শানিত তলোয়ারের মতো একটি পরিচ্ছন্ন দেহকাঠামো। ঘাড় পর্যন্ত চুলের কেশর প্রখরতায় উজ্জ্বল, অপূর্ব দীপ্তিময় সুন্দর দুটি চোখ। টিকালো খাড়া নাক। সর্বোপরি উন্নত শির এক ব্যক্তিত্বময় পুরুষ।
আধুনিক বাংলা কাব্যের ইতিহাসে ফররুখ আহমদ একটি একক ও অনন্যসাধারণ প্রতিভা। প্রাক পাকিস্তান বাংলা সাহিত্যের আলোচনা করলে দেখা যায়, বাঙালি মুসলমানেরা নানা কারণে সাহিত্যে ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে হিন্দুদের পশ্চাৎবর্তী ছিলেন। ১৯২০ সালের পর থেকে মুসলমানদের মধ্যে কিছুটা জাগরণের আভাস সূচিত হয়। এই জাগরণের গোড়াপত্তন নানা ভাবে নানা জনের হাতে হলেও কাজী নজরুল ইসলাম, কবি গোলাম মোস্তফা, মাওলানা আকরম খাঁ, কবি জসীম উদ্দীন, শিল্পী আব্বাস উদ্দীন প্রমুখ ব্যক্তিবগের্র হাতে এই জাগরণের পূর্ণতা প্রাপ্তি ঘটে। এ ছাড়া বহু কৃতবিদ্যা বুদ্ধিজীবী মুসলমান ইসলামী তাহজিব তমদ্দুন সমন্বিত অনেক কাব্য, উপন্যাস, প্রবন্ধ নিবন্ধ রচনা করে বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে দেয়।
বহুদিন ধরে সামাজিক, অর্থনৈতিক, আর্থিক নানান দিক দিয়ে বঞ্চিত হয়ে বাঙালি মুসলমানরা নিগৃহীত হয়ে বুঝতে পেরেছিলেন নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে বীরের মতো ঝাঁপিয়ে পড়তে না পারলে অদূর ভবিষ্যতে মুসলমানদের অস্তিত্ব বিপন্ন হতে পারে। এই মানসিকতা থেকে মুসলমানরা নিজস্ব সাহিত্য নিজেদের মতো প্রকাশ করতে উৎসাহী হয়ে ওঠেন। এই সাহিত্যের ভিত্তি প্রতিষ্ঠিত হবে ইসলামের প্রাচীন ঐতিহ্যের মাধ্যমে। এই সাহিত্যের রস সঞ্চয় করবে দেশ, বিদেশের সাহিত্য কর্মের নানান সম্ভার থেকে। এই চিন্তাধারার সার্থক রূপকার কবি ফররুখ আহমদ।
রাজনৈতিক কর্মীরা যেমন স্বাধীনতা অর্জনের জন্য রক্তক্ষয়ী সংগ্রামে মেতে উঠেছিলেন, বাঙালি একদল মুসলমান কবি সাহিত্যিকও তাদের অর্নিবাণ লেখনী চালিয়ে মুসলমানদের জন্য নিজস্ব সাহিত্যের গতিপথ নির্দেশ করেছিলেন। এই দলের এক বিশিষ্ট আসনে আছেন কবি ফররুখ আহমদ। তার কাব্য রচনা কৌশল, তার কাব্যের আঙ্গিক, কাব্যের বিষয়বস্তু, ভাষা সমস্তই ইসলামী মানসপুষ্ট। কবি ফররুখের কাব্যে ইসলামের হৃদস্পন্দন আরও বেশি অনুভূত হয়। ইসলামের ঐতিহ্য, মর্মবাণী তার কাব্যের প্রাণ। ইসলামের উজ্জ্বল গৌরবগাথা মহৎ ঐতিহ্য কবিকে এত বেশি বিমুগ্ধ করেছিল যে তিনি মানবতাকে রক্ষা করার জন্য, তার স্বজাতিকে জাগরণের মন্ত্রে উদ্দীপিত করার জন্য হেরার রাজ তোরণকে তার ধ্যানের বিষয়বস্তু করেছেন। ভূগোলের চাইতে তার কাছে সত্যও অসম্ভব বড়ো। তার কল্পনার স্বর্ণ ঈগল বাংলাদেশের চৌহদ্দি ডিঙ্গিয়ে ঐ দূর আরবের আকাশে গিয়ে পথের ঠিকানা পেয়েছেন। বাংলা তার জন্মভূমি আরব তার মর্মভূমি। কেননা ঐ আরবই তো মানবতার শ্রেষ্ঠতম আদর্শ ইসলামের অতীত কাহিনি বিজড়িত কবির স্বপ্নলোক। সেখানকার ইতিহাস কিংবদন্তি নির্ভর কাহিুিন আরব্য উপন্যাসের সহস্র রজনীর অজস্র দীপালি উৎসব কবিকে বিমুগ্ধ করেছে। রহস্যময় করে তুলেছে।
