Home প্রচ্ছদ রচনা বাংলা ভাষা খোদার সেরা দান -আহমদ মতিউর রহমান

বাংলা ভাষা খোদার সেরা দান -আহমদ মতিউর রহমান

মানুষকে বেঁচে থাকতে হলে মনের ভাব, সে কী ভাবছে, সে কারো কাছ থেকে কী চায় বা সে কাউকে কী দিতে চায় এগুলো প্রকাশ করতে হয়। তা না হলে আমরা বুঝবো কী করে কেউ কিছু একটা বলতে চাইছে, বুঝাতে চাইছে। এটাকে বলে ভাববিনিময়। একজনের ভাব আরেক জনের বুঝতে পারা। এই ক্ষেত্রে ভাষা- মানুষের ভাব বিনিময়ের সবচেয়ে কার্যকরী মাধ্যম। ভাষাকে বলা যায় মহান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর সবচেয়ে মূল্যবান একটি উপহার। এ মূল্যবান উপহারের মধ্যে আরও মূল্যবান হলো ‘মাতৃভাষা’। মাতৃভাষায় ভাব বিনিময় যে কত মধুর তা কখনো লেখনীর মাধ্যমে প্রকাশ করা সম্ভব নয়। কবি ফররুখ আহমদ তাইতো বলেছেন-
“ও আমার মাতৃভাষা বাংলা ভাষা খোদার সেরা দান,
বিশ্ব ভাষার সভায় তোমার রূপ যে অনির্বাণ।”

আমাদের জন্য বাংলা ভাষা সত্যিই তো খোদাতায়ালার সেরা দান। কত গান কত কবিতা কত সাহিত্য রচিত হয়েছে এই ভাষাতে। শুধু তাই নয় বিশ্ব ভাষার সভায় জনসংখ্যার বিচারে বাংলা ভাষার স্থান সপ্তম স্থানে। সারা পৃথিবীতে শত শত ভাষা চালু আছে। সেখানে ৭ নম্বরে থাকা এটাই প্রমাণ করে এটা একটা প্রাণবন্ত জীবন্ত ভাষা। কিন্তু এ ভাষাকে প্রতিষ্ঠিত করতে আমাদের পাড়ি দিতে হয়েছে একটা রক্তাক্ত পথ। আজ সে কথাই তোমাদের বলবো।

বেছে নিতে হলো সংগ্রামের পথ
আমাদের এই দেশে মাতৃভাষায় সব কিছু করার অধিকার কিন্তু এমনি এমনি আদায় হয়নি। বাংলা ভাষাকে প্রতিষ্ঠিত করতে অনেক সংগ্রাম করতে হয়েছে। পাকিস্তানের জাতির পিতা কায়েদে আজম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ থেকে শুরু করে শাসকবর্গ বারবার পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা উর্দু হবে বলে ঘোষণা দেন। এটা মানতে পারেননি এ অঞ্চলের মানুষ। কারণ তারা উর্দু জানতেন না। ফলে বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার জন্য সংগ্রাম করতে হয়েছে, রক্ত দিতে হয়েছে। ১৯৫২ সালের ৮ ফাল্গুন, ২১ ফেব্রুয়ারি হচ্ছে সেই রক্ত দেয়ার দিন। ১৯৪৮ সালে ভাষার দাবিতে আন্দোলনের সূচনা হয়। ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের একদল তরুণ শিক্ষক গড়ে তুললেন তমদ্দুন মজলিশ নামক সংগঠন। তাদের প্রাণপুরুষ ছিলেন বিজ্ঞান অনুষদের প্রভাষক আবুল কাশেম। তার সাথে এসে জুটলেন অনেকেই। তারা একটি পুস্তিকা প্রকাশ করে বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি জানালেন, যুক্তি দিয়ে বুঝালেন। কিন্তু শাসকরা তা বুঝতে চাইলেন না। তারা উর্দুকে চাপিয়ে দিলেন ভুখানাঙ্গা বাঙালি কৃষক মুটে মজুরের উপর। তারা তো উর্দু জানে না। স্কুল কলেজের কোমলমতি ছাত্রদের জন্যও সেটা সমস্যা হয়ে উঠলো। চাকরির পরীক্ষায়, ডাক টিকিটে, মানি অর্ডার ফরমে বাংলা থাকলো না। তা রুখে দিতে তমদ্দুন মজলিসের দেখানো পথে জড়ো হতে থাকলো অনেকেই। এমন করতে করতে ১৯৪৮, ৪৯, ৫০, ৫১ পেরিয়ে অবশেষে ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি বিস্ফোরণ ঘটলো। ছাত্ররা শিক্ষকরা, সাধারণ মানুষ যোগ দিলো সেই বিক্ষোভে। এখনকার ঢাকা মেডিক্যালের সামনে সেই দিন মিছিলে গুলি চললে অন্তত ৬ জন শহীদ হলেন। হয়তো আরো কেউ থেকে থাকতে পারেন যাদের নাম আমরা জানি না। এত দিন আমরা জানতাম ৫ জন শহীদের কথা। কিন্তু সে দিন একটি কিশোরও প্রাণ দিয়েছিল। বরকত, সালাম, রফিক, শফিউর, জব্বারের সাথে যোগ হয়েছে কিশোর অহিউল্লাহর নাম। আমি আমার লেখা বই ‘ভাষা আন্দোলনে পাঁচজন শহীদের জীবন কথা’ বইয়ে ২০১৮ সালে অহিউল্লাহর শাহাদাতের কথা উল্লেখ করি। কোন কোন সূত্রে তার নাম অলিউল্লাহ বলা হয়েছে। একজন কিশোর বাংলা ভাষার জন্য জীবন দিয়েছে এটা তোমরা যারা কিশোর তাদের জন্য গৌরবের কথা বৈকি।
এই মাতৃভাষার সম্মান রাখতে গিয়ে দেশে দেশে লড়াই-সংগ্রাম কম হয়নি। সেসব লড়াইয়ের মধ্যে বাঙালির আত্মদান পুরো পৃথিবীর ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লিখিত আছে এবং থাকবে। বাঙালি তাদের মাতৃভাষাকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় মর্যাদাবান করতে রক্ত ঝরিয়েছে, জীবন বিলিয়ে দিয়েছে, সৃষ্টি করেছে আত্মত্যাগের মহান ইতিহাস। যে ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় পরবর্তীতে সৃষ্টি হয় নতুন একটি জাতিরাষ্ট্র- স্বাধীন, সার্বভৌম বাংলাদেশ। আর বাংলা ভাষা স্বীকৃতি পেয়েছে জাতিসঙ্ঘের অন্যতম দাফতরিক ভাষা হিসেবে। পরে একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ঘোষণা করে ভাষাশহীদের শাহাদাতের দিনটিকে পৃথিবীব্যাপী স্মরণীয় দিন করা হয়। এ অর্জন একান্ত আমাদের। বাংলা ভাষার জন্য রক্ত ঢালার দিন ২১ ফেব্রুয়ারিকে জাতিসংঘ ২০০০ সালে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। এর মধ্য দিয়ে আন্তর্জাতিকভাবে মনোযোগ তৈরি হয়েছে দুনিয়ার সবার মাতৃভাষাকে স্বীকৃতি ও গুরুত্ব দেওয়ার।

আমাদের সাহিত্যে ভাষা আন্দোলন
বলছিলাম কবি ফররুখের কথা। তিনি অনেক লেখায় বাংলা ভাষার মাহাত্ম্য তুলে ধরেছেন। ভাষার গান তেমন একটি কবিতা। এটা পরে গানও হয়েছে। ফররুখ আহমদ লেখেন-
