অন্য মাশরাফি, অনন্য মাশরাফি -আবু আবদুল্লাহ
খেলার চমক ফেব্রুয়ারি ২০১৮
একের পর এক পরাজয়ে যখন দিশেহারা সে সময়ে ওয়ানডে ও টি-টোয়েন্টি দলের দায়িত্ব নিয়েই পাল্টে দিয়েছেন দলের চেহারা। এশিয়া কাপের ফাইনাল, বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনাল, চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির সেমিফাইনালে খেলেছে তার নেতৃত্বে বাংলাদেশ। বিশ্বকাপের পর টানা তিনটি সিরিজে হারিয়েছে দক্ষিণ আফ্রিকা, পাকিস্তান ও ভারতকে। এসব সাফল্য তাকে বানিয়েছে নায়ক। মাশরাফি বিন মর্তুজা বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় ক্রিকেটার। কিন্তু শুধু কি খেলা! মাশরাফির প্রতি কোটি সমর্থকের এত ভালোবাসার নেপথ্যে রয়েছে ব্যক্তি মাশরাফির প্রতি মুগ্ধতা। তারকা হয়েও যিনি অতি সাধারণ, খ্যাতির শীর্ষে থেকেও যিনি আর দশ জনের মতো। মানুষের প্রতি, সমাজের প্রতি, দেশের প্রতি তার দায়বদ্ধতা আর দায়িত্বশীলতাও হতে পারে অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত। তাই ক্রিকেটার মাশরাফি নয়, ব্যক্তি মাশরাফিকে নিয়েই এবারের রচনা। মানুষের পাশে মাশরাফি জাতীয় দলের সাবেক বাঁহাতি পেসার সৈয়দ রাসেলের কথা মনে আছে? বছর তিনেক আগে বড় একটি ইনজুরিতে পড়েন রাসেল। অপারেশন করতে না পারলে মাঠে ফিরতে পারবেন না। খেলাই যার পেশা এমন একজনের জন্য বিষয়টি তখন রুটি-রুজির। কিন্তু ক্রিকেট বোর্ড থেকে পর্যাপ্ত সাহায্য দেয়া হলো না। রাসেল চিকিৎসার জন্য টাকা ধার চাইলেন বন্ধু মাশরাফির কাছে। মাশরাফি তাকে ভারত গিয়ে চিকিৎসার জন্য চার লাখ টাকা দিলেন, কিন্তু শর্ত দিলেন দুটো- টাকাটা ধার নয়, উপহার হিসেবে নিতে হবে এবং বিষয়টা গোপন রাখতে হবে। চিকিৎসা শেষে দীর্ঘ দুই বছর পর ২০১৭ সালের ঘরোয়া ক্রিকেটে মাঠে ফিরেছেন সৈয়দ রাসেল। তবে মাশরাফির দ্বিতীয় শর্তটি তিনি মানেননি। ঘনিষ্ঠ কয়েকজনের কাছে প্রকাশ করেছেন বন্ধু মাশরাফির সেই মহানুভবতার কথা। সেদিন মাশরাফি পাশে না দাঁড়ালে হয়তো থেমেই যেত এই পেসারের ক্যারিয়ার। ইতোমধ্যেই দেশের সবার জানা হয়ে গেছে নড়াইলের মানুষের জন্য ২০১৭ বিপিএলের চ্যাম্পিয়ন দল রংপুর রাইডার্সের অ্যাম্বুলেন্স উপহার দেয়ার কথা। ছোট্ট জেলা শহর নড়াইলের চিকিৎসাব্যবস্থা অতটা উন্নত নয়। একটু ভালো চিকিৎসার জন্য পার্শ¦বর্তী যশোর বা ঢাকায় রোগী নেয়ার মতো ভালো অ্যাম্বুলেন্সও নেই। বিপিএলের আগে মাশরাফি তার দল রংপুর রাইডার্সের