Home গল্প পড়ুয়া -মাহমুদ শরীফ

পড়ুয়া -মাহমুদ শরীফ

ফরহাদ হোসেন যেন বড্ড বিপদে পড়লেন। বিপদই বটে। কেননা, ব্যস্ত মহানগরী ঢাকাতে বহিরাগতদের ক্ষেত্রে নানাবিধ অসুবিধার মধ্যে টাকার নোট ভাংতি করা একটা বড়ো বিপদ না হলেও চরম অসুবিধা বৈকি! কারো কাছে টাকার নোট ভাংতিটা চাওয়া যেন অন্যায় আর অপরাধের মতো কিছু। ফরহাদ সাহেব দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভাবছেন- কোথায় শত টাকার নোটটা ভাংতি পাওয়া যায়? ওদিকে রিকশাওয়ালা বারবার তাগাদা দিচ্ছে টাকা নিয়ে সরে যাওয়ার জন্য।
অবসরপ্রাপ্ত বৃদ্ধ শিক্ষক ফরহাদ সাহেব ৫০ টাকা ভাড়া মিটিয়ে গুলিস্তান থেকে মগবাজার এসেছেন। দূর সম্পর্কের এক ভাতিজার বাসায় উঠবেন। কাল সকালে শিক্ষা ভবনে যাবেন তিনি। রিকশাওয়ালার কাছে নাকি ভাংতি টাকা নেই। থাকলেও বেশি নেওয়ার ধান্দায় ‘খুচরা টাকা নেই’ বলে ওরা সচরাচর ছলনা করে। রিকশাওয়ালা যেন সকল কাজের কাজী! কত কাজের তাড়া তার! তাড়াতাড়ি দেন! ভাড়া না হলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকে, আবার এখন তর সইছে না। এক শত টাকার নোটটা হাতে নিয়েই সাফ জবাব- ‘স্যার, ভাংতি নেই। কী করি?’
রিকশাওয়ালা নিজে কোথাও থেকে ভাংতি করে নিতে নারাজ। ভাবখানা এমন ফরহাদ সাহেব নোটটা পুরো দিয়েই চলে যাক আর কী! কিন্তু ফরহাদ হোসেন এক টাকাও বেশি দিতে রাজি নয়। আবার টাকা ভাংতিরও ঝামেলা। এখন উপায়? ইতোমধ্যে দু’-এক কথা জোরেশোরেই হয়ে গেল তাদের মধ্যে। ফরহাদ সাহেব বলছেন টাকা ভাংতি করে নিতে, আর রিকশাওয়ালা তাগাদা করছে ভাংতি করে দিতে, নয় তো এক শত টাকাই দিয়ে যাও বাপু!
এমন পরিস্থিতিতে কোনো সমাধানের পথ দেখছেন না ফরহাদ হোসেন। আবার রিকশাওয়ালা তাগাদা করছে ‘কী হলো স্যার, ভাংতি করে দেন। বেশিক্ষণ দাঁড় করিয়ে রাখলে ভাড়া বেড়ে যাবে কিন্তু।’
‘দাঁড় করিয়ে রাখলে ভাড়া বেড়ে যাবে’ কথাটা শুনে ফরহাদ সাহেবের রাগ চরমে উঠে গেল। এমনিতেই রাতের বাসে ঢাকা এসে ঘুম হয়নি, গোসল-খাওয়াও ঠিক মতো না হওয়ায় মেজাজ খিটমিট করছে। তার পর রিকশাওয়ালার চাপাবাজি! আরে ব্যাটা! ভাড়া নিবি তুই, আর টাকা ভাংতি করে দেবো আমি! তোর কাছে কেন খুচরা টাকা থাকে না? আবার কী না বলে ‘দাঁড় করিয়ে রাখলে বেশি ভাড়া!’ এটা কি মগের মুল্লুক? অন্য দিকে রিকশাওয়ালাও কম ঝানু নয়, ভাংতি করে এনে ভাড়া দেন, ভাংতি ছাড়া রিকশায় উঠেছেন ক্যান? মহামুশকিল!
