আনন্দপুর স্কুলের চতুর্থ শ্রেণির শিক্ষার্থী তাবাসসুম। আজ শুক্রবার, ছুটির দিন। তাই পড়ার টেবিলে বসে কবিতা পড়ছে তাবাসসুম।
‘সবুজ পাতার খামের ভেতর
হলুদ গাঁদা চিঠি লিখে,
কোন পাথারের ওপার থেকে
আনল ডেকে হেমন্তকে?’
ঠিক তখন ওর মাথায় হাত রাখল দিদা। আজই গ্রাম থেকে এসেছেন। কয়েকদিন থাকবেন তাবাসসুমদের বাড়িতে। দিদা থাকলে ওর ভালোই লাগে। কত্ত কত্ত গল্প বলেন। দিদা তো অনেক কিছুই জানেন। ওর দিদা হলো বিদ্যার জাহাজ।
– বাহ খুব সুন্দর আবৃত্তি করো তো তুমি।
ধন্যবাদ দিদা।
– আচ্ছা বলোতো এই কবিতা কে লিখেছেন?
এটা তো খুব সহজ প্রশ্ন, সুফিয়া কামাল লিখেছেন।
– তুমি একদম ঠিকই বলেছ। কিন্তু তুমি কি জানো কেন লিখেছেন?
নাতো, আচ্ছা দিদা বলো না কেন লিখেছেন?
– বলছি উনি হেমন্ত ঋতুকে নিয়ে লিখেছেন। তুমি কি হেমন্তকাল নিয়ে কিছু জানো?
আমি শুধু জানি বাংলাদেশে ছয়টি ঋতু, তার মধ্যে হেমন্তকাল একটি।
– হ্যাঁ তোমার জানাটা সঠিক। তবে, আরও জানতে হবে। চলো আমরা হেমন্তকাল নিয়ে আলোচনা করি।
বন্ধুরা, সেদিন দাদিমা হেমন্ত ঋতু বিষয়ে তাবাসসুমকে অনেক কথা বলেছিল। তোমাদের আমি সেসব কথা বলব। এগুলো তোমাদেরও জানা দরকার। কারণ আমাদের ছয়টি ঋতু সম্পর্কে জানা উচিত।
হেমন্ত মানেই চারদিকে নবান্নের মৌ মৌ ঘ্রাণ। কৃষকের গোলা ভরে যায় সোনা ধানে। শীতের হিম হিম ভাব শীতের আগাম বার্তা দেয় প্রকৃতিকে। আমরা সবাই জানি বাংলা ক্যালেন্ডারের কার্তিক ও অগ্রহায়ণ এই দুই মাস হলো হেমন্ত। আর ঋতু হিসেবে চতুর্থ ঋতু। আরেকটু সহজভাবে যদি বলি তাহলে শরতের পরে এবং শীতের আগের ঋতুই হলো হেমন্ত। যদি তুমি গ্রামে থাক তাহলে হেমন্তের সকালে কুয়াশা দেখতে পাবে। হেমন্তের সকালে সবুজ ঘাস ও ধান গাছের ডগায় শিশিরবিন্দু সূর্যের আলোয় জ্বল জ্বল করে।
শরতে আমরা কাশফুল দেখে থাকি। এই কাশফুল হেমন্তে এসে মাটিতে নুইয়ে পড়ে। তবে, মহাসমারোহ নবান্নের আগমন ঘটে। হেমন্তকে বৈচিত্র্যময় রং ও পাতা ঝরার ঋতুও বলা যেতে পারে। হেমন্ত মানেই শিউলি ফুল, দোলনচাঁপার মনমাতানো গন্ধ। এ সবই মহান ¯্রষ্টার কিছু চমৎকার নেয়ামত। হেমন্তকে ঋতুরানি বলা হয়ে থাকে। হেমন্ত আগমনের পরপরই দিনগুলো একটু একটু করে ছোটো হতে শুরু করে। বেলা পড়ে গেলেই সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসে।