ডালে ডালে পাখির বাসা/ মিষ্টি মধুর পাখির ভাষা/ সাত সাগরে নদীর বাসা/ কুলুকুলু নদীর ভাষা।/ হাজার সুরে হাজার ভাষায় এই দুনিয়া ঘেরা/ আর মাতৃভাষা বাংলা আমার সকল ভাষার সেরা।/ এই ভাষাতে শিশু দোলে/ ছড়ার সুরে মায়ের কোলে/ এই ভাষারি কলরোলে/ কিসসা কথা দুয়ার খোলে,/ ব্যঙ্গমী আর ব্যঙ্গমারা করে চলাফেরা/ ও ভাই মাতৃভাষা বাংলা আমার সকল ভাষার সেরা॥/ খোকা-খুকু এই ভাষাতে / লেখন লেখে পাঠশালাতে।/ জ্ঞানী গুণী এই ভাষাতে / লেখন লেখেন দিনে রাতে,/ ভাবের মানিক রতন দিয়ে ভরান ভাষার ডেরা / ও ভাই মাতৃভাষা বাংলা আমার সকল ভাষার সেরা।
পাকিস্তান অর্জনের পর পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বা সরকারি ভাষা নিয়েও বুদ্ধিজীবী মহলে আলাপ-আলোচনা চলতে থাকে। এরই এক পর্যায়ে তমদ্দুন মজলিস বাংলা ভাষার পক্ষে দাঁড়ায়, সে কথা আগেই বলেছি। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আগে কবি ফররুখ আহমদ ‘উর্দু বনাম বাংলা’ শীর্ষক কবিতায় রাষ্ট্রভাষা বাংলার সপক্ষে দৃঢ় মনোভাব ব্যক্ত করেন। এটি ছিলো ভাষা আন্দোলনের পক্ষে প্রথম ব্যঙ্গ কবিতা। কয়েকটি পঙক্তি এমন- ‘দুইশ’ পঁচিশ মুদ্রা সে অবধি হয়েছে বেতন/ বাংলাকে তালাক দিয়ে উর্দুকে করিয়াছি নিকা/ বাপান্ত শ্রমের ফলে উড়িয়েছে আশার চামচিকা/” ফররুখ ভাষার সপক্ষে শুধু কবিতা নয়, প্রবন্ধও লিখেন। ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট লিখিত এবং পরবর্তী মাসে ‘মাসিক সওগাত’ পত্রিকায় প্রকাশিত ‘পাকিস্তান রাষ্ট্রভাষা ও সাহিত্য’ শীর্ষক এক নিবন্ধের প্রথম দিকে তিনি বলেন, ‘এটা দৃঢ়ভাবেই বলা যায় যে, বাঙলা ভাষাই পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে’।
বায়ান্নর একুশে ফেব্রুয়ারির পর থেকে আমাদের সাহিত্য জগতে সৃষ্টির নতুন মাত্রা যোগ হয়েছে। ভাষাশহীদদের অমর, অজেয়, অক্ষয়, অমলিন স্মৃতিগাথা নিয়ে প্রতি বছর বাংলা সাহিত্য নব নবরূপে সজ্জিত হয়। বাংলা সাহিত্যের এমন কোনো শাখা নেই যেখানে একুশের ছোঁয়া লাগেনি। ভাষা আন্দোলন, ভাষা শহীদ, বাংলা ভাষাকেন্দ্রিক অসংখ্য ছড়া, কবিতা, গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ, নাটক, পত্রিকা, লিটল ম্যাগ ইত্যাদি প্রকাশ হতে থাকে বছর বছর। ভাষা আন্দোলন তথা একুশে ফেব্রুয়ারিকে কেন্দ্র করে আমাদের দেশে একটি সাংস্কৃতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক আবহ ও আন্দোলন গড়ে উঠেছে। ভাষা আন্দোলনের চেতনাঋদ্ধ প্রতিষ্ঠান বাংলা একাডেমি আয়োজিত সাংবার্ষিক ফেব্রুয়ারি মাসব্যাপী অমর একুশে গ্রন্থমেলায় তিন থেকে চার হাজার নতুন বই আসে। বিশ্বে গ্রন্থমেলার ইতিহাসে এমন দীর্ঘ সময়ব্যাপী মেলা আর কোথাও হয় না। একুশে গ্রন্থমেলায় দেড়-দুই কোটি টাকার বা তারও বেশি মূল্যের বাংলা ভাষায় রচিত ও অনূদিত বই বেচাকেনা হয়, যা সত্যিই নজিরবিহীন।
