Home গল্প মায়ের আর্তনাদ -নাহিদ জিবরান

মায়ের আর্তনাদ -নাহিদ জিবরান

মুষলধারে বৃষ্টি। টানা ৭ দিন ধরে। থামার কোনো নামই নেই। এদিকে নাজেহাল অবস্থা। বিশেষ করে গাঁও গ্রামের রাস্তায় হাঁটু সমান কাদা পানি।
দু’বেলা দু’মুঠো খাওয়ার জন্য এই কাদা পানিতেও কাজে বের হতে হয়।
গ্রাম আর সেই আগের মতো নেই। গোলা ভরা ধান, গোয়াল ভরা গরু, পুকুর ভরা মাছ কিছুই নেই।
এখন বাতাসে ভেসে আসে ক্ষুধার্ত মানুষের আর্তনাদ। ঘরে ঘরে শুধু অভাবের কালো মেঘ। বৃষ্টির পানি মাটিতে পড়ার আগেই যেন আমেনা বিবির ঘর ভেসে যায়।
খড়ের ছাউনি মেঘ ডাকার গর্জন কাঁপিয়ে তোলে সজোরে আমেনা বিবির ঘর। এদিকে দিন দশেক হলো জ্বরে পড়ে আছে আমেনা বিবির স্বামী মতিন আলী।
ঘরে ছোটো ছেলে-মেয়ে। ক্ষুধার জ্বালায় কাঁদছে খোকন।
জাহানারারও পেটে যেন ক্ষুধার আগুন দাউ দাউ করে জ্বলছে। কিন্তু ছোট্ট খোকনের কান্নায় যেন তার পেট আষাঢ়ের পানির মতো ভরে যাচ্ছে। আমেনা বিবির কিছুই করার নেই শুধু তাকিয়ে থাকা আর হতাশার দীর্ঘশ্বাস ফেলা ছাড়া। বৃষ্টি থেমে গেল।
আমেনা বিবির খড়ের ছাউনিও শুকিয়ে গেল। কিন্তু শুকালো না আমেনা বিবির চোখ। সেই জ্বর সেরে মতিন আলী আর ওঠেনি। মতিন আলীর চলে যাওয়াই ছিল বৃষ্টির শেষ দিন। সেই যে মতিন আলী মারা গেল সে থেকে দু’মাস কোনো বৃষ্টি হয়নি গ্রামে। তবে আমেনা বিবির চোখে কখনো বৃষ্টি থামেনি।
কালবৈশাখী ঝড়ের মতো তার বুকেও ঝড় ওঠে। খোকন বাবা হারানো থেকে ক্ষুধার তাড়নায় বেশি কাতর। জাহানারা ও আমেনা বিবির করুণ অবস্থা। শুরু হলো আমেনা বিবির বাঁচিয়ে রাখার লড়াই। তবে তা নিজের জন্য নয়। খোকন আর জাহানারাকে বাঁচানোর লড়াই।
মানুষের বাড়িতে কাজ করে আমেনা বিবি। কোনো রকমে চলে তিনটা পেট। একবেলা পানি ভাত খেয়ে তো আরেক বেলা শুধু পানি খেয়ে। জাহানারার বিয়ে দিতে হবে।
ভিটেবাড়ি বিক্রি করে জাহানারার বিয়ে দিল আমেনা বিবি। বিয়ে দিল ঠিকই তবে সে বিয়ে নয়, বেচে দেওয়া। ভিটের সাথে সাথে জাহানারাও হারিয়ে গেল আমেনা বিবির কোল থেকে।
এখন খোকনই আমেনা বিবির বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন। সব কিছু হারিয়ে খোকনকে নিয়ে এক সমুদ্র অভাবের মাঝে যেন ডুবতে ডুবতে ভেসে আছে।
খোকন এখন স্কুলে যায়। আর আমেনা বিবি মানুষের বাড়ি কাজ করে। দিন শেষে একমুঠো হাঁড়ির তলার ভাত আনে তাই খেয়ে কোনো রকমে দিন কাটায়। প্রতিদিন পোড়া ভাত খেয়ে মুখে কোনো স্বাদ নেই। এদিকে আমেনা বিবির শরীরও ভেঙে গেছে রোগে শোকে।
