একটা পুরুষ হাতি খুব ব্যস্ত হয়ে বাসায় ফিরছিল। রাতে ঘন জঙ্গল পার হতে তার খারাপ লাগবে।
বন্ধুর সাথে দেখা করতে যেতে হয়েছে অনেক দূরের পথ। তাকে পেয়ে বন্ধু যেন আকাশের চাঁদ হাতে পেয়েছে। কী খাওয়াবে, কোথায় বসাবে এসব করে পার করেছে দিনটা। ছেলে অস্থির আর অশান্তকে সে কথা দিয়েছিল মেলায় নিয়ে যাবে। না জানি তারা ওর মাকে কী রকম জ্বালাতন করছে। সে জন্য জোরে জোরে হাঁটছিল হাতি।
হঠাৎ হাতিটা শুনতে পেল একটা মানবশিশু বলছে, “মামা, আমাকে মেরে ফেল না।”
মামা! কার মামা সে। একটাই বোন ছিল তার। সে তো অনেক আগে মরে গেছে। ও বেঁচে থাকলে ওর সন্তানের মামা ডাক শুনে মন শীতল হতো। সে ভাগ্য তার হয়নি।
পায়ের নিচে একটি ফুটফুটে মেয়ে দেখতে পায় জাম্বু। মেয়েটা বলছে, “মামা, আমাকে মেরে ফেল না।” মানুষের বাচ্চা তাকে মামা বলছে। শুঁড় দিয়ে পেঁচিয়ে মেয়েটিকে মাথায় তুলে নেয় সে। একটু হলেই ওর পায়ের তলায় পিষ্ট হয়ে মরে যেত। সে বলে-
“কে মা তুই। আমাকে মামা বলছো?”
“আমাকে বাঘ তাড়া করেছে। মা কোথায় গেছে জানি না।”
“ওরে সোনা! এই গহিন বনে কেন এসেছিলি?”
“মা কাঠ কেটে বাজারে বিক্রি করে। সেই টাকায় আমাদের সংসার চলে।”
“তোমার বাবা নেই?”
“দু’বছর হলো বাবা জ্বর হয়ে মরে গেছে।”
“সোনা মা। আমার পিঠে শক্ত হয়ে বসে থাক। একটুও ভয় করবে না।”
জাম্বু খুব সাবধানে বাড়ির দিকে চলতে থাকে। খুব ব্যথিত হয় সে। অতটুকু মেয়ে এমন মমতামাখা কথা বলে। আকাশে চাঁদ উঠলে হাতি নদীর পাড় ধরে হাঁটতে লাগল। কিছু দূর এসে একটা বাগানে গিয়ে মেয়েটিকে পাকা কলা খেতে দিলো সে।
“মা মণি পেট ভরে কলা খাও। কলা খাওয়া হলে আমরা বাড়ি যাব।”
“মামা। তোমার বাড়ি কোথায়?”
“ওই যে নদীটা দেখা যায়। ওটা পার হলেই আমার বাড়ি।”
“তুমিও আমার সাথে কলা খাও।”
“আমার একদম খিদে নেই মা।”
‘আমি একা খাব না। হাঁ কর, তোমাকে খাইয়ে দেই।”
মেয়েটির দেহ থেকে চাঁদের আলো ঝরে। ওর হাতে কলা খেতে জাম্বুর ভালো লাগে। মেঘ আর জোসনার খেলা দেখে দুজনে কলা খায়। জাম্বু বলে,
“দেরি হলে তোমার ভাইয়ারা রাগ করবে।”
“কেন মামা, ভাইয়ারা রাগ করবে কেন?”
“ওদের যে আজ মেলায় যাওয়া হলো না।”
“ওরা মেলায় যেতে চেয়েছিল বুঝি?”
“ওদেরকে কথা দিয়েছি। বলেছি, ফিরে এসে মেলায় যাব।”
“আমাদের ওখানেও অনেক বড়ো মেলা বসে। মা আমাকে মেলায় নিয়ে যায়।”
“চল এবার বাড়ি ফেরা যাক।”
কিছুদূর এসে জাম্বু দেখে একজন মেয়েলোক পাথরে হেলান দিয়ে বসে আছে। তাকে দেখে থমকে দাঁড়ায় সে। সে ছায়ামণিকে বলে,
“মামণি দেখত ভালো করে। ওটা মানুষ না অন্য কিছু ?”
“মামা। ওটা মেয়েমানুষ।”
“এত রাতে এই গভীর অরণ্যে মেয়েমানুষ থাকার কথা তো নয়।”
মেয়েলোকটি কাঁদছে। মনে হয় কিছুই খায়নি। অন্যদিকে মুখ করে থাকায় তাকে চেনা যাচ্ছে না। জাম্বু বলে,
“কে তুমি? এখানে কী করছো?”