মালিক পক্ষের কাছে অনুরোধ করেছিলেন নড়াইলবাসীর জন্য একটি উন্নত অ্যাম্বুলেন্স দিতে। সেই অনুরোধে সাড়া দিয়েই তারা কিছুদিন আগে উপহার দিয়েছে অত্যাধুনিক একটি অ্যাম্বুলেন্স। দীর্ঘদিন ধরেই নিজ শহর নড়াইলে মানব-কল্যাণে কাজ করছেন মাশরাফি। তার হাতে গড়া ‘নড়াইল এক্সপ্রেস ফাউন্ডেশন’ সেখানে সাধারণ মানুষের কাছে বড় একটি আস্থার নাম। কারো চিকিৎসা হচ্ছে না টাকার অভাবে, ছাত্ররা পরীক্ষার ফি দিতে পারছে না! খবর পেলেই পৌঁছে যায় নড়াইল এক্সপ্রেস ফাউন্ডেশনের সহযোগিতা। বিখ্যাত কিংবা ধনী হয়েছেন বলেই নয়, মানুষের পাশে দাঁড়ানোর অভ্যাস সেই শৈশব থেকে। এক সাক্ষাৎকারে কিছুদিন আগে বলেছেন, ‘ছোট বেলায় আমি আর মামা একবার খেতে বসেছি। আমাদের বাসার সামনের মোড়ের এক চায়ের দোকানদারের ডায়রিয়া হয়ে এমন অবস্থা, বিছানা থেকে উঠতে পারছে না। একজন এসে খবর দিল তাকে হাসপাতালে নিতে হবে। আমি গিয়ে দেখি দোকানির গায়ে ময়লা-টয়লা লেগে আছে। ওই অবস্থায় তাকে ভ্যানে উঠিয়ে আমি পাশে পাশে দৌড়ে হাসপাতালে পৌঁছে গেলাম।’ নড়াইলে মাশরাফির বাড়িতে থাকে ৭-৮ জন শিশু-কিশোর। এদের কেউ এতিম, কেউ টাকার অভাবে পড়তে পারছে না। এমন শিশুদের নিজ বাড়িতে আশ্রয় দিয়েছেন মাশরাফি। ভালো স্কুলে পড়ছে এই শিশুরা, তাদের জন্য রাখা হয়েছে গৃহশিক্ষকও। মাশরাফির বাবা-মা’র সাথে একই রান্না খায়। নিজের সন্তানদের জন্য যে মার্কেট থেকে জামা-কাপড় কেনেন সেখান থেকেই কেনা হয় এই শিশুদের কাপড়। পাশেই মাশরাফি যে নতুন বাড়ি করেছেন সেখানেও এই শিশুদের জন্য আলাদা ঘর করা হয়েছে। মিরপুরে মাশরাফির যে ছয়তলা বাড়ি আছে সেটির দ্বারও সবার জন্য খোলা। যে কোন প্রয়োজনে ঢাকায় আসা নড়াইল শহরের অনেকের কাছেই বাড়িটা অলিখিত আবাসিক হোটেল। গত ইংল্যান্ড সিরিজের সময় মিরপুরে মাঠে ঢুকে পড়া ভক্তকে নিরাপত্তা কর্মীদের হাত থেকে বাঁচাতে যেভাবে আগলে রেখেছিলেন তা শুধু মাশরাফি বলেই হয়তো সম্ভব। কিংবা গত বিপিএলে চিটাগং ভাইকিংসের পেসার শুভাশিস রায় মাঠে যেভাবে মাশরাফির দিকে তেড়ে গেছেন সেটা সবাই দেখেছে। তবু দিন শেষে নিজের ঘাড়ে দোষ টেনে নিয়ে তরুণ শুভাশিসকে রক্ষা করেছেন সমালোচনার হাত থেকে। সাদাসিধে মাশরাফি খুবই সাদসিধে আর চাকচিক্যহীন জীবন যাপনে অভ্যস্ত মাশরাফি। এত বিখ্যাত হওয়ার পরও নেই কোনা আহামরি ভাব। বড় তারকারা যেখানে নিরাপত্তার কড়াকড়ির মধ্যে থাকেন সেখানে মাশরাফির বাসার দরজা সব সময় সবার জন্য খোলা। খেলা কিংবা