ঈদ ক্যালিগ্রাফি রঙে রেখায় আনন্দ অনুভব

ঈদ ক্যালিগ্রাফি রঙে রেখায় আনন্দ অনুভব

বিবিধ মোহাম্মদ আবদুর রহীম এপ্রিল ২০২৩

প্রিয় বন্ধুরা! তোমরা জানো ঈদ হচ্ছে মুসলমানদের সবচেয়ে বড় আনন্দ উৎসবের দিন। আর এটা একটি পবিত্র ইবাদতের দিনও বটে। পৃথিবীতে বিভিন্ন ধর্মে সমাজে উৎসবের নানান ধরন, রঙ ও আবেশ রয়েছে। মানুষ বিশ্বাস অবলম্বন করে বাঁচতে চায়। মানুষের জীবনে দুঃখ কষ্ট বেদনার সাথে কিছু আনন্দ উৎসবের বিষয়ও আছে। এসব আনন্দ উৎসবের কিছু জাগতিক ও জৈবিক আর কিছু আছে আধ্যাত্মিক। মুসলিমের জীবনে বছরে দুই ঈদ হচ্ছে ইবাদত ও খুশির দিন। সবাই দিলের তামান্না সম্ভাষণ ও নিজের একান্ত পদ্ধতিতে আনন্দ প্রকাশ করে থাকেন। 

ক্যালিগ্রাফারগণ যুগ যুগ ধরে হাতের কারুকাজ ও আধ্যাত্মিকতার মিশ্রণে এই আনন্দ ও খুশি ক্যালিগ্রাফির মাধ্যমে  প্রকাশ করে আসছেন।

ঈদ নিয়ে দেশে বিদেশে নানা ধরনের ক্যালিগ্রাফি হয়ে থাকে। গ্রামীণ সমাজে রঙিন কাগজে জরির গুঁড়ো দিয়ে ঈদ মোবারক লিখে ঘরের দরজার উপর সেঁটে দেয়া হয়। শিশু-কিশোররা রঙিন কাগজ কেটে রঙ দিয়ে নকশা এঁকে ঈদকার্ড বানায়। এসব লোকায়ত ঈদ ক্যালিগ্রাফিতে যেমন উৎসবের আমেজ থাকে, তেমনি এতে আধ্যাত্মিকতার অনুভব পাওয়া যায়। ঈদের ক্যালিগ্রাফি বাড়ির আঙ্গিনা পেরিয়ে ঈদগাহে পৌঁছে যায়, ঈদগাহের সদর ফটকের উপরে এবং কোথাও মিহরাবসহ চারদিকে সুতা দিয়ে ঈদ সংক্রান্ত কথা, হাদিসের বাণী টাঙানো হয়।

বাংলাদেশের শহরাঞ্চলে ঈদকার্ড বিতরণের প্রচলন একটি কালচারে পরিণত হয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে ইন্টারনেটের দাপটে তা কিছুটা ম্রিয়মাণ  হলেও কোন রকমে টিকে আছে। এখনও বিভিন্ন সরকারি- বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, সামাজিক-সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক, আর্থিক, কর্পোরেট হাউজ ঈদের কার্ড বিতরণ করে থাকে এবং এসব কার্ডে ঈদের ক্যালিগ্রাফি থাকে। তবে নেট ব্যবহারে অভ্যস্ত মানুষ এখন ঈদ মোবারক লেখা নানা ধরনের ক্যালিগ্রাফি ইমেজ পরস্পর বিনিময় করছে। এক সময় ঢাকায় ঈদের শোভাযাত্রা বের হতো, সেখানে প্ল্যাকার্ড-ফেস্টুনে ঈদের ক্যালিগ্রাফি লেখা থাকতো। এছাড়া ঈদমেলায় বাচ্চাদের জন্য ফোলানো বেলুনে ঈদ মোবারক লেখা হয়। ঈদ উপলক্ষে আয়োজিত ঘরোয়া অনুষ্ঠান সাজাতে ঈদ ক্যালিগ্রাফির ব্যবহার লক্ষণীয়।