এদিকে একুশের শহীদদের ওপর প্রথম কবিতা লেখেন মাহবুবুল আলম চৌধুরী। শিরোনাম ছিল ‘আমরা এখানে কাঁদতে আসিনি’। এর কয়েকটি লাইন- “এখানে যারা প্রাণ দিয়েছে/ রমনার ঊর্ধ্বমুখী কৃষ্ণচূড়ার তলায়/ সেখানে আগুনের ফুলকির মতো/ এখানে ওখানে জমছে অসংখ্য রক্তের ছাপ/ সেখানে আমি কাঁদতে আসিনি।” একুশে হত্যাকাণ্ডের তাৎক্ষণিক প্রতিবাদে এ কবিতা বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে এক উজ্জ্বল মাইলফলক। এটি যেমন একুশের প্রথম কবিতা, তেমনি ভাষা আন্দোলনে অনুপ্রাণিত কবিতায় প্রথম প্রতিবাদ। এই প্রতিবাদ আমাদের সাহিত্যে এনেছে স্বাধীনতার, গণতন্ত্রের অধিকারের চেতনা। পরে আমাদের সকল কবি সাহিত্যিক বাংলা ভাষার এই আন্দোলন ও অমর একুশে নিয়ে সাহিত্য রচনা করেছেন।

দেশে দেশে ভাষা সংগ্রাম
১৯৪৭ সালে ভারত স্বাধীন হলে ভারতের রাষ্ট্রভাষা উর্দু না হিন্দি হবে এ নিয়ে প্রথমে দ্বন্দ্ব ছিল। জানা যায় জওহর লাল নেহরুসহ কংগ্রেসের অনেক নেতাই উর্দুর পক্ষে ছিলেন। অন্যদিকে দক্ষিণাঞ্চলের কয়েকটি প্রদেশের লোকেরাও হিন্দির ঘোর বিরোধী ছিল। তারা ভাষার প্রশ্নে প্রাণও দিয়েছে। শেষে হিন্দি প্রায় নিশ্চিত হলে বিভিন্ন স্থানে আন্দোলন দানা বাঁধে।
পৃথিবীর আরও অনেক জাতি ভাষার জন্য বুকের রক্ত ঝরিয়েছে এবং জীবন দিয়েছে। ভারতের আসাম প্রদেশেও বাংলা ভাষার জন্য জীবন দিয়েছিলেন ১১ জন। স্বাধীন ভারতে বাংলা ভাষাকে আসামে প্রাদেশিক ভাষা করার দাবিতে ১৯৬১ সালে যে আন্দোলন হয়েছিল, তাও ইতিহাসে বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ । আসাম প্রদেশে অসমিয়াকে একমাত্র প্রাদেশিক ভাষা হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়া হলে সরকারের এই অবিচারের প্রতিবাদে বাংলা ভাষাভাষীরা রাস্তায় নেমে আসে। গড়ে তোলে আন্দোলন। সেই আন্দোলনে সামরিক বাহিনী গুলি চালালে ঘটনাস্থলেই মারা যান ৯ জন। পরে বুলেটবিদ্ধ আরও দু’জন হাসপাতালে মারা যান। এই ঘটনার পর ভারতজুড়ে প্রতিবাদের ঝড় উঠে এবং আসাম রাজ্য সরকার বাধ্য হয়ে অসমিয়াকে একমাত্র প্রাদেশিক ভাষা করার আইন বাদ দিয়ে বাংলাকেও অন্যতম প্রাদেশিক ভাষা হিসাবে সাংবিধানিক স্বীকৃতি দেয়।