পারিবারিক ব্যস্ততা না থাকলে সারাক্ষণ বন্ধুদের নিয়ে আড্ডায় মেতে থাকেন। আর বন্ধুরা না থাকলে এমনও হয় যে রাস্তা থেকে অপরিচিত শিশুদের ডেকে এনে তাদের সাথে সময় কাটান। নড়াইলেও তার বাড়ির দরজা সব সময় সবার জন্য খোলা। মাশরাফির বন্ধু তালিকায়ও এমন কিছু নাম আছে যা শুনলে অনেকেই অবাক হবে। নড়াইল শহরের চৌরাস্তায় মেহগনি গাছের নিচে জুতো সেলাই করে রবি। এই রবিই মাশরাফির বাল্যকালের ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের একজন। এখন খ্যাতির শীর্ষে অবস্থান করলেও রবির কাছে গেলে সেই পুরনো মাশরাফি হয়ে যান তিনি। রাস্তার পাশে দাঁড়িয়েই রবির গলায় হাত দিয়ে আড্ডা মারেন ঘণ্টার পর ঘণ্টা। কিছুদিন আগে কাশ্মিরে ঘুরতে গিয়েছিলেন পরিবার নিয়ে। রাস্তার পাশে কিছু ছেলেকে ক্রিকেট খেলতে দেখেই গাড়ি থামিয়ে নেমে পড়েন। সামান্য একটু ক্রিকেটও খেলেন তাদের সাথে। কাশ্মিরি তরুণরা অবাক টাইগার অধিনায়ককে এভাবে নিজেদের মাঝে পেয়ে। ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়া সেই ভিডিওটি দেখেছে সারা বিশ্বের লাখ লাখ দর্শক। গত বিশ্বকাপের কথা। অস্ট্রেলিয়ায় বাংলাদেশ দলের প্র্যাকটিস চলছে। পাশে সাংবাদিকরা ভিড় করেছেন। কয়েকজন বাংলাদেশী সাংবাদিককে পেয়ে মাঠের এক কোনায় মাশরাফি গল্প জুড়ে দিলেন। তাই দেখে বিদেশী এক সাংবাদিকের মন্তব্য, ‘অধিনায়ক সাংবাদিকদের সাথে গল্প করবে এমনটা আমরা চিন্তাও করতে পারি না’। আসলে বাস্তবতাও তাই, অনেকে দেশেই তো নির্ধারিত সংবাদ সম্মেলন ছাড়া সাংবাদিকরা খেলোয়াড়দের কাছেই ঘেঁষতে পারেন না। এবারের বিপিএল শিরোপা জয়ের পর রংপুর রাইডার্সের পক্ষ থেকে যখন ৫ কোটি টাকা দামের রেঞ্জ রোভার গাড়ি দেয়ার পরিকল্পনার কথা জানাজানি হলো। মাশরাফি বললেন, দামি গাড়ি নিয়ে তার কোন উচ্চাকাক্সক্ষা নেই। মোটরসাইকেলই তার প্রিয় বাহন। এ কারণেই মাশরাফি অনন্য। বন্ধুদের কাছে ‘পাগলা’ নামে পরিচিত মাশরাফি বলেন, ‘ভবিষ্যৎ নিয়ে কোনো দিন ভাবিনি। আমার আম্মা-আব্বাকেও কখনো ভাবতে দেখিনি। তাদের বেশি চাহিদা নেই। অল্পের মধ্যে ভালো থাকতে চান। এসব দেখে বড় হয়েছি তাই আমার জীবনেও সুখ-শান্তি বলতে এটাই। শুধু একটাই চাওয়া ভালো মানুষ হিসেবে যেন বেঁচে থাকতে পারি। পরিবারে মাশরাফি পরিবারেও মাশরাফি অন্যসব সদস্যদের মতো সাধারণ। সেখানে নেই তারকা ক্রিকেটারের কোন ছায়া। বাবা-মায়ের কাছে এখনো সেই ছোট্ট মাশরাফিই তিনি। তাদের কোন সিদ্ধান্ত পছন্দ না হলেও