বছরে যে দু’টি দিন আমাদের খুশির খুশবুতে ভিজিয়ে রাখে, ঈদুল আজহা তার একটি। ঈদুল আজহা বললেই একটা ছবি ভেসে আসে আমাদের চোখে। কীসের ছবি, বলো তো? হ্যাঁ, কুরবানির ছবি। আর মনে এসে ভিড় করে অমর এক গল্পের সবুজ কিশতি। এ কিশতিতে ভেসে ভেসে আমরা ফিরে যাই ইবরাহিম (আ)-এর কাছে। কিশোর ইসমাঈল (আ) যেন আমাদের বন্ধু হয়ে যান তখন। কখনো কখনো আমরা নিজেকেই কল্পনা করি তাঁর জায়গায়। আর অনুভব করি, আহা! আল্লাহর ভালোবাসায় কী যে সুখ!
কুরবানির পরিচয়
আরবি কুরবান মানে কাছাকাছি আসা। আল্লাহর কাছাকাছি। এ কাছে আসার পথ কী? নামাজ, রোজা, হজ্জ, পশু জবাই এবং অন্যান্য ইবাদাতের মাধ্যমে। তবে কুরবানি শব্দটা পশু জবাইয়ের সাথে বিশেষায়িত হয়ে গেছে। আর তা হতে হয় নির্দিষ্ট সময়ে, নির্দিষ্ট নিয়ম-কানুন মেনে।
প্রথম কুরবানি
পৃথিবীতে যা কিছু প্রথম, তা জানার ইচ্ছে আছে আমাদের সবারই। আহা, যদি পৃথিবীর প্রথম ফোটা ফুলটি আমরা ছুঁয়ে দেখতে পারতাম! শুনতে পারতাম প্রথম পাখির গান! অথবা প্রথম নদীর এক আঁজলা পানিতে ধুয়ে নিতে পারতাম ধূলিভরা মুখ! তবে সে সুযোগ না থাকলেও প্রথম মানুষ কে ছিলেন, কেমন ছিলেন- তা আমরা জানি। আর পৃথিবীতে প্রথম কুরবানি হয়েছিল প্রথম মানুষ আদম (আ)-এর আদেশেই। তাঁর দুই ছেলের মধ্যে একটা বিষয়ে বিরোধ দেখা দিয়েছিল। তখন তার সমাধানের জন্য তিনি কুরবানিকেই বেছে নিলেন। বললেন, যার কুরবানি কবুল হবে, সে-ই জয়ী হবে! কুরআনের ভাষায়-
“আর আদমের দু’ছেলের কাহিনি আপনি তাদের যথাযথভাবে শোনান। যখন তারা উভয়ে কুরবানি করেছিল, অতঃপর একজন থেকে কবুল করা হলো এবং অন্যজনের কবুল করা হলো না। সে বলল, অবশ্যই আমি তোমাকে হত্যা করব। অন্যজন বলল, আল্লাহ তো কেবল মুত্তাকিদের পক্ষ হতে কবুল করেন।” (সূরা আল-মায়িদাহ : ২৭)
যার কুরবানি কবুল হয়েছিল, তাঁর নাম হাবিল। আর অন্যজন ছিল কাবিল।
এবার সবার মনেই একটা প্রশ্নবোধক চিহ্ন উঁকি দেওয়ার কথা! কুরবানি কবুল হওয়া-না হওয়া কীভাবে জানা গিয়েছিল? কীভাবে? আমরা তো আমাদের কুরবানি কবুলের কথা কিছুই বুঝতে পারি না। হ্যাঁ, সে সময়ের নিয়ম ছিল, কবুল হওয়া কুরবানি আকাশ থেকে আগুন এসে জ্বালিয়ে দিত! হাবিল পশুপালন করত। তাই সে কুরবানি করেছিল তরতাজা একটি দুম্বা। আর কাবিল করত কৃষিকাজ। সে পেশ করেছিল কিছু গমের শীষ। আগুন এসে হাবিলের কুরবানি জ্বালিয়ে দিলো। আর কাবিলেরটা পড়ে রইল, যেভাবে রেখেছিল সেভাবেই।
