আজ রবিবার। দুদিন পরই বাবা আসবে শহর থেকে। বাবা আসার দিনটায় উন্মুখ থাকে আয়ান। প্রায় রাতেই অবশ্য ঘুমিয়ে যায়। পড়া শেষ করে ভাত খেয়েই রাত নয়টার ভেতরেই বিছানায় যেতে হয়। বাবা আসে আরও রাত করে। তবে রোজার শেষের দিকে, ঈদের আগে আয়ানের জিদের কাছে মা হেরে যায়। সপ্তাহে দুটো দিন বাবাকে কাছে পায়। তখন জমে থাকা কথা, আবদার আর বাবার হাত ধরে বিকেল বেলায় ঘুরে বেড়ানো আর কখনো কখনো সিরাজ চাচার দোকানে বাবা যখন এটা সেটা কিনে। তখন একটা মিমি চকোলেট আয়ানের পাওয়া হয়ে যায়।
আজ যেন সেইসব কিছুতেই মন টানছে না। বারবার রাকিবের গাছ থেকে পড়ে যাওয়ার ছবিটাই চোখে ভাসছে। মাহিন, রফিক, তাহের, আরিফ আরও কতজন রাকিবকে ঘিরে আছে। ভীষণ যন্ত্রণায় ছটফট করা রাকিবকে নিয়ে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পরও আয়ান অনেকটা একাই দাঁড়িয়ে ছিল। সব ভুলে। পৃথিবী ভুলে।
কতক্ষণ এইভাবে এই গাছটার ছায়ায় দাঁড়িয়ে আছে আয়ানের মনে নেই। গাছের ওপরের দিকে সেই ভাঙা ডালটা আধখানা হয়ে এখনো গাছেই আছে। সাক্ষী হয়ে। আয়ান ভাবছে রাকিবের ভাঙা পা আবার ঠিক হবেতো? কাছের মসজিদ থেকে আসরের আযান কানে আসতেই মনে হলো। এবার বাড়ি না ফিরলে মা খোঁজ করবে।
ইফতারি খাওয়ার মাঝামাঝি এক চামুচ পায়েস মুখে দিয়েই মায়ের দিকে তাকায় আয়ান।
মা হাসপাতালে কি ইফতারি দেয়? পানি শূন্য গ্লাস টেবিলে নামিয়ে রেখে ছেলেকে বলে।
এ কেমন কথা আয়ান। হাসপাতালে যারা থাকে তারাতো রোগী। তাদের তো ঔষধ খেতে হয়। খাবার খেতে হয়। তাই ওরা ইফতারি খায় না। তুমি কেন এই কথা জানতে চাইছো আয়ান।
মা রাজু বলেছিল ঈদের আগেই রাকিব আসবে। তাহলে তো ও ভালোই আছে তাই না।
জবাব না শুনেই ওঠে দাঁড়ায় আয়ান। রুমে এসে বই খোলে। ধোৎ পড়া না ছাই। মনই বসতে চাইছে না। বাবা যে কখন আসবে। বারবার বলের কথা মনে করিয়ে দিয়েছিল আয়ান। তার বলটায় হাওয়াই থাকতে চায় না। দেয়াল ঘড়িতে চোখ রাখতে যাবে, অমনি শুনতে পায় বাবার কণ্ঠ। মা কথা বলছে বাবার সাথে। বই বন্ধ না করেই এক দৌড়ে এসে বাবাকে জড়িয়ে ধরে।
রাতের খাওয়ার পর বিছানাতেই সবাই গোল হয়ে বসে। ব্যাগ খুলে প্রথমেই আয়ানের হাতে বল ধরিয়ে দেয় আখতার হোসেন। বল হাতে নিয়ে খুব খুশি আয়ান। ডান হাত বাড়িয়ে বলে।
বাবা চকোলেটগুলো দাও।
শুধু চকোলেট হলেই হবে? আর কিছু চাই না? কথার সাথে সাথে আখতার হোসেন বের করে জামা, জুতো, প্যান্ট। মায়ের জন্য আনা উপহার ও আলাদা করে রাখে। বেজায় খুশি আয়ান নিজের জামা, প্যান্ট উল্টে পাল্টে দেখছে।
হঠাৎই আখতার হোসেন বলেন।
আয়ান, রাকিবকে দেখতে গিয়েছিলি? আসার পথে শুনলাম, রাকিব বাড়ি ফিরেছে।
কই আমি জানতে পারিনি তো বাবা। কে বললো তোমাকে? কাল সকালেই আমি যাবো। খুব দেখতে ইচ্ছে করছে বাবা।
আয়ান যখন রাকিবের সাথে গল্প জুড়েছে তার খানিক পরেই আসে মাহিন, তারেক, রফিক। রাকিব ভাবে কতদিন ওদের সাথে দেখা নেই। কথা নেই। সকলেরই একসাথে যেন কথার গিঁট খুলে যায়।
হ্যাঁ রে রাকিব, তোর পায়ের আর সমস্যা নেই তো? মাহিন বলে ওঠে।
না তেমন নেই। তবে ব্যথা আছে একটু। ডাক্তার বলেছেন কিছু দিনের ভেতরেই আমি ফিট হয়ে যাবো। হাঁটার সময় আর অসুবিধে হবে না।
জানিস রাকিব, আমাদের সবার খুব চিন্তা ছিল। যদি তুই আর হাঁটতে না পারিস। আয়ান তো প্রায় সময় সেই গাছের নিচে দাঁড়িয়ে ভাবতো। সেইতো তোকে বলেছিল ঘুড়িটা পেড়ে দিতে। তারেক বলে ওঠে।
সাথে সাথেই আয়ান বলে। আমাকে মাফ করে দে ভাই। আমার জন্যই তোর এই দশা। কত দিন বাড়ি ছিলি না।
এইভাবে কেন বলছিস আয়ান। আমিই তো জিদ ধরলাম। ঘুড়িটা পেড়ে আমরা মাঠে উড়াবো। অসাবধানতায় কখন যে শুকনো ডালটায় পা দিয়েছি। তারপর আর কিছুই মনে নেই।
আসলে কী জানিস রাকিব। মানুষের সব কিছুতেই সাবধান হওয়া দরকার। বিপদ কখন আসে বলা যায় না। রফিক বলে ওঠে।
আয়ান একটা প্যাকেট রাকিবের হাতে দিয়ে বলে-
এটা বাবা এনেছে, তোর জন্য। খুলে দেখতো পছন্দ হয়েছে কি না।
কৌতূহলে রাকিব প্যাকেট খোলে। একটা হলুদ জামা। খুব সুন্দর লতাপাতা আঁকা। দারুণ খুশি হয় রাকিব।
এবার তারেক, মাহিন, রফিক এগিয়ে দেয়। তাদের হাতে বানানো ঈদকার্ড। ঘরে যেন খুশির জোয়ার আসে। বন্ধু ছাড়া কত দিন ওদের কেটেছে। তিনজন একসাথে হলেও। আর একজনের অভাব যেন পূরণই হতে চাইতো না। ঈদের দিন একসাথে নামাজ পড়ার প্রতিশ্রুতি নিয়ে সবাই বাড়ি ফিরে। রাকিব তার পাওনা গিফটগুলো একসাথে রাখে।
এতদিন হাসপাতালে কষ্ট পাওয়ার দুঃখটা এখন আর নেই।…