গোটা আকাশ মেঘহীন নীলের বিছানা! ছিটেফোঁটা মেঘও নেই কোথাও। যেনো বিশাল নীলের টুপি উপুড় হয়ে আছে মাথার ওপর! যেদিকে চোখ ওঠে সেদিকেই নীল আর নীল। মাঠের ওপর নীল। বনের ওপর নীল। নদী ও সমুদ্রের ওপর নীল। পাহাড় আর ফসলের ওপর নীল। নীল নীল নীল আর নীল! নীলের এই লীলা দেখার ঋতুটির নাম হেমন্ত।
হেমন্ত বড় কোমল ঋতু। বড় মায়াবী! সূর্যের প্রখর তাপ নরম হয়ে ওঠে এই ঋতুতে। বদলে যায় রোদের রঙও। গরমের আঁচ থেমে যায়। শুরু হয় শিশিরের দিন। শীতও নামে না তখনও। ঠিক না শীত না গরমের একটি আনন্দময় মৌসুম এটি।
ছাতিম ফুলের কথা মনে পড়ে! তার সৌরভের কথা! আহা কী মধুর সুবাস! কী মনেধরা গন্ধ! ফলটি ফুটলেই চারিপাশে ছড়িয়ে পড়ে সুগন্ধের আনন্দ! শ্বাস নিতেই বুকের ভেতর পৌঁছে যায় সৌরভ। তখন মনটি ফুরফুরে হয়ে ওঠে। পথিক খুঁজতে থাকে পথের কোন কূল থেকে ভেসে আসে এমন সুবাস। গন্ধের সাথে পরিচিত মন বলে ওঠে সহসা- আরে এতো ছাতিম ফুলের সৌরভ!
হ্যাঁ ছাতিম হেমন্তের ফুল। হেমন্ত এসে প্রকাশ করে এর সুবাস। মজার বিষয় হলো- ফুলটি ফোটে রাতের বেলা। ঠিক সন্ধ্যার পরপরই। ফুটেই গন্ধ বিলাতে থাকে। গাছতলায় তো বটে। গাছের চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে ফুলের সুবাস। শীতল পরশের সাথে শিশির মিশে এক অদ্ভুত গন্ধ ছড়ায় ফুলটি। তাই এ ঋতুকে বলা হয় ছাতিম ফুলের হেমন্তকাল।
শিশিরের টুপটাপ শব্দ শোনার আনন্দ কী অদ্ভুত! এ শব্দ শোনেনি এমন কেউ কি আছে! কেউ কি আছে- দেখেনি কেমন করে ঝরে শিশির। সন্ধ্যারাত থেকে ঝরতে শুরু করে শিশির ফোটা। ঝরে রাতভর। সারারাত। গভীর রাতে শিশিরের শব্দ বড় বিস্ময়ের! সবুজ পাতায় ঝরে। ঝরে শুকনো পাতার শরীরে। কান পেতে শুনলেই অন্যরকম মনে হবে। মনে হবে ঝরছে প্রকৃতির গোপন চোখের অশ্রু। যে শোনেনি সে তো বোঝেনি হেমন্তের মায়াময় কোমল আনন্দ! এভাবে রাতভর ঝরতে ঝরতে সকাল নামে। নেমে আসে ভোরের মায়াবী মুখ। ঘাসের ঠোঁটে শিশির ফোঁটা কী আনন্দের! কচু পাতায় টলটলে মুক্তোর মতো জমে থাকে। পাতায় পাতায় জ্বলতে থাকে শিশির। ঘাসের ওপর সকালবেলার নরম রোদেও জ্বলে। এসব দৃশ্য যে দেখেনি সে বোঝেনি বাংলাদেশের কোমল ঋতুর সুখ। সে বোঝেনি মহান রবের অতি মহান শিল্পের সৌন্দর্য।
বাংলাদেশ ছাড়া এ ঋতুর দেখা কোথায় মেলে! কোথায় আছে এমন নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক সুন্দর! হেমন্ত এমনই নরম রোদের দিন। আহা! কী মধুর হয়ে নামে হেমন্তের নীরব সকাল।
নয়নতারার কথাই বলি। কী নিষ্পাপ! কী মায়াবী! কী আদর মাখা! বেগুনি রঙ মাখা। কোনোটি দুধের মতো সাদা। কোনোটি লালে লাল। আবার কোনোটি হলুদময়ী! কী সুন্দর পাপড়ি! কেমন করে ফুটে থাকে কাণ্ডের মাথায়। ঝিরঝিরে বাতাসের দোলায় দুলতে থাকে। দুলে দুলে কার কথা বলে। ভোরবেলা পাপড়িতে জমে থাকে শিশির! শরতের গা ঘেঁষে ফোটে হেমন্তের দিন। সোনালি রোদের দিন। মাঠভরা পাকা ধানের দিন। প্রকৃতির বুকে হেমন্ত সোনালি ঋতু। মুখে মুখে সকলেই বলে- হেমন্তকাল সোনার ঋতু। কিন্তু কেন! কেন এ ঋতুকে বলা হয় সোনালি ঋতুর