Home গল্প টোকাই -শামীমা আক্তার

টোকাই -শামীমা আক্তার

মিন্টু নামের একটি ছেলে। মা-বাবাহীন মিন্টু হলো টোকাই। কমলাপুর রেলস্টেশনের পাশে একটা বস্তিতে সে থাকে। মিন্টু জানে না তার মা-বাবা কে?
শুধু জানে তার এক দাদা ছিল। সেই দাদাই তাকে কোলেপিঠে করে বড়ো করেছে। মিন্টু জন্ম থেকেই পৃথিবীর মানুষগুলোর নির্মম নিষ্ঠুরতার শিকার। জন্ম থেকেই দুঃখী আর একা সে। জন্মের পর কে বা কারা যেন তাকে রাস্তার পাশের ডাস্টবিনের আবর্জনার স্তূপে ফেলে রেখে যায়। বাঁচার কথা ছিল না। ভাগ্যক্রমে সে বেঁচে গেছে। এক বৃদ্ধ রিকশাচালক মিন্টুর কান্নার শব্দ শুনতে পেয়ে ডাস্টবিন থেকে তুলে তার বাসায় নিয়ে আসে ও লালন পালন করতে থাকে। বৃদ্ধ রিকশাচালককে মিন্টু দাদা বলে ডাকতো। বয়স যখন ৬ বছর তখন তার দাদা অসুস্থ হয়ে মারা যায়। মিন্টু তখন খুব একা হয়ে যায়। কারণ দাদা ছাড়া এই পৃথিবীতে তার আর কেউ ছিল না। সে তখন মানুষের কাছে হাত পেতে খাবার চেয়ে খেতো। কারো মনে মায়া হলে খাবার দিতো, কেউ দিতো না, গলাধাক্কা দিয়ে তাড়িয়ে দিতো। মিন্টু তখন খুব কষ্ট পেতো, কান্না করতো আর বলতো, দাদাগো, আমারে ফালাইয়া তুমি কই চইলা গেলা? এরপর সে ভিক্ষা করা শুরু করলো। ভিক্ষা করে যে টাকা পেতো তা দিয়ে তিনবেলা পেট ভরে খেতে পারতো না। দুইবেলা খেতো আর একবেলা না খেয়ে থাকতো। যেদিন ভিক্ষা পেতো না সেদিন সে না খেয়ে থাকতো। এভাবে আধপেটা খেয়ে মিন্টুর দিন কাটছিল। একদিন খোকন নামের এক টোকাই ছেলের সাথে পরিচয় হলো। সে কাগজ, প্লাস্টিকের বোতল, এসব কুড়ায়। খোকন বলল- শোন মিন্টু আমার লগে কাগজ টুকানের কাম কর। ভালো আয় রোজগার হইবো। তুই তিনবেলা পেট ভইরা খাইতে পারবি। করবি আমার লগে টোকাইয়ের কাম? মিন্টু রাজি হলো। সেদিন থেকে মিন্টু খোকনের সাথে টোকাইয়ের কাজ করে। রাস্তা, রেলস্টেশন থেকে কাগজ, প্লাস্টিকের বোতল এসব কুড়িয়ে ভাঙ্গাড়ির দোকানে বিক্রি করে। এখন মিন্টু তিন বেলা পেট ভরে খেতে পায়। একদিন সে রেলস্টেশন থেকে একটি লেডিস হাতব্যাগ কুড়িয়ে পায়। মিন্টু ব্যাগ খুলে দেখে সেখানে কিছু টাকা আর কাগজপত্র আছে। তারপর সে দৌড়ে গিয়ে ব্যাগটা রেলস্টেশনে ডিউটিতে থাকা এক পুলিশের কাছে দেয়। পুলিশ দেখে ব্যাগের ভেতর কিছু টাকা, পাসপোর্ট এসব আছে। শারমিন চৌধুরী নামে এক ভদ্রমহিলার একটি আইডি কার্ড আছে। ভদ্রমহিলা একজন ডাক্তার। পুলিশ কাগজপত্র থেকে শারমিন চৌধুরীর ফোন নাম্বার পেলো। তারপর তাকে ফোন করে বলল যে তার একটি ব্যাগ পাওয়া গেছে। শারমিন চৌধুরী থানায় এলো তারপর ব্যাগ চেক করে বলল হুম সবকিছু তো ঠিকই আছে। ব্যাগে আমার কিছু টাকা, পাসপোর্ট, আইডি কার্ড ছিল। আমি ভুলে ব্যাগটি ফেলে চলে গিয়েছিলাম। তারপর মিন্টুকে বলল কী বলে