কুরবানি যুগে যুগে
আদম (আ) থেকেই তো কুরবানি শুরু, তারপর? তারপর কি তা থেমে গিয়েছিল কখনো? না। সকল যুগে, সবসময়ই কুরবানির বিধান ছিল। আল্লাহ তায়ালা বলেছেন-
“আর প্রত্যেক জাতির জন্য আমি কুরবানির বিধান ঠিক করে দিয়েছি। যাতে তিনি তাদের যেসব চতুষ্পদ জন্তু দিয়েছেন, সেগুলোর ওপর তারা আল্লাহর নাম উচ্চারণ করে। তোমাদের ইলাহ-ই একমাত্র ইলাহ। সুতরাং তোমরা তাঁর কাছে নিজেদের সমর্পণ করো। আর আপনি সুসংবাদ দিন বিনয়ীদের।” (সূরা আল-হজ্জ : ৩৪)
এভাবে আমাদের কাছেও এসে পৌঁছেছে কুরবানির পয়গাম। আমরাও পশু জবাই করি প্রতি বছর। দু’চোখে তখন অশ্রু টলোমল করে, আর বুকে ঢেউ খেলে আল্লাহর আদেশ পালনের শীতল সুখ। আমরা কীভাবে পেলাম এই উপহার, সে কথাই বলব এখন!
সমর্পণের অমর গল্প
সেদিন কার কাছে কে কী সমর্পণ করেছিলেন, জানো? আল্লাহর কাছে, মহান মালিকের কাছে ইবরাহিম (আ) সমর্পণ করেছিলেন তাঁর কলিজার টুকরোকে! প্রাণপ্রিয় পুত্র ইসমাঈলকে! আর ইসমাঈল? তিনি সমর্পণ করেছিলেন নিজেকেই! হাসিমুখে। বাতাসও হয়তো সেদিন অঝোরে কেঁদেছিল। হয়তো ফেরেশতারাও বুকে পাথর বেঁধে দেখছিল সেই বিরলতম দৃশ্য! কিন্তু আল্লাহর পরিকল্পনা তো ভিন্ন। তিনি তো রাহমান, প্রেমের অথই দরিয়া!
কী সেই দৃশ্য?
নবী ইবরাহিম (আ) আল্লাহর কাছে একটি সুসন্তান চেয়েছিলেন। আল্লাহ তাঁকে সুসংবাদও দিলেন এমন একজনের, যে হবে ধৈর্যশীল। জ্ঞানী। তারপর সে পৃথিবীতে এলো এবং বড়ো হতে লাগল ধীরে ধীরে। তারপর? তার পরের কথা এসো কুরআন থেকেই জেনে নিই-
“অতঃপর সে যখন তার পিতার সাথে চলা-ফেরার বয়সে উপনীত হলো, তখন ইবরাহিম বলল- হে প্রিয় ছেলে! স্বপ্নে দেখি, আমি তোমাকে জবাই করছি। এখন তোমার অভিমত কী? বলো। সে বলল- হে আমার পিতা! আপনাকে যা আদেশ করা হয়েছে তা-ই করুন। আল্লাহর ইচ্ছায় আপনি আমাকে ধৈর্যশীল পাবেন।”
(সূরা আস-সাফফাত: ১০২)
কী ঈমান তাদের! যেমন বাবা, তেমন ছেলে! ও হ্যাঁ, নবীদের স্বপ্নও কিন্তু ওহি! আল্লাহর আদেশ! তারপর কী হলো?