বাংলাদেশে শিল্পকলায় ক্যালিগ্রাফির চর্চা স্বাধীনতার পর শুরু হলেও নব্বই দশকে ঈদ ক্যালিগ্রাফি ব্যাপকভাবে লক্ষ করা যায়। ঈদ ক্যালিগ্রাফি উৎসবকেন্দ্রিক হওয়ায় বছরের অন্য সময় তেমন লক্ষ করা যায় না।

বর্তমান সময়ে ক্যালিগ্রাফি চর্চায় দেশে একদল নিবেদিতপ্রাণ শিল্পী কাজ করছেন। তাদের বিভিন্ন সময়ে করা ঈদ ক্যালিগ্রাফি মানুষকে আগ্রহান্বিত করেছে।

বিদেশে ঈদ ক্যালিগ্রাফি নিয়ে প্রচুর কাজ আছে। বহুবছর আগে আমেরিকার বিখ্যাত ক্যালিগ্রাফার উস্তাদ মোহাম্মদ জাকারিয়ার সুলুস শৈলীর ‘ঈদ মোবারক’ সে দেশের ডাক টিকিটে ছাপা হয়। বিষয়টি তখন খুব আলোড়ন তুলেছিল। সেটা ২০০১ সালের কথা। এর কয়েক বছর পর ফেসবুকে যখন ওয়ার্ল্ড ক্যালিগ্রাফারদের সাথে পরিচয় ও বন্ধুত্ব হওয়া শুরু হলো আমাদের দেশের ক্যালিগ্রাফারদের, ঈদ শুভেচ্ছা জানানোর ক্যালিগ্রাফির শত শত কাজ তাদের অভিভূত করেছে। 

ঈদের ক্যালিগ্রাফি নিয়ে বিশেষভাবে, দেশে ও বিদেশের কয়েকজনের কাজ খুব আকর্ষণীয়। 

এসব কাজে শিল্প আধ্যাত্মিকতার বিষয়ে কয়েকটি কথা বলা দরকার। 

বাংলাদেশে রাজশাহীর ক্যালিগ্রাফার মোস্তফা আল মারুফ নাস্তালিকে যে কাজটি করেছেন ডিজিটাল পদ্ধতিতে, এটা চমৎকার হয়েছে। এখানে কম্পোজিশন আইডিয়াটা মনে দোলা দেয়। আর সুলুস জালিতে জুনায়েদ ক্যালিগ্রাফারের কলমের কাজটিও আকর্ষণীয় ও শিল্পচাতুর্যে সমৃদ্ধ। ময়মনসিংহের ক্যালিগ্রাফার বাংলাদেশ ক্যালিগ্রাফি সোসাইটির ক্যালিগ্রাফি ক্লাসের প্রথমদিকের ছাত্র নিসার জামিল কুফি ও রুকাহ শৈলীতে একটু ব্যতিক্রমী স্ট্রোকে ক্যালিগ্রাফি করেছেন। এতে অলঙ্করণ হিসেবে চাঁদ-তারা মটিফ তার শিল্প আধ্যাত্মিকতার পরিচয়।

বিদেশে মরক্কোর উস্তাদ আমের বিন জাদ্দু ঐতিহ্যবাহী কায়রোয়ানি কুফিতে যে কাজটি করেছেন, তা একান্ত তার নিজস্ব রীতি। অন্যদিকে সে দেশের আরেক বিখ্যাত উস্তাদ আমর জুমনী কুফির সবচেয়ে আধুনিক ধারায় নিজস্ব স্টাইলে ‘ঈদ সাঈদ’ লিখেছেন। দেশের ক্যালিগ্রাফার মোহাম্মদ আবদুর রহীম তার কাজে প্রভাবিত হয়ে অনেকগুলো কাজ কপি ও নিরীক্ষা করেছেন। তার এ কাজটি শিল্প আধ্যাত্মিকতার চমৎকার একটি নিদর্শন। 

