Home ক্যারিয়ার গাইড লাইন চাই ভাষার প্রতি ভালোবাসা -ড. আহসান হাবীব ইমরোজ

চাই ভাষার প্রতি ভালোবাসা -ড. আহসান হাবীব ইমরোজ

সামনে ২১ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩। কিন্তু সেদিন বাংলা তারিখ কত? হয়তো সবাই একগাল হাসবে। মনে মনে আমার মুণ্ডু চিবিয়ে বলবে- যত্তোসব, কে না জানে ৮ ফাল্গুন-১৪২৯। আরে সাহেব, হ্যাঁ তোমাকেই বলছি, আজ না হয় উতরে গেলে।
কিন্তু আচানক ১৫-২০ দিন পরে জিজ্ঞেস করলে আলবত বুঝা যাবে, কত ধানে কত চাল।
ইংরেজি বর্ণমালা ঠোঁটস্থ, ২৬টি লেটার। বলতে মাত্র ৪-৫ সেকেন্ড সময় লাগে। সিরিয়ালের সুবাদে কচি-কিশোররাও হিন্দিতে ফরফরা।

কিন্তু বাংলা অ থেকে চন্দ্রবিন্দু পর্যন্ত ৫০টি বর্ণ ধারাবাহিকভাবে বলতে গেলে হাড্ডি পানি হবার মতো অবস্থা। অক্কা পাওয়া, পটোল তোলা আরো কত কী। কিন্তু কেন?
নানা ট্রেনিং প্রোগ্রামে এই প্রশ্নটি করেছি, বলুনতো প্রাণের বর্ণমালায় কতটি বর্ণ; কে কয়টি পারেন? শতকরা ৫-৬ জন পেরেছেন ধারাবাহিক ৫০টি বর্ণ বলতে।
একটি সত্য ঘটনা বলছি; না কোন স্কুল, কলেজ নয় দেশের হাইপ্রোফাইল লোকদের বিশেষায়িত ইংরেজি ক্লাস নেন এবং তার স্বরচিত ইংরেজি শেখার বইয়ের সংখ্যা প্রায় ৩০টি এমন এক গুরুজন। আরেকজন আমেরিকা ও জাপানে ৬ মাস ধরে ইংরেজি শিক্ষাদানের প্রশিক্ষণ নিয়েছেন এমন দু’জনকে দুটি প্রশ্ন করেছিলাম। তারা অনেক ভেবেছেন, ঘেঁটেছেন, খেটেছেন কিন্তু আমাদের মনমতো উত্তর খুঁজে পাননি। তোমাদের জন্যও থাকলো নতুন বছরের দ্বিতীয় মাসে মাত্র দুটো প্রশ্ন। দেখতো কোনো সমাধান করা যায় কিনা?

এক. খালাতো ভাই বা বোনের ইংরেজি কী? (কাজিন বলা যাবে না কিন্তু। কারণ আমরা জানি, কাজিনের অর্থ খালাতো, মামাতো, ফুফাতো, চাচাতো ভাই ও বোন মোট ৮ প্রকার। আমাদের সুনির্দিষ্ট করে খালাতো ভাই কিংবা বোনের ইংরেজি বলতে হবে।)