এমন সময় পাশ থেকে কে যেন সালাম ঠুকে দিলো অপ্রত্যাশিতভাবে। ফরহাদ হোসেন ঘাড় ফিরে তাকাতেই যুবক ছেলেটি বলল : কেমন আছেন স্যার?
ফরহাদ সাহেব আশ্চর্য হয়ে জানতে চান : তুমি কে বাবা? তোমাকে তো ঠিক চিনতে পারলাম না। চশমা খুলে পাঞ্জাবির আঁচলে মুছতে থাকেন তিনি।
যুবক ছেলেটি চট করে উত্তর দেয়- আমাকে চিনতে পারছেন না স্যার? ফরহাদ সাহেব চশমা চোখে লাগিয়ে শাহিনের আপাদমস্তক প্রত্যক্ষ করতে থাকেন- স্মরণ করতে চেষ্টা করেন ছেলেটিকে কোথাও দেখেছিল কি না। হ্যাঁ, মনে পড়েছে। শাহিন, তারই ছাত্র। মেধাবী ছাত্র ছিল। মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে শাহিন তার ছাত্র ছিল।
‘তা তুমি এখানে কী করছো বাবা?’ শাহিন উত্তর দেয়- উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার পর ঢাকায় চলে এসেছি। ভর্তি হয়েছি জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে। পড়াশুনার ফাঁকে ৩-৪ ঘণ্টা রিকশা চালাই। আগে টিউশনি করতাম, করোনার কারণে তা বন্ধ হয়ে গেছে। বাধ্য হয়েই রিকশা চালাই। পড়ালেখার পাশাপাশি এখন নিজের খরচ চালিয়ে প্রতি মাসে ২-৩ হাজার টাকাও বাড়িতে মায়ের কাছে পাঠাই। আপনি কোথায় যাবেন স্যার? আসুন। আমার রিকশায় পৌঁছে দিচ্ছি। বলেই শাহিন স্যারের হাত ধরে টানতে উদ্যত হয়।
ফরহাদ হোসেন বলেন, তুমি বাপু আগে এই শ’ টাকার নোটটা ভাংতি করে দাও। ওকে বিদায় করি। টাকা ভাংতি না থাকায় ৫০ টাকা ভাড়া দিতে পারছি না। কথা শেষ না হতেই শাহিন দুটো ৫০ টাকার নোট বের করে দেয়। চলে যায় রিকশাওয়ালা।
শাহিন জিজ্ঞেস করে- এবার বলুন স্যার, কোথায় যাবেন?
এখন আর কোথাও যাবো না। তা তোমার বাড়িটা যেন কোথায়? ঠিক মনে করতে পারছি না। আর বয়সের ভারে সব স্মরণও থাকে না। অবসরকালীন টাকার জন্য শিক্ষা অধিদফতরে ঘুরতে ঘুরতে কাহিল হয়ে গেলাম।
স্যারের ঢাকা আগমনের হেতু জানতে শাহিনের আর অসুবিধা হয় না। সে জানায়, স্যার আমার নাম শাহিন। বাড়ি কেশবপুর। কুমারখালী শহরের দক্ষিণের গড়াই তীরের গ্রাম। বছর তিনেক হলো ঢাকায় এসেছি। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির প্রথম বছরেই বাবা মারা গেল। সংসারের আয়- রোজগার করার মতো কেউ নেই। লেখাপড়া আর রিকশা চালানো আমার রুটিন। কারোর আর্থিক সাহায্য আমি পছন্দ করি না। টিউশনি গেলেও রিকশা এখন আমার আয়ের উৎস। বাড়িতে ছোটো একটা বোন আছে, ক্লাস সেভেনে পড়ে। মা ও বোনটির জন্য বাড়িতে প্রতি মাসে যে টাকা পাঠাই তাতেই চলে যায় কোনো রকম। ভাবছি মাস্টার্স শেষ করেই তারপর চাকরি বাকরির খোঁজ করবো। চলুন স্যার, আগে আমার মেসে চলুন।