খোকন একদিন সে কী কান্না। গোশত দিয়ে ভাত খাবে। যেখানে ঘরে লবণই জোটে না সেখানে গোশত! এ যেন আমেনা বিবির কাছে মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা।
খোকনের কান্নায় আমেনা বিবির চোখে যেন আষাঢ়ের ঢল। কিন্তু কী করবে, কিছুই বুঝতে পারছে না। অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই তার।
এভাবে কেটে গেল অনেক বছর। খোকন এখন বড়ো হয়েছে। সবকিছু বোঝে সে। মায়ের রক্ত পানি করা পরিশ্রমে তার বেড়ে ওঠা। আমেনা বিবির কাছে খোকনের অনেক ঋণ।
খোকন চাকরি করে এখন ভালো বেতনও পায়। বিয়েও করেছে। ভালোই চলে তাদের স্বামী-স্ত্রীর সংসার। খোকন তো বিয়ে করেছে তাই আর তাকে রান্না করার জন্য চিন্তা করতে হয় না। আগে তো আমেনা বিবি ছিল। কিন্তু এখন আর সে নেই।
না মারা যায়নি! আমেনা বিবি বেঁচে আছে। তবে এ বাঁচা যেন বেঁচে থাকা নয়। খোকন বিয়ের পর ভুলে গেছে মাকে। ভুলে গেছে তাকে বুকে নিয়ে একমুঠো ভাতের জন্য মায়ের আর্তনাদের চিত্র। সেই বিভীষিকাময় দিনের কথা তার মনে পড়ে না আর।
খোকনের আর্তনাদ থেমে গেছে অনেক আগেই। কিন্তু আমেনা বিবির আর্তনাদ যেন চিরকাল বহমান। আমেনা বিবির চোখে যেন বাঁধ ভেঙেছে শ্রাবণ ধারার। খোকনের বাড়ি আছে কিন্তু আমেনা বিবি আজও নিঃস্ব। আগে খোকন ছিল এখন সেও নেই। থাকবে কী করে? খোকনের ঘরে তো আমেনা বিবির মাথা গোঁজার ঠাঁই হয়নি। খোকনের পাতিলের ভাতটাও আমেনা বিবির পেটে পড়ে না। ঐতো জরাজীর্ণ শরীর পাটকাঠির মতো দেখতে তাও মাকে খেতে দেয় না খোকন। খোকন অতীত ভুলে গেছে।
আমেনা বিবির সেই ভাতের আর্তনাদ আজও থামেনি। আগে মা আমেনা বিবি কাঁদতো ছেলেকে খেতে দিতে পারতো না বলে। আর এখন মা কাঁদে ছেলে খেতে দেয় না বলে।
খোকন তো এখন শিক্ষিত। ভালো চাকরি করে। খড়ের ঘরে থাকতে হয় না। কোনো অভাব নেই। মায়ের কথা এজন্য মনেও পড়ে না। শিক্ষিত সমাজে মাকে রাখতে খোকনের সম্মানে আঘাত লাগে তাই আমেনা বিবির ঠাঁই হয়নি খোকনের কাছে। জাহানারার শ্বশুরবাড়িতে আমেনা বিবির ঠাঁই হয়নি। তাদেরও অভাবের সংসার। খোকন আমেনা বিবির ঠাঁই খুঁজে ঠিকই দিয়েছে। আর তা হলো বৃদ্ধাশ্রম! যেখানে হাজারো মায়ের আর্তনাদের সাথে আমেনা বিবির আর্তনাদও মিলে মিশে একাকার হয়ে গেছে।

SHARE

Leave a Reply