দুই. পরশু এর আগের বা পরের দিনকে বাংলা অভিধানে বলা হয় তরশু দিন এর ইংরেজি কী?
ফাগুনের আগুন লেগেছে প্রকৃতি ও প্রাণে। পলাশ, শিমুলসহ নজরকাড়া ফুলগুলো যেন তারই জানান দিচ্ছে সবখানে। দেখোতো বাংলাদেশের পতাকাটি কত চমৎকার! সবুজ জমিনে একটি লাল বৃত্ত। সবুজ সেতো বাংলার আবহমান প্রকৃতি এবং এর দামাল তারুণ্যেরও প্রতীক। রাসূল সা. এরও প্রিয় রঙ এটি। আর লাল হচ্ছে বিজয়ের সূর্য এবং ত্যাগেরও রঙ সেটি। স্বাধীনতার জন্য আত্মদান এমনকি ভাষার জন্যও রক্তদান। ভাষার জন্য এই রক্তদানের স্মৃতিকে বিশ্বময় ভাস্বর করে রাখতে জাতিসংঘ ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক রাষ্ট্রভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করেছে। এই সময় আমরা জেনে নিতে পারি বাংলা ভাষার কিছু মজার তথ্য।
এক. এটি লিঙ্গ-নিরপেক্ষ ভাষা: অধিকাংশ ক্ষেত্রে বাংলায় সর্বনাম, ক্রিয়া, বিশেষণ ইত্যাদির কোনো লিঙ্গ-ভিত্তিক পার্থক্য নেই। উদাহরণ স্বরূপ, ‘সে যাচ্ছে→’ বাক্যটির অর্থ ‘তিনি পুরুষ/নারী যাচ্ছেন’ অর্থাৎ উভয় লিঙ্গকেই বুঝায়। অথচ ইংরেজিতে হি এবং সি এর ছড়াছড়ি।

দুই. একাধিক বাক্যের ক্রম: সাধারণভাবে, ইংরেজি বাক্যগুলো একটি কঠোর ঝঠঙ প্যাটার্নে সাজানো হয়, যেখানে ঝঠঙ মানে ‘সাবজেক্ট বা কর্তা-ভার্ব বা ক্রিয়া-অবজেক্ট বা কর্ম’। যেমন ‘আমি ফল খাই।’ কিন্তু ইংরেজিতে কখনোই ‘ফল খাই আমি।’ ‘আমি খাই ফল।’ ‘খাই ফল আমি।’ ইত্যাদি সঠিক হবে না।
কিন্তু বাংলায়? আমি ফল খাই। আমি খাই ফল। ফল খাই আমি। ফল আমি খাই। খাই আমি ফল। খাই ফল আমি।
আশ্চর্যজনক বিষয় হলো, এই সমস্ত বাক্যের ফর্মগুলোর, উপযুক্ত প্রসঙ্গে এগুলো সবই বৈধ। উদাহরণস্বরূপ, একজন কবি যদি এমন একটি বাক্য গঠন করতে চান যা অন্য লাইনের সাথে ছন্দবদ্ধ হওয়া উচিত এবং এটি শেষ করার জন্য সম্পূর্ণ বাক্যটিকে পুনরায় নিজের মতো সাজাতে একটি ম্যাচিং শব্দ শেষে দিতে পারেন। মনে হয়, পুরো ভাষাটাই যেন কবিতার জন্য তৈরি।

তিন. বিশ্বব্যাপী প্রায় ২৭ কোটি ভাষাভাষীর সমন্বয়ে, বাংলা বিশ্বের সপ্তম ভাষা। এবং এটি বিশ্বের পঞ্চম বহুল ব্যবহৃত লিখন পদ্ধতি। ভারতের ২০১১ সালের আদমশুমারি অনুসারে, বাংলা ভারতের দ্বিতীয় সর্বাধিক কথ্য ভাষা।

চার. আমাদের প্রিয় বাংলা ভাষায় দু’টি দেশের জাতীয় সঙ্গীত লেখা হয়েছিল। ভারতীয় জাতীয় সঙ্গীতও প্রথম বাংলা ভাষায় লেখা হয়।

পাঁচ. এশিয়া মহাদেশ বাংলা ভাষা ও বাঙালির জন্যই প্রথম নোবেল পুরস্কার জিতেছে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৯১৩ সালে নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হন গীতাঞ্জলির কারণে। গীতাঞ্জলি, মূলত বাংলায় লেখা, পরে অনেক ভাষায় অনূদিত হয়। আর নোবেল পুরস্কার সংস্থা গীতাঞ্জলির ব্যাপারে বলেছিলো ‘তার গভীর সংবেদনশীল, তাজা এবং সুন্দর শ্লোক, যার দ্বারা, তিনি তার কাব্যিক চিন্তাকে পরিণত করেছেন, তার নিজস্ব ইংরেজি শব্দে প্রকাশ করেছেন, যা সাহিত্যের একটি অংশ।’