“তারপর যখন তারা দু’জনেই নিজেদের সমর্পণ করল এবং বাবা ছেলেকে কপালে ভর করিয়ে শায়িত করল, তখন আমি তাকে ডেকে বললাম- হে ইবরাহিম! তুমি তো স্বপ্নের আদেশ সত্যই পালন করলে! এভাবেই আমি সৎকর্মশীলদের পুরস্কার দিয়ে থাকি। নিশ্চয়ই এটা ছিল একটা প্রকাশ্য পরীক্ষা। আমি পুত্রের পরিবর্তে দিয়েছিলাম একটি বিরাট জবাইয়ের পশু।”
(সূরা আস-সাফফাত: ১০৩-১০৭)
কী পশু ছিল সেটা? বেহেশতি দুম্বা। আল্লাহ তাঁর অশেষ রহমতের দুয়ার খুলে দিলেন। খুলে দিলেন আকাশের দরোজা। পৃথিবীতে নেমে এলো অবিস্মরণীয় এক উপহার! সুবহানাল্লাহ! সেই থেকে শুরু আমাদের কুরবানি। আমরা সবসময় স্মরণ করি পিতা-পুত্রের নজরানার স্মৃতি। সোনালি ইতিহাস।
এই কুরবানি কেন?
আচ্ছা, কুরবানি না হলে এমন কী হতো? কেন আল্লাহ কুরবানির বিধান দিলেন? কুরআনের আয়াতগুলোয় চোখ রাখলে তা দিনের আলোর মতো ঝলমলে হয়ে ওঠে। মনে আছে, হাবিল কী বলেছিল? হ্যাঁ, “আল্লাহ তো কেবল মুত্তাকিদের পক্ষ হতে কবুল করেন।” মুত্তাকি! যার তাকওয়া আছে, আছে আল্লাহর ভয় ও ভালোবাসা, সেই মুত্তাকি! আল্লাহ কুরবানির মাধ্যমে তাকওয়া পরিমাপ করেন। যার ভেতরটা জোছনার মতো অনাবিল, তার কুরবানিই কবুল হয়। আমরা যে পশু কুরবানি করি, “আল্লাহ্র কাছে সেগুলোর গোশত এবং রক্ত পৌঁছায় না।”
তাহলে কী পৌঁছায়?
‘তাকওয়া’। শুধুই তাকওয়া।
(সূরা আল হজ্জ : ৩৭)
আল্লাহ দেখেন, নবী ইবরাহিম ও ইসমাঈল (আ)-এর মতো আমরা কেবল তাঁরই খুশি চাই কি-না! তাঁরই কাছে সমর্পণ করি কি-না জীবনের সবকিছু।
আরও কত কুরবানি!
এর বাইরেও কি কোনো কুরবানি আছে? আছে। এই দেখো না, কত মানুষ আল্লাহর পথে অকাতরে খরচ করে। ধন-সম্পদের মায়া তাদের কাবু করতে পারে না। আবু বকর (রা) তো তাঁর সব কিছুই দিয়ে দিয়েছিলেন। ঘরে রেখে এসেছিলেন শুধু আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (সা)-কে! আবার কেউ তো নিজের জীবনই দিয়ে দেন আল্লাহর জন্য। যেভাবে দিয়েছিলেন শহীদ সাহাবিরা! কেউ হাত হারিয়ে ফেলেন, কেউ বা পা! এগুলোও কুরবানি! তাদের জন্য শুধু পুরস্কার আর পুরস্কার!
কুরবানি শুধু পশু জবাই নয়, দীনের পথে যেকোনো ত্যাগই কুরবানি।
শেষের কথা
যিনি আমাদের জীবন দিয়েছেন, জীবনের চেয়ে তাকে বেশি ভালোবাসার মধ্যেই তো আনন্দ। শুধুই কি আনন্দ? চরম সফলতাও বটে। পৃথিবীর সব প্রিয়মুখ পেছনে পড়ে থাক, তাতে কী? সব সুখ ধুলোয় মিশে যাক, তাতেই বা কী? যদি আল্লাহর আদেশের কাছে বিলীন করে দেওয়া যায় নিজেকে, তাহলে যা পাওয়া যাবে তা অমূল্য। না, হাজার পৃথিবীর দামেও তা কেনা যাবে না।
আমরা কি সেভাবে ভালোবাসতে পারব আল্লাহকে, যেভাবে ভালো বেসেছিলেন ইবরাহিম ও ইসমাঈল (আ)?
এসো, একটু চিন্তা করি!…