সাগর যখন মরুভূমি

সাগর যখন মরুভূমি

Mr. Admin comment 203 views comment 0 comments

বিশাল মরুভূমি। অথচ একসময় সেখানে জলরাশিতে পূর্ণ ছিল। ছিল প্রাণের প্রাচুর্য। আরাল সাগর। এটি মূলত একটি হ্রদের নাম। আরবদের কাছে এই হ্রদটি বিশালতার কারণে সাগর হিসেবে পরিচিত ছিল। ১৯৬০ সালের দিকে আরাল সাগর পৃথিবীর বুকে চতুর্থ বৃহত্তম হ্রদ ছিল। পৃথিবীর ইতিহাসে আরাল সাগরের বয়স প্রায় ৫.৫ মিলিয়ন বছর। 

এটি একটি অভ্যন্তরীণ হ্রদ যা কোনও সমুদ্রের সাথে সংযুক্ত নয়। এটি বর্তমান উজবেকিস্তান এবং কাজাখস্তানের মধ্যবর্তী উত্তর-পশ্চিম কিজিল কুম প্রান্তরে অবস্থিত। এটি মধ্য এশিয়ার প্রচুর শুষ্ক জমিসহ এমন একটি জায়গায় অবস্থিত যেখানে গ্রীষ্মে তাপমাত্রা বেশি থাকে। এই তাপমাত্রা সাধারণত ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের কাছাকাছি থাকে। 

আরাল সাগরের আয়তন ৬৭ হাজার বর্গ কিলোমিটার। হ্রদটি ১৯৯৬ সালের হিসাব অনুযায়ী প্রায় ৭০% শুকিয়ে গেছে। মধ্য এশিয়ার দেশগুলোর অর্থনীতির সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত আরাল সাগরের শুকিয়ে যাওয়ার ঘটনা বর্তমান পৃথিবীর জন্য এক হুমকির বার্তা। এর শুকিয়ে যাওয়ার পেছনে বিজ্ঞানীরা একমাত্র মানুষকে দায়ী করেছেন।

৫০ বছর আগেও আরাল সাগর ছিল পৃথিবীর চতুর্থ বৃহত্তম হ্রদ। ৫ দশমিক ৫ মিলিয়ন বছর ধরে বইছিল এটি। 

আরাল সাগর তীরবর্তী এলাকার আবহাওয়া বসবাসের জন্য উপযুক্ত ছিল না। বার্ষিক বৃষ্টিপাতের পরিমাণ মাত্র ১০০ মিলিমিটার, যা যেকোনো প্রাণীর বসবাসের জন্য প্রতিকূল। প্রতি লিটার পানিতে লবণের পরিমাণ ছিল গড়ে ১০ গ্রাম করে। কয়েক প্রজাতির সামুদ্রিক মাছ বেঁচে থাকতো সেখানে। এদেরকে ঘিরে আরালের বুকে গড়ে উঠে ক্ষুদ্র মৎস্যশিল্প।

এখানে পাখিরা ছুটে আসতো পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে। সাগরটি শুকিয়ে যাওয়ার পেছনে দায়ী তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন। ১৯১৮ সালে গড়ে তোলা সোভিয়েত তুলা শিল্প তখন সফলতার শীর্ষে আরোহণ করছিল। সোভিয়েত সরকার বিশ্ববাজার ধরে রাখতে তুলার উৎপাদন বৃদ্ধি করার প্রকল্প হাতে নেয়। 

সির দরিয়া এবং আমু দরিয়া, এই দুই নদীর পানিকে তুলা ক্ষেতে সেচের কাজে ব্যবহার করার পরিকল্পনা করা হয়।  অনুর্বর মাঠ উর্বর করতে নদীর দিক পরিবর্তন করে তারা। এজন্য দক্ষ ইঞ্জিনিয়ারদের সাহায্যে নদীর পানি টেনে এনে তুলা চাষ অঞ্চলের দিকে ঘুরিয়ে দেওুয়া হয়। ফলে আরাল হ্রদের দিকে ধাবিত হওয়া পানির পরিমাণ কমে যায়। হ্রদের সঙ্গে কোনো সাগরের সংযোগ না থাকায় আস্তে আস্তে পানির পরিমাণ কমে যায়।

পানির পরিমাণ কমে যেতে থাকায় হ্রদের পানিতে লবণের ঘনত্ব মাত্রাতিরিক্তভাবে বেড়ে যায়। ফলে জলজ প্রাণীদের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়ে। এখান থেকে আরাল সাগরের ধ্বংসের সূচনা ঘটে। 

লবণের পরিমাণ বেড়ে যাওয়ার ফলে আবহাওয়ায় বড়ো রকমের পরিবর্তন ঘটে। ঝড়-তুফানের পরিমাণ বেড়ে যায় বহুগুণে। এ ছাড়াও বিভিন্ন গবেষণাগারের রাসায়নিক বর্জ্য, বিষাক্ত কীটনাশক, শিল্প-কারখানার বর্জ্য আরাল সাগরের পানিতে নিষ্কাশন করা হতো। 