তামিলনাড়ুতে তামিল ভাষার জন্য যে রক্তপাত ঘটেছে, তা পৃথিবীতে নজিরবিহীন। নিঃসন্দেহে মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষায় বাঙালির আত্মত্যাগ পুরো পৃথিবীর ইতিহাসে অনন্য। ভাষা নিয়ে কিংবা মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষায় ভারত, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, লাটভিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকাসহ পৃথিবীর নানা জায়গায় সংগ্রাম হয়েছে, মানুষ জীবন উৎসর্গ করেছে। প্রথমেই আমরা চোখ দিতে পারি, আমাদের পার্শ্ববর্তী ভারতের দিকে। ভারতের ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস দেশটির স্বাধীনতারও আগের। ১৯৩৭ সালে মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সির স্থানীয় কংগ্রেস সরকার স্কুলে হিন্দি শিক্ষা বাধ্যতামূলক করলে ভাষা নিয়ে প্রথম আন্দোলন শুরু হয়। ১৯৩৯ সালে দুই আন্দোলনকারী পুলিশি হেফাজতে মারা গেলে আন্দোলন চূড়ান্ত আকার ধারণ করে। অবশেষে তুমুল প্রতিবাদের মুখে মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সি সরকার হিন্দিকে বাধ্যতামূলক বিষয় হিসেবে পড়ানোর সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসে। ভাষাকে কেন্দ্র করে ভারতে সবচেয়ে বড় প্রতিবাদ-সংগ্রাম হয় ১৯৬৫ সালে। তবে এর সূচনা ১৯৫০-এ, তখন হিন্দিকে একমাত্র সরকারি ভাষা হিসেবে ঘোষণা করে আইন পাস হলেও তখন তেমন কোনো প্রতিবাদ বা আলোচনা দেখা যায়নি। ১৯৬৫-তে এসে আইনটি কার্যকর হলে শুরু হয় প্রতিবাদ-সংগ্রাম। শুরু হয় তীব্র আন্দোলন। প্রায় দুই মাস যাবৎ দাঙ্গা হয় মাদ্রাজে। পরবর্তীতে আন্দোলনের মুখেই ১৯৬৭ সালে হিন্দির সঙ্গে ইংরেজিকেও ব্যবহারিক সরকারি ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়। এখনো ভারতে আইনগতভাবে ‘রাষ্ট্রভাষা’ কিংবা ‘জাতীয়ভাষা’ পরিভাষা ব্যবহার করা হয় না। বর্তমানে ভারতে ২২টি ভাষাকে সরকারি ভাষা এবং ৪টি ভাষাকে ঐতিহ্যবাহী ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে।
দক্ষিণ আফ্রিকার ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে ৫২-এর বাংলা ভাষা আন্দোলনের কিছুটা মিল পাওয়া যায়। দুটো আন্দোলনের মূলে ছিল ছাত্ররা। তবে পার্থক্য হলো বাংলাদেশে নেতৃত্বে ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও ছাত্ররা আর দক্ষিণ আফ্রিকার নেতৃত্বে ছিল স্কুলের ছাত্ররা। দক্ষিণ আফ্রিকার গাউটাং এর জোহানেসবার্গ শহরের সোয়েটোতে এই আন্দোলন চূড়ান্ত পর্যায়ে গিয়েছিল ১৯৭৬ সালের ১৬ জুন। গাউটাং কর্তৃপক্ষ আফ্রিকানার