ছয়. আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস বাংলা ভাষার উপর ভিত্তি করে, ইউনেস্কো ১৯৯৯ সালে ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করে। এর একটি ইতিহাস এবং সমৃদ্ধ পটভূমি রয়েছে। বাংলাই পৃথিবীর একমাত্র ভাষা যার জন্য মানুষ ১৯৫২ সালে ঢাকায় ৫ জন এবং ১৯৬১ সালে ভারতের আসামে ১১ জন তাদের জীবন উৎসর্গ করেছিলেন।
এই ত্যাগ যেমন গৌরবের, অপর দিকে কিছু কষ্টের চিত্রও আছে।
একদিনের কথা, দেশের এক প্রান্ত থেকে বিমানে আসছিলাম। এক শিক্ষিত-সম্ভ্রান্ত পরিবারের কিশোর সন্তানের সিটটি আমার পাশেই। সে বুদ হয়ে আছে সোশ্যাল মিডিয়াতে। হাতে একটি কিশোর উপযোগী বাংলা বই দেয়ার চেষ্টা করলাম। কাষ্ঠ হাসি দিয়ে সে বললো, বাংলা পড়তে ও লিখতে জানে না। শুধু বলতে ও বুঝতে পারে। আমারতো গরিবানা হালত বই ছাড়া কাউকে কিছু দিতে পারি না। দেশের বাইরে কিছু প্রিয় পরিবারের কাছে ফররুখ শ্রেষ্ঠ শিশু-কিশোর সাহিত্য পাঠাতে চেয়েছিলাম তাদের সন্তানদের জন্য। তারা বিনয়ের সাথে বলেছেন, ওরাতো বাংলা পড়তে পারে না। কী করুণ অবস্থা, তাই না?
এই মুহূর্তে, কথা বলা, লেখাপড়া বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বছরে ৯টি বা প্রতি ৪০ দিনে একটি ভাষা মারা যাচ্ছে। ২০৮০ সাল নাগাদ, এ হার প্রতি বছর ১৬টি ভাষায় বৃদ্ধি পাবে। আগামী শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে, প্রতি বছর ২৬টি ভাষার হারে আমাদের ভাষাসমূহ মারা যাবে।
প্রশ্ন হতেই পারে, কেন একদিনের সমৃদ্ধ ভাষা সংস্কৃত একটি মৃত ভাষা হয়ে গেল? কারণ এটি শুধুমাত্র একটি নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল এবং ব্রাহ্মণরা সংস্কৃত জীবিত থাকাকালীন নিম্নবর্ণের হিন্দুদের এটি শিখতে বা ব্যবহার করতে দেয়নি। এমনকি বহুল প্রচলিত হিব্রু ভাষাও নানা কারণে মারা গেছে।
আর আমরা উচ্চবিত্তরা এটি শিখছি না। একদিন হয়তো মধ্যবিত্তরাও এতে শামিল হবে।