বলতে বলতে শাহিন তার শ্রদ্ধেয় হাইস্কুল শিক্ষককে হাত ধরে রিকশায় বসিয়ে দেয়। ফরহাদ সাহেবের আপত্তি সত্তে¡ও শাহিন মেসের উদ্দেশে যাত্রা করে। শাহিনের পা দুটো নির্দিষ্ট তালে রিকশার প্যাডেলের সাথে কসরত করছে। মাঝে মধ্যে বেল বাজছে টুংটাং শব্দে। কখনো অনেকটা দাঁড়িয়ে আবার কখনো সিটে বসে রিকশা টানছে শাহিন। রিকশা টানতে যেন কোনো কষ্টই অনুভূত হচ্ছে না ওর। বেশ আনন্দই লাগছে একজন প্রিয় শিক্ষককে সে আপ্যায়নের জন্য মগবাজার থেকে রামপুরা নিয়ে চলেছে। নিজেকে ধন্য মনে করছে শাহিন। একাগ্রচিত্তে সে রিকশা টানছে।
রিকশায় বসে ষাটোর্ধ্ব অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক ফরহাদ হোসেন শাহিনের দিকে তাকিয়ে ভাবতে থাকেন। পিতৃহীন এই ছাত্রটি কতই না আত্মনির্ভরশীল, ভবিষ্যতের কথা, জীবনের কথা, নিজের পায়ে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার কথা ভেবে সে রিকশা চালাতেও কুণ্ঠাবোধ করছে না। এই আদর্শবান শ্রমিক পড়–য়া ছাত্রটির মর্যাদাপূর্ণ জীবন গড়ে তোলার জন্য যে আপ্রাণ চেষ্টা- সেটা একদিন অবশ্যই সফল হবে, এটা নিশ্চিত বলা যায়।
ফরহাদ সাহেব আরো ভাবেন, আমাদের ঘুণে ধরা সমাজের দরিদ্র অসহায় যুবকেরা যদি অন্যায় আর মাদকের নেশায় ডুবে না থেকে, দেশ জাতি সমাজ আর পরিবারের জন্য এমন কাজেও নিয়োজিত থাকতো- তাহলে কিছুতেই সমাজটা হতো না কলুষিত। ছাত্ররা পাস করার জন্যই আজ ‘জীবনের উদ্দেশ্য’ আর ‘জীবনের লক্ষ্য’ রচনা পড়ে, পরীক্ষার খাতায়ও লেখে, কিন্তু বাস্তবতা উপলব্ধি করে না। শাহিনের মতো এমন আদর্শে অনুপ্রাণিত হলেও বেকার যুবকেরা পরিবারের গলগ্রহ হতো না। করতো না পরগাছার মতো অনিশ্চিত ঝুলন্ত জীবনযাপন। সমাজ ও সংসারে আসতো না দুঃখ দুর্দশা। কাজের প্রতি ঘৃণা না করে যদি সবাই কোনো না কোনো কাজে নিজেকে সম্পৃক্ত করতো, তাহলে অবশ্যই থাকতো না অভাব-অনটন। পরিবারে নেমে আসতো শান্তির পরশ। সুখে দিন কাটতো সবার।
: নামুন স্যার, এসে গেছি।
শাহিনের কথায় শিক্ষক ফরহাদ হোসেনের ভাবনায় ছেদ পড়ে। সম্বিত ফিরে আসে। শ্রমিক পড়–য়া ছাত্রের হাতটা ধরে নেমে পড়েন রিকশা থেকে। ধীর কদমে এগিয়ে যান শাহিনের রুমের দিকে। হ

SHARE

Leave a Reply