এই ভাসানচরে পচে মরার চেয়ে সাগের মৃত্যু ঢের ভালো। শেষ একটা চেষ্টা নিতেই হবে। এবার কাজটা করতে হবে সঙ্গোপনে, শুধু এটুকু ভাবেন। কেউ জানবে না। বোন আমিনাও না।
তিনি যেতে না চান, থাকুন ভাসানচরে। সাগর পাড়ি তাকে দিতেই হবে। গোপনে একটা মোবাইল ফোন যোগাড় করে শাহপরীর দীপের লোকদের সাথে যোগাযোগ করে। নেটওয়ার্ক পেতে ভারি কষ্ট। তবুও কথাগুলো চলে। তারা তাকে একটা তারিখ দেয়। দেয় কিছু কোড নাম্বার। জানায় সেগুলো ধরে আসতে হবে। কোন ভয় নেই, ট্রলার তৈরি আছে। কিছু অর্থ এখন দিতে হবে, বাকিটা মালয়েশিয়া পৌঁছার পর। তাতেই রাজি জুলহাস।
রাতের শেষ প্রহরে কিভাবে ভাসানচর ছেড়ে এসেছেন জুলহাস বলতে পারবেন না। সাথে আরো ১৪ জন। রেহানা ও নাফা তো আছেই। একটা ঘোরের মধ্যে আছে সবাই। চট্টগ্রামে রাত কাটালো একটা বাড়িতে। পরের রাতে আবার গাড়ি। আগের গাড়ি পাল্টে তারা এবার একটা বাসে উঠেছে। ভোরের দিকে এটা পৌঁছবে দমদময়িা ঘাট হয়ে টেকনাফ। বেশভূষায় ট্যুরিস্ট। দেখলে মনে হবে দমদমিয়া ঘাট যাচ্ছে। সেখান থেকে যাবে সেন্টমার্টিন। ফলে তেমন বাধায় পড়তে হয়নি। শাহপরীর দ্বীপ পৌঁছলো জুলহাস ও তার সাথের লোকেরা। সব কিছু ঠিকঠাক আছে। আজ রাত এগারটায় ট্রলার ছাড়বে। গুড বাই প্রিয় বাংলাদেশ। সামনে কি হবে সেটা অজানা। ঘুম থেকে উঠে আমিনা একটা চিঠি পাবেন তাতে আরাকানি ভাষায় লেখা- প্রিয় ভাবী আমার, পারলে আমায় ক্ষমা করো।-ইতি তোমার হতভাগ্য দেবর জুলহাস।
আরও পড়ুন...