“আমার মেয়েকে খুঁজছি। বাঘের তাড়ায় ও হারিয়ে গেছে।”
“চিন্তা কর না। ওকে পেয়েছি আমি।”
“কোথায় পেয়েছেন ওকে? সারাদিন ধরে ওকে আমি খুঁজছি। কোথাও দেখা পাচ্ছি না।”
খুশিতে আটখানা হয় ছায়ার মা। মেয়েকে বুকে টেনে নেয়। জাম্বুকে শ্রদ্ধা নিবেদন করে। জুলেখাকে সান্ত¡না দেয় জাম্বু। সন্তানহারা মায়ের কষ্ট তার জানা ছিল না। সে বলে,
“বোন। আল্লাহর কৃপায় ও বেঁচে গেছে। তা-না হলে ও আজ আমার পায়ের তলে চাপা পড়ে মরে যেত।”
“আমি ওর আশা আমি ছেড়ে দিয়েছিলাম।”
মায়ের গলা জড়িয়ে ধরে ছায়ামণি। বাঘের হাত থেকে বেঁচে যাওয়া অলৌকিক বিষয়। অন্যদিকে বনের হাতি মানবশিশুকে আপন করে নেওয়ার ঘটনাও বিরল ঘটনা। ছায়ামণি বলে,
“মা। উনি মামা। আমি ওনাকে মামা বলে ডেকেছি। মামা আমাকে কলা খাইয়েছে।”
“কোথায় কলা পেয়েছে তোমার মামা ?”
“ওদিকে একটা কলার বড়ো বাগান আছে। বনের ধারে গাছপালার ভেতর।”
জুলেখাকেও সেই বাগানে নিয়ে যায় জাম্বু। কলার একটা বড়ো কাঁদি সামনে দিয়ে বলে,
“বোন, পেট পুরে খাও। হয়ত আজ তোমার খাওয়া হয়নি। মামণি, তুমিও খাও।”
“আমার খিদে নেই ভাইজান।” লজ্জায় সঙ্কুচিত হয়ে বলে জুলেখা।
“সেকি? তুমি তো কিছুই খাওনি। আমি ছায়ামণির কাছে সব শুনেছি। বাঘ তোমাকে তাড়া করেছে। খেলে কখন?”
“না ভাইয়া। মা মণিকে নিয়ে তুমি খাও। আমি দেখি।”
“ওসব কথা রাখো তো। চল সবাই মিলে খাই।”
বোন আর ভাগনিকে নিয়ে বাড়ি ফেরে জাম্বু। ওদেরকে বাইরের ঘরে বসিয়ে ভেতরে যায় সে। দেখে ছেলেরা মন খারাপ করে বসে আছে। স্ত্রী জুপিটারও কথা বলছে না। জাম্বু ব্যথিত হয়ে বলে,
“কী ব্যাপার! কেউ কথা বলছ না কেন। কী হয়েছে তোমাদের?”
“কী বলব। ছেলেরা সারাদিন কি আমার জান রেখেছে।” বিষণœ মনে বলে জুপিটার।
“কী করেছে ওরা আমাকে খুলে বলো?”
“মেলা মেলা করে আমাকে কি এক দণ্ড থামতে দিয়েছে। ওদের যন্ত্রণায় খেতে পর্যন্ত পারিনি।”
“সেই কথা। কী করব। বড্ড দেরি হয়ে গেল। কতদিন পর বন্ধুর দেখা। মোটেই ছাড়তে চায় না।”
“মেলায় যাবে বলে ওরা একপায়ে দাঁড়িয়ে আছে। আজ বন্ধুর বাড়ি না গেলে পারতে না?”
ছেলেদের সামনে দাঁড়ায় জাম্বু। মেলায় কত আনন্দ করতো ওরা! কিন্তু ওদের যে একটা ছোট্ট বোন এসেছে তা জানতে পারলে ওরা কম খুশি হবে না। ছেলেদের বুকে জড়িয়ে চুমু খায় সে। ওরা মনে হয় ভালো করে খায়নি। কেমন দুর্বল লাগছে। ভেজা গলায় সে বলে,
“সোনা বাপ। আমার ওপর রাগ করে আছো?”
“তোমার সাথে কথা বলব না। সবাই মেলায় আনন্দ করেছে। তোমার খবর নেই।”
“মেলার জন্য রাগ। গর্তে পড়ে আমার যে পা ভেঙে যাচ্ছিল। পা ভাঙলে যে বাড়ি আসতেই পারতাম না। তখন কী হতো!”