যে তোমাকে ধন্যবাদ দেবো বুঝতে পারছি না। মিন্টুকে কাছে ডেকে জিজ্ঞেস করল নাম কী তোমার? মিন্টু একটু সলাজ হেসে বলল আমার নাম মিন্টু। শারমিন চৌধুরী দেখলো ধুলোমাখা চেহারা, রোগা পাতলা ছেলেটি। ঠিকমতো হয়তো খেতেও পায় না। চোখেমুখে তার দুঃখ আর দরিদ্রতার ছাপ স্পষ্ট। শারমিন চৌধুরী বলল আমার ব্যাগে তো টাকা ছিল। তুমি সেই টাকা নিলে না কেন? তোমার তো টাকার খুব প্রয়োজন। তুমি চাইলে তো সেই টাকা দিয়ে খাবার কিনতে পারতে, নতুন জামা কিনতে পারতে। শারমিন চৌধুরীর কথা শুনে মিন্টু একগাল হেসে বলল জি না ম্যাডাম। আমার দাদা কইছে পরের জিনিসের ওপর লোভ করা ভালা না। কারো টাকা পয়সা পাইলে তারে ফিরাইয়া দিতে কইছে। শারমিন চৌধুরী ছোট্ট এই টোকাই ছেলেটির কথা শুনে খুব খুশি হলেন এবং তার সততা দেখে খুব অবাক হলেন। তারপর শারমিন চৌধুরী মিন্টুকে বললেন, আমার কোনো সন্তান নেই। তুই আমার ছেলে হবি? মিন্টু হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়লো। শারমিন চৌধুরী পুলিশের কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে মিন্টুকে তার বাড়ি নিয়ে গেলেন। বাড়ি গিয়ে শারমিন চৌধুরী মিন্টুকে বললেন আজ থেকে তুই আমার ছেলে। আমাকে তুই মা বলে ডাকবি, কি পারবি না? এই কথা শুনে মা-হীন মিন্টুর চোখ বেয়ে আনন্দ অশ্রু গড়িয়ে পড়লো। মিন্টু বলল জন্মের পরে আমি মারে দেহি নাই। মা কেমন হয় জানি না! কোনোদিন মায়ের আদর ভালোবাসা পাই নাই। আজ থাইকা আপনে আমার মা। এই কথা বলে মিন্টু শারমিন চৌধুরীকে মা বলে ডাকলো। মিন্টুর মুখে মা ডাক শুনে শারমিন চৌধুরীর চোখ দিয়ে আনন্দ অশ্রু গড়িয়ে পড়লো। শারমিন চৌধুরী মিন্টুকে বুকে জড়িয়ে নিলেন। তারপর থেকে মিন্টু শারমিন চৌধুরীর কাছেই থাকে। শারমিন চৌধুরী মিন্টুকে ছেলের আদরে লালন পালন করতে লাগলেন। এখন মিন্টুকে দেখে চেনা যায় না। মিন্টু এখন ফ্ল্যাট বাসায় থাকে। ভালো ভালো খাবার খায়। সুন্দর সুন্দর জামা কাপড় পরে। মিন্টুকে দেখতে এখন মেম সাহেবের ছেলের মতো লাগে। শারমিন চৌধুরী মিন্টুকে শহরের একটি ভালো স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিলেন। মিন্টু এখন স্কুলে যায়। মিন্টুর দাদার খুব ইচ্ছা ছিল মিন্টু স্কুলে যাবে। পড়ালেখা করে মানুষের মতো মানুষ হবে। আজ মিন্টুর দাদা বেঁচে নেই। কিন্তু তার ইচ্ছা পূরণ হয়েছে। মিন্টুর কাছে তার দাদার একটি ছবি ছিল। মিন্টু ছবিটি সব সময় তার কাছে রাখে। প্রতি রাতে ঘুমানোর আগে মিন্টু দাদার ছবির সাথে কথা বলে। এক রাতে মিন্টু তার দাদার ছবির সাথে কথা বলতে লাগলো, দাদা তোমার স্বপ্ন পূরণ হয়েছে। আমি এখন স্কুলে যাই। আমাকে এখন আর কেউ টোকাই বলে ডাকে না। আমি এখন আর টোকাই না।

SHARE

Leave a Reply