২০০৫ সাল থেকে ক্যামেরুনের বুসুউ ভাষায় কথা বলে মাত্র তিনজন মানুষ, এটি একটি বিপন্ন ভাষা হয়ে গেছে। কারণ এ জাতির নবীন সদস্যরা তাদের এই ঐতিহ্যের ভাষা তাদের প্রথম ভাষা হিসেবে আর শেখে না।
বাংলাকে অনেকে না বুঝেই কঠিন বলে। চাইনিজ ম্যান্ডারিন শেখার জন্য সবচেয়ে কঠিন ভাষা হিসেবে বিবেচিত হয়। চীনা ম্যান্ডারিন বর্ণমালা সম্পূর্ণরূপে প্রতীক দ্বারা গঠিত। গড় চীনা নাগরিকরা প্রায় ৮০০০টিরও বেশি চিহ্নের সাথে পরিচিত। এবং ৩০০০ চিহ্ন জানলে ন্যূনতম সংবাদপত্র পড়া যায়। আজকে কিশোর-তরুণদের শিক্ষা, জেনারেল আইকিউতে চীনারা পৃথিবীতে শীর্ষে এর পিছনে তাদের ভাষা অন্যতম কারণ। যেখানে বাংলাদেশের অবস্থান ১৫০তম।
আজকে ইংরেজি, হিন্দির বন্দনায় আমাদের মাতৃভাষা গভীর সঙ্কটে। অপর দিকে আরেক দল কলিজার খুনে ¯œাত বাংলাকে যেনতেনভাবে এক মৃতভাষা সংস্কৃতের দুহিতা বানাতে মহাব্যস্ত। তাই বোধ হয় বলে দুঃখিনী বর্ণমালা। গভীর সঙ্কটে আজ শুধু ভাষা নয় আমাদের সবুজ স্বদেশও।
কয়েক বছর আগে গিয়েছিলাম মানিকগঞ্জের সিঙ্গাইর উপজেলার নিভৃত পারিল গ্রামে। যেখানকার ২৬ বছরের টগবগে যুবক রফিক উদ্দিন আহমদ ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সবুজ চত্বরে ‘মায়ের মুখের ভাষা’র জন্য সর্বপ্রথম জীবন দিয়েছিলেন।

ফেনীর শহীদ আব্দুস সালামের বয়স ছিল ২৭, বরকতের ২৫, জব্বার আর শফিউরের ৩৩।
সিঙ্গাইরের ভাষা শহীদ রফিকের লাশ তার মা-বাবা খুঁজে পাননি, তাকে বেনামি দাফন করা হয়েছিল আজিমপুরের গোরস্থানে।
পুত্রশোক আর লাশ না পাওয়ার সে বেদনায় রফিকের বাবা সংসারধর্ম ত্যাগ করেন এবং ১০ বছরের মাথায় ইন্তেকাল করেন। আর মা হয়ে যান নিশ্চল বোবা।
কত কম বয়সেই না তারা এত বড় কুরবানি দিয়েছিলেন। যাদের ত্যাগের মহিমাতেই আমরা পেয়েছি প্রাণের মাতৃভাষার মর্যাদা।
রফিকের ভাই নিবির মমতায় চা খাওয়ালেন আর আমাদের বলেছিলেন এই সব করুণ আর্তনাদ।
আসলে ভাষা ও দেশ বিনির্মাণে যাদের গুরুত্বপূর্ণ অবদান তারা বেশির ভাগই তরুণ।
পাঁচ ভাষাশহীদ এবং সাতজন বীরশ্রেষ্ঠ এদের গড় বয়স ছিল মাত্র সাড়ে ২৮ বৎসর।
তাই বলছি, রফিক, জব্বার, বরকতের চেতনায় আবারো তারুণ্যকে জেগে উঠতে হবে। চাই শুদ্ধ ভাষার লড়াই।
প্রতিটি বাংলাদেশী হবে এই লড়াইয়ের সৈনিক, তাদের ঘর হবে দুর্গ। আর নিয়মিত শুদ্ধ ভাষাচর্চা হবে আমাদের যুদ্ধ-প্রশিক্ষণ। সকল নবী-রাসূলগণ যে জাতির কাছে এসেছেন সেই ভাষাতেই কথা বলেছেন। আর আমাদের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস-ঐতিহ্যের ধারক ভাষাকে বাঁচাতে হলে ভাষার এ লড়াইয়ে আমাদের জিততে হবে।

SHARE

Leave a Reply