‘এত রাত কেন করলে বাবা। তোমার জন্য আমরা শুধু কেঁদেছি আর মাকে জ¦ালিয়েছি।”
‘আর রাগে না সোনা বাপ। এবার আমার সাথে একটু বাইরে চলো দেখি।”
“আগে বলো। কেন রাত করেছ?”
“তাহলে শোন। সন্ধ্যা নামার আগে বাড়ি ফিরব বলে গাছপালা পেছনে ফেলে ছুটছি।”
“তোমাকে কে ছুটতে বলেছে।” ব্যথিত হয়ে বলে বড়ো ছেলে অশান্ত। ‘বাবা, তুমি ধীরে ধীরে আসতে’ অশান্তকে সমর্থন করে বলে অস্থির।
“কী বলছ তোমরা? আমার মাথায় একটাই চিন্তা। মেলায় যেতে হবে।” ছেলেদের সান্ত¡না দিতে বলে জাম্বু। “শোন সোনারা। তো ছুটছি। একটা ঝোপওয়ালা গর্ত লাফিয়ে পাড় হতেই শুনি একটি মেয়ে বলছে, মামা, আমাকে মেরো না। ওর মা হারিয়ে গেছে বাঘের তাড়া খেয়ে। ওকে নিয়ে আসতে আসতে ওর মায়ের দেখা পেলাম। ওরা বাইরের ঘরে অপেক্ষা করছে। এসো তোমরা ওদের বরণ করে নেবে?”
স্বামীর মুখে এসব কথা শুনে জলদি খাবার তৈরি করে জুপিটার। নতুন অতিথিদের আপ্যায়ন করার তেমন কিছু নেই ঘরে। যা আছে তা দিয়ে ঝটপট খিচুড়ি তৈরি করে সে। অস্থির আর অশান্ত ওদের সাথে কথা বলার অবকাশে রান্নাবান্নার কাজ শেষ করে জুপিটার। টেবিলে খাবার চাপিয়ে উঁকি দিয়ে সে দেখে কী সুন্দর অতিথি এসেছে। নতুন ফুফু আর বোনকে পেয়ে ছেলেরা ক্ষুধার কথা ভুলে গেছে। ওরা বাঘের মুখে পড়েছিল। না জানি কত ধকল গেছে। খিদে পেয়েছে নিশ্চয়। স্বামীকে ডাকতে থাকে জুপিটার।
“কিগো, শুনতে পাচ্ছো?”
“কী হয়েছে?”
“খাবার যে ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে?”
“কী পাগলের মতো কথা বলছ। এত তাড়াতাড়ি খাবার তৈরি করেছ?”
“রাত কয়টা বাজে জানো? ওদের খিদে পায়নি বুঝি?”
“বাবারা। তোমাদের ফুফু আর ছায়াকে নিয়ে টেবিলে যাও। আমি হাতমুখ ধুয়ে আসি।”
সবাই খেতে বসে। জাম্বুর কথা সে পরিবেশন করবে। জুপিটার তা মানবে না। জাম্বু নাছোড়বান্দা। বোনের সাথে জুপিটারকে খেতে হবে। বন্ধুর বাড়িতে অনেক খাওয়া হয়েছে। এখন খিদে নেই। জুপিটার পরিবেশন করতে পছন্দ করে। সে ছাড় দিতে রাজি নয়। ভাইয়া ভাবীর এ অবস্থা দেখে জুলেখা বলে,
“ভাবী, তোমরা বসো। আমি পরিবেশন করছি।”
“তুমি অতিথি। পরিবেশন করবে মানে?” হতচকিত হয়ে বলে জাম্বু।
“এতে আমার ভালো লাগবে ভাইয়া।” ঘোমটায় মুখ আড়াল করে বলে জুলেখা।
“মা তুমি বসো আমাদের সাথে। দিক না বাবা খাবার তুলে।” অস্থির মাকে বলে।
“মামা, আমি খাবার তুলে দিই। আমি তো সব কাজ করতে পারি।” মিষ্টি করে বলে ছায়ামণি।
অশান্ত প্রস্তাব করল যে যার মতো নিয়ে খাবে। অগত্যা জাম্বুও বসল খেতে। গল্প করে অনেক রাত ধরে খাওয়া চলল। কারও ঘুম হলো না রাতে। এ গল্প সে গল্প করে রাত কেটে গেল। সকালে নাস্তা সেরে জাম্বু এবং জুপিটার বেরিয়ে পড়ল অসভ্য বাঘটাকে শায়েস্তা করতে। তাদের অতিথিকে যারা নির্যাতন করেছে এ বনে বাস করা তাদের ভাগ্যে জুটবে না।