কার্তিকের পরেই আসে অগ্রহায়ণ। একসময় বাঙালির নতুন বছর শুরু হতো অগ্রহায়ণ মাস দিয়ে, তাই এ মাসের নাম হয়েছে অগ্রহায়ণ। এ মাসের প্রথম দিনে উদযাপিত হয় শস্য উৎসব নবান্ন। বাংলার কৃষিজীবী সমাজে শস্য উৎপাদনের বিভিন্ন পর্যায়ে যেসব অনুষ্ঠান ও উৎসব পালিত হয়ে থাকে, নবান্ন তার অন্যতম। নবান্নের শব্দগত অর্থ ‘নতুন অন্ন’। নতুন আমন ধান কাটার পর সেই ধান থেকে চালের প্রথম রান্না উপলক্ষ্যে আয়োজিত উৎসবই নবান্ন। সাধারণত, অগ্রহায়ণ মাসে আমন ধান পাকার পরে এই উৎসব হয়। এ সময় গ্রামের ঘরে ঘরে নতুন চালের পিঠা ও পায়েস রান্না করা হয়।
মূলত কার্তিক মাসের শুরু থেকেই ধান কাটা শুরু হয়। গ্রামের বাড়িতে তখন ঢেঁকিতে চাল কোটা হয় পিঠার জন্য। এ সময় প্রকৃতিতেও পরিবর্তন দেখা দেয়। অগ্রহায়ণ মাসেই ফসলের খেতে সোনালি হাসি ছড়িয়ে পড়ে। এ সময় বাতাসে উড়ে বেড়ায় নতুন ধানের ঘ্রাণ আর ফুলের সৌরভ। এর সঙ্গে প্রকৃতিতেও পাওয়া যায় শীতল ছোঁয়া।
হেমন্তে সকালবেলা আবছা কুয়াশায় ঢাকা থাকে চারদিকের মাঠঘাট। এসময় শিউলি, কামিনী, গন্ধরাজ, মল্লিকা, ছাতিম, দেবকাঞ্চন, হিমঝুরি, রাজ-অশোকসহ নানা ফুল ফোটে। হেমন্তের সকালে শিউলির সৌরভ বাঙালির প্রাণে আনে উৎসবের আমেজ। এ সময় বিভিন্ন ধরনের ফলের সমারোহ ঘটে। এ ঋতুর বিশেষ কিছু ফল হলো- কামরাঙা, চালতা, আমলকী ও ডালিম।
হেমন্তের রয়েছে আপন বৈশিষ্ট্য। ঋতুভিত্তিক বৈশিষ্ট্য, যা অন্যের থেকে অন্যরকম। সজীব ফসলে ভরে ওঠে মাঠ। টাটকা সবজিতে সবুজ হাসি হাসে খোলা প্রান্তর। যে দিকে চোখ যায় সে দিকেই শুদ্ধতার পরিবেশ। যেন বেঁচে থাকার অমিত আহŸান। বিপরীত দিকও যে তার নেই, তা নয় মোটেও। পাতারা ঝরবে বলে প্রস্তুতি নেয়। প্রকৃতির সতেজতায় মৃত্যুগন্ধা হাওয়া ভাসে। নগরে হেমন্ত ভিন্ন। নগরায়ণে শুধু এ ঋতু নয় এ ঋতু, কোনো ঋতুর চিত্রই ধরা পড়ে না পুরোটা। মাঝে মধ্যে কিছুটা আঁচ করা যায় মাত্র। যদি হেমন্তের স্বাদ নিতে চাও তাহলে ভোরে সবুজ ঘাসের ওপর দিয়ে খালি পায়ে হাঁটতে হবে। গ্রামের মানুষের কাছেই হেমন্তু তার পুরোপুরি রূপ তুলে ধরে। আকাশের দিকে তাকিয়েও তারা বলে দিতে পারেন এটা হেমন্তকাল। হ