নিউজিল্যান্ড প্রবাসী ইরাকি মহিলা ক্যালিগ্রাফার জান্না আদনান ইজেত, রোটিং কম্পোজিশনে ঈদুকুম মুবারক দুইবার লিখেছেন জালি সুলুস শৈলীর জটিল রীতিতে।  তিনি বুঝাতে চেয়েছেন, ঈদ বছর ঘুরে আবার আমাদের মাঝে ফিরে আসে। এটি এ কাজের শিল্প আধ্যাত্মিকতা।

পাকিস্তানের ক্যালিগ্রাফার বন্ধু আবদুল রাজ্জাক রাজী প্রাচীন ভারতীয় গুলজার রীতির বিশেষ কম্পোজিশন এক হরফ দুই/তিন বার পড়ার কৌশল এখানে সুলুস শৈলীতে প্রয়োগ করে ‘ঈদ সাঈদ’ লিখেছেন। এটি মূলত তুর্ক-ইরান-তুরানের আধ্যাত্মিক সুফি ধারায় আশেক-মাশুক একাকার দর্শনের রীতি।

তুরস্কের ক্যালিগ্রাফার যাকি আলী আল-হাশেমী ক্যালিগ্রাফির হরফের অবস্থানগত অবয়বের রূপকে সুলুস জালিতে এমনভাবে সাজিয়েছেন যা শিল্প আধ্যাত্মিকতায় পরিপূর্ণ। এখানে ঈদ সাঈদ কথাটার সিন হরফ মুরাক্কাবাত এবং বাকি হরফগুলো মুফরাদাত (ক্যালিগ্রাফিতে শব্দের ভেতর বাইরে হরফের অবস্থানগত পরিচয়) কম্পোজিশনে করেছেন, এটা সুফি ধারার তুর্কি স্টাইল। 

২০১৬ সালের ওস্তাদ মোহাম্মদ আবদুর রহীমের একটা সুলুসের কাজ আছে। তাতে বাঙালি একটা ভাব আছে,  আমাদের বাংলার সুলতানি আমলের সুলুসের প্রভাব বুঝা যায়। আর এবার যে কাজগুলো তিনি করেছেন, তাতে বাহরি আল-বাঙালি শৈলীর একটা কাজে (ঈদুল ফিতর) কম্পোজিশনের স্বার্থে দুটো হরফ মুফরাদাত ও বাকিগুলো মুরাক্কাবাত লক্ষ করা যায়। এ ধরনের কাজ ফারসি তালিক শৈলীতেও আছে।

এই যে ধর্মীয় রিচ্যুয়ালকে নিয়ে নিজের মনের মতো ক্যালিগ্রাফি করা, এতে শিল্প আধ্যাত্মিকতা দর্শককে আপ্লুত করে ও ইবাদতে মগ্ন করে আর ক্যালিগ্রাফারের হৃদয়ে দোলা দেয় প্রেরণার ফল্গুধারা হয়ে।

ঈদ ক্যালিগ্রাফিতে নান্দনিকতার সাথে বরকতের অনুভব মানুষকে আরো প্রাণিত করে। এটি মুসলিম সংস্কৃতির একটি মনোরম বিষয়। আমাদের জাতীয় জীবনে ঈদ ক্যালিগ্রাফি আনন্দ উদযাপনে আরো নান্দনিক ও বরকতময় হয়ে উঠুক।

আপনার মন্তাব্য লিখুন
অনলাইনে কিশোরকন্ঠ অর্ডার করুন
লেখকের আরও লেখা

সর্বাধিক পঠিত

আর্কাইভ

আরও পড়ুন...

CART 0

আপনার প্রোডাক্ট সমূহ