কবির কল্পনালোকেও রচনা করেছে আরবের আজমের ঐশ্বর্য মহিমানিত দিনগুলোর মধ্যে। এ যুগের কবি বিপ্লবী ইসলামী চেতনাবোধের প্রতি স্বাভাবিকভাবেই আশ্রয় গ্রহণ করেছেন। এই সব কাহিনি, ঘটনা, ইসলামের জীবনদর্শনই মানুষকে সহজ সুন্দর জীবনের সন্ধান দিতে পারে। পারে তাকে সামগ্রিক মুক্তির আনন্দ দিতে।
উনিশ শতকের শেষদিক থেকে মুসলমানদের আধুনিক শিক্ষার প্রতি অনুরাগ ও ব্রিটিশ সরকারের প্রতি আপসের চেষ্টা দেখা যায় এবং বিশ শতকের প্রারম্ভে মুসলমানদের মধ্যে নবজাগরণের সূচনা হয়। এই নবজাগরণ জাতীয় লক্ষ্যে পৌঁছে ইকবালের সাহিত্য সাধনার মাধ্যমে।
বাংলাদেশেও আত্মপ্রতিষ্ঠাকামী মুসলিম মানসে ইকবালের বাণী ইসলামী ঐতিহ্য প্রেরণায় উদ্দীপিত করেন। বাংলার মুসলিম জাগরণের কবি ফররুখ আহমদও স্বাভাবিকভাবে ইকবালের বাণীতে অনেককে উদ্দীপিত করেছে। বাংলার মুসলিম জাগরণের কবি ফররুখও স্বাভাবিকভাবেই ইকবালের কাব্য প্রেরণায় উজ্জীবিত। এই দুই কবির কাব্যাদর্শ এক কিন্তু তাদের আদর্শে পৌঁছার পথ ভিন্ন। কবি ফররুখ আহমদ রোমান্টিক অতীতচারী। কল্পনায় অতীত ঐতিহ্যের চারণভূমিতে পরিভ্রমণ করে তিনি আনন্দ পান। অতীত কল্পনার সাথে তার ইতিহাস সচেতনতা লক্ষ করা যায়। তিনি যা বিশ্বাস করেন, সত্যি বলে জানেন, তা তিনি কোনোভাবেই কোনো দ্বিধায়, হারাতে রাজি নন।
ফররুখ মনে প্রাণে ইসলামের ঐতিহ্যবাহী কবি। এই বিপদসঙ্কুল মুহূর্তে মুসলিমকে একমাত্র রক্ষা করতে পারে তার নিজস্ব আদর্শ ও ঐতিহ্য। কবিমনের এটাই ছিল গভীর আকুতি ও অকুণ্ঠ বিশ্বাস। এই বিশ্বাসের আরও বলিষ্ঠ প্রকাশ দেখি ইসলামী শব্দসম্ভারের যথাযথ প্রয়োগে। তার আরবি, ফার্সি শব্দের ব্যবহারে ভাষা যেন ভাবকে পথ কেটে দিয়েছে আপন গতিতে বয়ে যাওয়ার জন্য।
বাংলা কাব্যে আরবি, ফার্সি শব্দের ব্যবহার নতুন নয়। মধ্যযুগের কাব্যে এমনকি বাংলা কাব্যের শুরুতেও বহু আরবি ফার্সি শব্দের প্রয়োগ দেখা যায়। তবে ভাষাকে ভাবের অনুগামী করে নিজস্ব সংস্কৃতির উপযুক্ত বাহন রূপে বাংলা ভাষাকে গড়ে তোলার চেষ্টা কবি ফররুখের মতো আর কেউ করেননি। বঙ্কিম, মাইকেল, রবীন্দ্রনাথ অনুসৃত বাংলা ভাষায় ফররুখ আহমদের এই হস্তক্ষেপে অনেকে কিছুটা অসন্তুষ্ট, কিন্তু আমাদের ভুলে গেলে চলবে না যে বাংলা ভাষায় আরবি ফার্সি শব্দের আমদানি ফররুখ আহমদের একক প্রচেষ্টার ফল নয়।