ভাষায় শিক্ষাদান স্কুলে বাধ্যতামূলক করলে স্কুলের শিশু-কিশোররা প্রতিবাদ জানাতে রাস্তায় নেমে আসে। কারণ তারা তাদের মাতৃভাষা জুলু এবং ব্যবহারিক লিঙ্গুয়া ফ্রাঙ্কা ইংরেজিতে শিক্ষা নিতে বেশি আগ্রহী ছিল। তৎকালীন বর্ণবাদী সরকার প্রতিবাদ সভায় গমনরত ছাত্রদের মিছিলে গুলি করলে ২০ জনেরও অধিক মানুষ নিহত হয়, যাদের প্রায় সবাই শিশু-কিশোর! কোমলমতি শিশুদের আত্মত্যাগের খবর দাবানলের মতো সোয়েটো থেকে ছড়িয়ে পড়ে পাশের শহর প্রিটোরিয়া, ডারবান ও কেপটাউনে। ১৯৭৬ সালের এই আন্দোলনে দেশটির বিভিন্ন অঞ্চলে প্রায় ৪৫১ জন মারা যায়। এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে বর্ণবাদী সরকারের উদ্যোগ ভেস্তে যায় এবং আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেসের কার্যক্রম বেগবান হয়। দক্ষিণ আফ্রিকায় আজো দিনটি বিশেষ স্মৃতির মধ্য দিয়ে পালন করা হয়।
কানাডার পূর্ব অংশের অঙ্গরাজ্য কুইবেকের রাজনীতিতেও ভাষা গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু। কুইবেক রাজ্যের ফ্রেঞ্চবাসী স্বতন্ত্র রাষ্ট্র চাওয়ার দরুন ভাষার প্রশ্নে স্বাধীনতা চেয়েছিল। ফলে ১৯৮০ সালে এবং ১৯৯৫ সালে দুই দফায় ভাষা নিয়ে আন্দোলন হয়। সে আন্দোলনের তীব্রতা কমে গেলেও তাদের ‘স্বাধীনতা এবং জাতীয়তাবাদী আন্দোলন’ থেমে যায়নি। ভাষার প্রশ্নে লাটভিয়ানদের ভূমিকাও ইতিহাসে এক বিশেষ গুরুত্বের দাবি রাখে। রুশ ভাষাকে দ্বিতীয় দাফতরিক ভাষা করার প্রশ্নে ২০১২ সালে গণভোট অনুষ্ঠিত হয়। গণভোটে রুশ ভাষাকে প্রত্যাখ্যান করেন লাটভিয়ানরা। যদিও রুশ সাম্রাজ্য এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের অংশ থাকাকালে কয়েক শ’ বছর ধরে রুশ ভাষাই ছিল লাটভিয়ার প্রধান ভাষা। বেলজিয়ামে ফ্রেঞ্চ-জার্মান-ডাচ ছাড়া ইউরোপের বলকান অঞ্চল, স্পেনের বিভিন্ন অঙ্গরাজ্য, আফ্রিকার গোল্ড কোস্ট অঞ্চলের বিভিন্ন ভাষা নিয়ে বিভিন্ন সময় দফায় দফায় আন্দোলন হয়েছে। ঊনবিংশ শতাব্দীতে পুরো মধ্যপ্রাচ্য আরবি-ফারসি-তুর্কি কিংবা তৎকালীন মেক্সিকোর উত্তরাংশে আন্দোলন হয়েছে স্প্যানিশ-ইংরেজি নিয়ে। এমনই অসংখ্য লড়াই সংঘটিত হয় মায়ের ভাষা-মাতৃভাষাকে মর্যাদাবান করার, যা ইতিহাসে বিশেষ স্থান করে আছে। ১৮ শতকে বুলগেরীয়দের ভাষা আন্দোলন অন্যতম। বুলগেরীয় জনগণ তৎকালীন সরকারের বিরুদ্ধে বুলগেরীয় ভাষার রাষ্ট্রীয় অধিকার আদায়ের সংগ্রামে লিপ্ত হয়েছিল। ভাষার জন্য এ রকম আরো সংগ্রাম ও ইতিহাসের খোঁজ পাওয়া যায় সময়ের প্রতিটি স্তরে।

একুশে কেন সেরা অর্জন?