পানি শুকিয়ে গেলেও লবণ থেকে যায়। বিপর্যয়ের কারণে পূর্বের আরাল সাগর উপকূলে ঘন লবণের স্তূপের সৃষ্টি হয়েছে। ফলে সেখানকার মাটির গুণাগুণ নষ্ট হয়ে যায়। লবণাক্ত পরিবেশ মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। ফলে বিভিন্ন প্রাণঘাতী রোগ মহামারী হিসেবে দেখা দেয়। সরকারি হিসাব অনুযায়ী, ৫০ বছরের মাথায় আরাল সাগরে লবণের ঘনত্ব বেড়ে লিটারপ্রতি গড়ে ১০০ গ্রাম হয়ে যায়।

১৯৯০ সালের দিকে আরাল সাগর এলাকার প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যায়। আরাল সাগরতীরে গড়ে ওঠা মৎস্যশিল্পের চূড়ান্ত পতন ঘটে। পরিবেশবিদরা আরাল সাগরের পরিণতি দেখে চিন্তায় পড়ে যান। বৈশ্বিক উষ্ণায়নের হুমকির সাথে লড়াই করতে থাকা মানবজাতির জন্য আরাল সাগর বিপর্যয় এক অপূরণীয় ক্ষতি।

১৯৬০ সালের বিশাল হ্রদের পানি দ্রুত শুকিয়ে যেতে থাকে। স্থানীয় অধিবাসীরা বিষয়টি লক্ষ করে। আরালের পানির ওপর নির্ভরশীল অধিবাসীরা উপায় না দেখে অন্য প্রদেশে চলে যেতে থাকে। ১৯৯৭ সালের শুরুর দিকে করা জরিপ অনুযায়ী আরাল সাগরের প্রায় ৯০ শতাংশ পানি শুকিয়ে গেছে। পানির প্রবাহ কমতে কমতে এক সময়ের বিশাল আরাল সাগর সামান্য জলাশয়ে পরিণত হয়। 

আরাল সাগরের দক্ষিণভাগ এখনও মরুভূমির মতো শুষ্ক। উত্তরাংশ ধীরে ধীরে ফিরে পাচ্ছে জীবনপ্রবাহ। ১৯৯০ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন ঘটলে আরাল সাগর নব্য রাষ্ট্র কাজাখস্তান এবং উজবেকিস্তানের অধীনে চলে আসে।

পরবর্তীতে বিভিন্ন দীর্ঘমেয়াদি প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়। লম্বা খাল খনন করে দক্ষিণে সাগর থেকে পানি আনার প্রচেষ্টা করা হয়। তবে প্রযুক্তিগত ত্রুটি এবং দুর্বল ব্যবস্থাপনার কারণে কোটি কোটি ডলার লোকসান হয়। শেষ পর্যন্ত পুরো প্রকল্প বাতিল করে দেওয়া হয়। 

এরপর ২০০৩ সালে কাজাখস্তান সরকার ঘোষণা দেয়, বাঁধ নির্মাণের মাধ্যমে পুনরায় নদীর পানি আরালের দিকে প্রবাহিত করা হবে। কিন্তু উজবেকিস্তানের সঙ্গে প্রকল্পের বিভিন্ন ইস্যুতে একমত হতে না পারায় পুরো আরাল জুড়ে বাঁধ নির্মাণের প্রকল্প স্থগিত করা হয়।

তবে কাজাখস্তান সরকার নিজস্ব অর্থায়নে কাজাখস্তান সীমানায় বাঁধ নির্মাণ শুরু করার নির্দেশ দেন। ২০০৫ সালের দিকে বাঁধ নির্মাণ শেষ হয়। বাঁধের কারণে কাজাখ অঞ্চলে আরাল সাগরের পরিস্থিতি কিছুটা উন্নতি হয়। হ্রদে পানির পরিমাণ বৃদ্ধি পায় এবং উত্তর আরাল সাগরে মাছ চাষ শুরু হয়। 

কাজাখস্তানের সাফল্যে উজ্জীবিত হয়ে উজবেকিস্তানের বিজ্ঞানীরাও এগিয়ে আসেন। কিন্তু পানির অধিকার সংক্রান্ত আলোচনায় কেউই সমঝোতায় আসতে না পারায় এই প্রকল্প বেশিদূর এগোয়নি। পরবর্তীতে বিশ্বব্যাংক এই কাজে সহায়তার হাত বাড়িয়ে দেয়। কাজাখ সরকারকে ৬৫ মিলিয়ন ডলার ঋণ প্রদান করা ছাড়াও প্রায় ৮৬ মিলিয়ন ডলারের প্রকল্প হাতে নেয় বিশ্বব্যাংক। 

২০০৮ সালে দ্বিতীয় বাঁধ নির্মাণের মাধ্যমে পুনরায় উত্তর আরাল সাগরে পানি প্রবাহ শুরু হয়। কাজাখস্তান বাঁধ নির্মাণের মাধ্যমে পানি পুনরায় আনতে সক্ষম হলেও, গবেষকদের মতে, আর কখনোই আরাল সাগরের পানি সম্পূর্ণরূপে ফিরে পাওয়া সম্ভব হবে না। আরাল সাগর বিপর্যয়কে বিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে ভয়াবহ প্রাকৃতিক দুর্যোগ হিসেবে ধরা হয়।

আপনার মন্তাব্য লিখুন
অনলাইনে কিশোরকন্ঠ অর্ডার করুন
লেখকের আরও লেখা

সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

আরও পড়ুন...

CART 0

আপনার প্রোডাক্ট সমূহ