মুখের ওপর না করতে পারে না। ¯্রষ্টার পর সবচেয়ে বেশি শ্রদ্ধা করেন মা হামিদা মুর্তজাকে। ধর্মীয় ও সামাজিক শিক্ষা কিংবা মানুষের পাশে দাঁড়ানোর শিক্ষা পরিবার থেকেই পেয়েছেন। শেষবার যখন (২০১৪ সালে) তাকে ওয়ানডে ও টি-টোয়েন্টি দলের অধিনায়ক করা হলে মাশরাফি নিতে চাইলেন না। কারণ এর আগে দুবার অধিনায়কত্ব পেলেও ইনজুরির কারণে দল থেকে ছিটকে পড়তে হয়েছে। কিন্তু তার বাবা গোলাম মুর্তজার নির্দেশ ছিলো ক্রিকেট বোর্ড যেহেতু চাইছে, এক ম্যাচের জন্য হলেও তুমি অধিনায়কত্ব নাও। বাবার চাওয়া ফেলতে পারেননি মাশরাফি। আর তার অধিনায়কত্বেই বাংলাদেশের ক্রিকেটে সূচনা হলো নতুন অধ্যায়। পরিবার থেকেই ইবাদত করার অভ্যাস কিংবা নৈতিকতা শিক্ষা পেয়েছেন সেটাও বলেন উঁচু গলায়। সংসার জীবনে এক কন্যা ও এক পুত্র সন্তানের জনক মাশরাফি। এখানেও অত্যন্ত দায়িত্বশীল তিনি। একবার গুরুত্বপূর্ণ একটি ম্যাচের আগে প্রশ্ন করা হয়েছিলো আপনার কাছে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ কী? মাশরাফির সাফ জবাব ছিলো- খেলাটা শুধুই বিনোদন। সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ সন্তানদের ভালো মানুষ হিসেবে গড়ে তোলা। সব কৃতজ্ঞতা দেন আল্লাহকে খেলোয়াড়ি দক্ষতা আর ব্যক্তিত্বই মাশরাফিকে এত মানুষের ভালোবাসা এনে দিয়েছে। তবু কোন কিছু নিয়েই গর্ব নেই তার। সব কিছুর কৃতিত্ব দেন আল্লাহ তায়ালাকে। দুই পায়ে ৭ বার অপারেশন করেও আবার খেলতে পারাকে তিনি আল্লাহর অশেষ রহমত ছাড়া আর কিছুই ভাবেন না। কিছুদিন আগে এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘আমি প্রবলভাবে বিশ্বাস করি, পৃথিবীতে যা কিছু হচ্ছে ওপরওয়ালার মাধ্যমেই হচ্ছে। শুধু পরিশ্রম করলেই সব পাওয়া যায় না। আামি চেষ্টা করেছি, কিন্তু ওপরওয়ালার থেকে না এলে আমার পক্ষে কিছুই সম্ভব হতো না।’ এখনো শত ব্যস্ততার মাঝেও কিংবা মাঠে প্র্যাকটিসের ফাঁকেও সুযোগ খুঁজে নেন নামাজ আদায়ের। নিজের যাবতীয় অর্জনের জন্য সর্বদা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন আল্লাহর কাছে। ইসলামের নির্দেশের কারণেই মায়ের প্রতি এত শ্রদ্ধা তার। মাশরাফি বলেন, ‘এর মূল কারণও ধর্মবিশ্বাস। ছোটবেলা থেকেই একটা কথা বিশ্বাস করে এসেছি, এখনো বিশ্বাস করি, মা যদি কোনো কথা বলেন, এর ওপরে কোনো কথা বলা যাবে না। আমার ধর্মের নির্দেশ এটি’। আর এই গুণগুলোই প্রতিনিয়ত মানুষের ভালোবাসার পাত্রে পরিণত করছে তাকে।
আরও পড়ুন...