মায়ের ভাষা-মাতৃভাষা রক্ষা কিংবা মর্যাদাবান করার দেশে দেশে যে লড়াই-সংগ্রাম-আন্দোলন হয়েছে সেখানে ১৯৫২ সালের বাংলা ভাষা আন্দোলন এক অনন্য ঘটনা। এই আন্দোলনের বিশেষত্ব হলো- এর মাধ্যমে সৃষ্টি হয়েছিল বাঙালির জাতীয় চেতনা; যার চূড়ান্ত ফল পৃথিবীর বুকে বাংলাদেশ নামে একটি স্বাধীন জাতিরাষ্ট্রের। তাই বাঙালি জাতির সহস্র বছরের ইতিহাসে ৫২-এর ভাষা আন্দোলনের গুরুত্ব অপরিসীম। একুশের চেতনার প্রভাব থেকেই ছয় দফা, ছাত্রদের ১১ দফা ও মওলানা ভাসানীর ১৪ দফা- যার সম্মিলিত ফলই হলো ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান। আর চূড়ান্ত ফল একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধ এবং স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়। মানুষের সাংস্কৃতিক বিকাশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হলো ভাষা। সভ্যতার ক্রমবিকাশে ভাষাকে অবহেলা করার কোনো সুযোগ নেই। মানুষের জন্ম ও বিকাশের সঙ্গে তার মাতৃভাষার প্রত্যক্ষ সংযোগ রয়েছে। শোক-ক্ষোভ-আনন্দ-উচ্ছলতায় মানুষের সব অনুভূতির সত্যিকার প্রকাশ ঘটে তার মাতৃভাষাতেই। তাই বলা হয়ে থাকে- কোনো জাতিকে ধ্বংস করতে চাইলে প্রথমেই তার ভাষার ওপর আঘাত হানতে হবে। সেই ধারাবাহিকতায় পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীও আমাদের ভাষার ওপর আঘাত করে। তার প্রতিবাদে বুকের রক্ত দিয়ে আমরা আমাদের মাতৃভাষার মর্যাদা আদায় করে নিয়েছি।

শেষ কথা
কাল পরিক্রমায় অনেক কিছু আমরা ভুলে যেতে বসেছি। উর্দু বিদায় হয়েছে কিন্তু সত্যিকার অর্থে বাংলা প্রতিষ্ঠিত হয়নি। আমাদের শাসকদের ব্যর্থতাই বড় বাধা। বাংলাদেশে এ বিষয়ে এখনো কার্যকরী রাষ্ট্রীয় মনোযোগ তৈরি হয়নি। এখন ইংরেজির দাপট সবখানে। অথচ এটা হওয়া উচিত ছিল না। উচ্চ শিক্ষার মাধ্যম বাংলা নয়, বাংলায় বিচারকরা রায় লেখেন না, ডাক্তারি ইঞ্জিনিয়ারিং বাংলায় পাস করা চলে না। কারণ পুস্তক অনুবাদ করা হয়নি। ঢাকা শহরের অভিজাত এলাকায় এখন বাংলা সাইন বোর্ড পাওয়া দুষ্কর। বাংলা সালও বঞ্চিত হয়েছে যোগ্য সম্মান থেকে। অনেকে জানেই না দিনকার বাঙলা মাস ও তারিখ। এটা হওয়ার কথা ছিল না। এ অবস্থা পরিবর্তন করে বাংলাকে আক্ষরিক অর্থে রাষ্ট্রভাষা না করে বাস্তবিক অর্থেই কাজে লাগানো প্রয়োজন। এটা এখন সময়ের দাবি। তা না হলে একুশের চেতনা একটি দিনের মাঝেই সীমাবদ্ধ থাকবে। প্রতিদিনের হবে না।

SHARE

Leave a Reply