ভাষার আদি থেকে নানান জনের মুখে নানান বিদেশী শব্দ ভাষায় ঢুকে পড়েছে। এই সমস্ত শব্দসম্ভারকে কোনো অবস্থাতেই বাংলা ভাষা থেকে বাদ দেওয়া যায় না। সহজভাবে যেসব শব্দ বাংলা ভাষায় ঢুকেছে তাদের সহজভাবে গ্রহণ করা উচিত। বস্তুত সব দিক দিয়ে কবি ফররুখ আহমদ একজন শক্তিমান লেখক ও ভাষাশিল্পী।
আধুনিক বাংলা কাব্যে মুসলিম ধ্যান চিন্তার পরিপোষক স্বতন্ত্র কাব্যধারার প্রবর্তক হিসেবে ফররুখ আহমদের নাম শ্রদ্ধার সঙ্গে স্বীকৃত। তিনি সার্থকভাবে পুথির ভাব ও ভাষাকে আত্মস্থ করেছেন। কিন্তু আদর্শের কেন্দ্রবিন্দুতে শুধু নিজ ঐতিহ্যের পুনঃজাগরণই তার লক্ষ্য হওয়াতে বাংলা কাব্যে তিনি আশ্চর্য রকমে নিঃসঙ্গ। অধ্যাপক সুনীল মুখোপাধ্যায় তার ফররুখ আহমদ গ্রন্থে বলেন, সোহরাবের লাশ নিয়ে জেগে আছে নিঃসঙ্গ রুস্তম। কবির নিজ পারিপার্শ্বিক অবস্থাই তাকে করেছে ইসলামের আদর্শের পুনঃ উদ্ধারে মশগুল। ভাবের এই বৃত্তের মধ্যে কবির কল্পনা পক্ষ বিস্তার করেছে বলে আত্মনিমগ্ন আধুনিক কবিগোষ্ঠীর সঙ্গে তার ভাব চিন্তার মিল পাওয়া যায় না। কবি ফররুখ আহমদ সম্বন্ধে এই কথা বলা সত্ত্বেও আরেকটি প্রশ্ন থেকে যায়? কবি কি শুধু ঐতিহ্যবাদী মুসলিম কবি? তিনি কি বাঙালির কবি নন? এ বাংলার কোন চিত্র তার কাব্যে পাই না? এই প্রশ্নের উত্তরে কয়েকটি কবিতা উল্লেখ করতে পারি যেমন ঝরোকা, মুহূর্তের কবিতা প্রভৃতিতে কবিকে আমরা নতুন রূপে চেনার সুযোগ পাই। কবির সমস্ত কাব্যগ্রন্থগুলো আলোচনা করলে কবিকে শুধুমাত্র মুসলিম পুনঃজাগরণের কবি বললে ভুল হবে। পুনঃজাগরণের চেষ্টা তার লক্ষ্যবস্তু হলেও বাংলাকে বাঙালিকেও তিনি বিস্মৃত হননি।
কবি মাত্রই সৌন্দর্যের অনুসারী। প্রকৃতির সৌন্দর্য কম বেশি সকল কবিই বর্ণনা করেছেন। ফররুখ আহমদও প্রকৃতিপ্রেমী। প্রকৃতির রূপ সৌন্দর্য বর্ণনায় তিনি অসাধারণ। এ ক্ষেত্রেও তার বৈশিষ্ট্য উল্লেখযোগ্য। এভাবে ফররুখের মধ্যে একাধারে প্রকৃতিপ্রেম, মানবপ্রেম, জাতিপ্রেম, এমনকি আধ্যাত্মিক প্রেমেরও প্রকাশ ঘটেছে। রোমান্টিক কবি হিসেবে তার এসব অনুভূতির প্রকাশে আবেগ, উচ্ছ্বাস ও নিজস্ব কল্পনাশক্তির প্রকাশ আমাদের অভিভূত করে।
১৯৭১ সালে সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত বাংলাদেশ। দেশে চলছে এক ক্রান্তিকাল। নিজেদের পারিবারিক, বিপদ আপদ, দুঃখ বেদনা বিপর্যয় নিয়ে ব্যস্ততায় কেটে গেছে বেশ কিছু সময়। দুঃখে, কষ্টে, অনাহারে, অর্ধাহারে কেটেছে তার পরিবারের জীবন, যদিও এসব তিনি হাসিমুখে বরণ করে নিয়েছেন। এমনি এক মূহূর্তে ১৯৭৪ সালের ১৯ শে অক্টোবর পবিত্র ঈদুল ফিতরের পরের দিন রোমান্টিক কবি ও রেনেসাঁর কবি ফররুখ আহমদ বিদায় জানালেন এ ধরাধামের। কিন্তু রেখে গেলেন চেতনাময়, জাগরণী এক কালজয়ী আদর্শ।