দিন! জিজ্ঞাসা যেমন আছে, জবাব কি নেই তেমন! নিশ্চয় আছে। আছে তো জানা যাক- হেমন্তে বদলে যায় রোদের রঙ! ঈষৎ সাদা রোদ হয়ে ওঠে সোনালি। মাঠের বুকজুড়ে পাকা ধানের রঙও সোনার মতন। ঝিঙে ফুলের শরীরও সোনালি রঙে মাখা। ফুলের পাপড়িতে বসা অনেক প্রজাপতির রঙও দারুণ সোনালি। আহা সোনালি রঙ কী সুন্দর! কী আনন্দের! চোখ জুড়িয়ে ওঠে। গাছের সবুজ পাতায় সোনালি রোদ দুলে ওঠার সময়টি কী অদ্ভুত! ঝাঁকবাঁধা শালিকের ঠোঁটও হলদে সোনালি। হেমন্তে দল বেঁধে ওড়ে শালিক। ওড়ে- এ গাছ থেকে ও গাছে। তখন দোয়েল শ্যামা আর বুলবুলির কণ্ঠে বেজে ওঠে গান।
হেমন্তে রাত বড় হয়ে ওঠে। দিন হয়ে যায় ছোট। এই ছোট দিন হওয়ার কারণ- সূর্য দক্ষিণ গোলার্ধের দিকে সরে যায়। যে কারণে কমে যায় রোদের তাপ। রঙ বদল হয়ে সাদা থেকে হয়ে ওঠে সোনালি। এ সময় বিকেলের রোদ সোনালি থেকে হয়ে ওঠে কমলা। শেষ বিকেলের রোদ তো একদম কমলা রঙের! কমলারঙ রোদের ভেতর দাঁড়িয়ে আকাশ দেখার আনন্দ নিতে হয়। কিংবা খোলা মাঠের সবুজ ঘাসে বসে বা শুয়ে আকাশ দেখার মুহূর্ত আনন্দের নয় কি! ভীষণ ভীষণ আনন্দের!
হেমন্তের সন্ধ্যা বড় নান্দনিক। সূর্য ডোবার সময় আকাশে আকাশে ছড়িয়ে পড়ে নানান রঙের আভা। ইস! সারাটা আকাশ যেনো রঙের ছাদ। যেনো রক্তজবার পাপড়ি বেটে লেপে দিয়েছেন কেউ। পশ্চিম আকাশে রঙের এই খেলা চলতে থাকে। চলে রাতের অন্ধকার গভীর হওয়া পর্যন্ত। অন্ধকার গাঢ় হলেই জ্বলতে শুরু করে জোনাকির জ্যোতি। ঝরতে থাকে শিশির।
শিশিরের টুপটাপ শব্দের ভেতর কী এক অদ্ভুত আনন্দ! এ শব্দ নিয়ে কতো কবিতা লিখেছেন কবিরা! গল্পকার লিখেছেন গল্প। গান লিখেছেন গীতিকার! লেখা হয়েছে উপন্যাসও। এ নিয়ে হয়েছে চলচ্চিত্রের কাহিনি। কত যে রচিত হয়েছে ছড়া। আর মানুষের মুখে মুখে শিশিরের কত রকম প্রশংসার ডালি। এবার তবে আমরাও একটি কবিতা লিখে ফেলি-
শিশির ভেজা ঘাসের ওপর পা ডুবিয়ে হাঁটি
ঘাস হয়ে যায় সবুজ জুতো পা ছোঁয় না মাটি।
সোনার মতো রোদগুলো সব ছড়িয়ে পড়ে ঘাসে
আনন্দময় হেমন্তকাল শরৎ শেষে আসে।
হেমন্তকাল বাংলাদেশের ছাতিম ফুলের দিন
ধানের ক্ষেতে সোনালি রোদ অনন্য রঙিন।
প্রজাপতির পাখায় জ্বলে ঝিঙে ফুলের হাসি
হেমন্তকাল ভালোবাসি, অনেক ভালোবাসি।
তোমরাও কি হেমন্তকে ভালোবাসো খুব
শিউলি ফুলের গন্ধ নিতে শিশিরে দাও ডুব।
হাত ভিজিয়ে পা ভিজিয়ে নাও ভিজিয়ে মন
সুখ কুড়াতে আর কি কিছুর আছে প্রয়োজন।
মনকে যদি মনের কাছে রাখতে পারো তুমি
মনের ভেতর স্বপ্ন হবে আনন্দ ঝুমঝুমি।
স্বপ্ন থেকে স্বপ্ন আরো দীর্ঘ করে তোলো
দিগ্বিজয়ের জন্য কোনো নতুন দুয়ার খোলো।
সেই দরোজায় লিখে রাখো বাংলাদেশের নাম
হাসনা হেনার গন্ধে ঝরুক শিশির অবিরাম।
বকুল ঝরা সকাল দেখার ইচ্ছে যদি রাখো
দীর্ঘ কালো রাত্রি ঠেলে ভোরের হাওয়া মাখো
মনটি তোমার সুবাস ভরা ফুলের মতো হোক
তোমার দিকে নজর তুলুক গোটা বিশ্বলোক
বিশাল আকাশ অখণ্ড এক নীলের টুপি পরা
অনন্ত এ মস্ত নিশান মনটি উদাস করা
কে জানে কে এই আকাশের কোথায় হলো শেষ
ভাবতে গেলে মন হয়ে যায় হঠাৎ নিরুদ্দেশ!