Home নিয়মিত সেকাল ও একাল -মোহাম্মদ লিয়াকত আলী

সেকাল ও একাল -মোহাম্মদ লিয়াকত আলী

ঈদ মানে আনন্দ ও খুশি। ঈদ আনন্দে মাতোয়ারা থাকতো সেকালের শিশু-কিশোররা। ঈদ যেন তাদের জন্যই। এক ঈদ চলে গেলে অপেক্ষায় থাকতো আরেক ঈদের। ঈদ ভেকেশন মানে দীর্ঘ ছুটি। লেখাপড়ার চাপ কম। ছাত্রদের মাথায় শুধু ঈদ পরিকল্পনা। পাঠ্য বইয়ের মুখস্থ করা কবিতাটির বাস্তব প্রতিফলন :
হল্লা করে ফিরবো মোরা সবার ঘরে ঘরে
ফিরনি পোলাও কোরমা খাবো যার যা মনে ধরে।
সবার দুয়ার খোলা আজি কোথাও নেই মানা
খাঞ্চা ভরে বিলাবো আজ নানা রকম খানা।
একালে এসে হারিয়ে গেছে সেই ঈদ। কারো দুয়ার এখন খোলা নেই। তালাবদ্ধ গেটে দারোয়ান। পরিচয় দিয়ে ঢুকতে হয়। হল্লা করে ঘরে ঘরে ঢুকে ইচ্ছেমতো ফিরনি পোলাও কোরমা খাওয়া অত সস্তা নয় একালে। চায়ের কাপের ছোট্ট পিরিচে দু’চামচ লাচ্চা সেমাই একালের ঈদ আপ্যায়ন।
সেকালে আপ্যায়নের ভাষা ছিল শ্রুতিমধুর ও ন¤্র :
– ভাই, অনেক কষ্ট করে গেলেন। তেমন সমাদর করতে পারলাম না। আবার আসবেন।
একালের মেহমান একটু বেশি খেলে মেজমানের চেহারায় ফুটে ওঠে বিরক্ত। মুখে কিছু না বল্লেও বডি ল্যাংগুয়েজে বুঝা যায় : মজা পাইয়া খাইছেনতো জন্মের খাওয়া। জীবনে এমন খাওন মনে অয় চোহেও দেহেন নাই। সারা জীবন মনে রাখবেন আর জিব্বার পানি চাটবেন। আল্লাহর নাম লইয়া বিদায় অন। বাড়িত যাইয়া ফেলাজিন খান।
একালে কেউ সন্ধ্যা আকাশে ঈদের চাঁদ খোঁজেনা।
যে আগে দেখিতে পায়
সবাইকে ডেকে বলে
ঐ দেখো, ঐ দেখা যায়
তারপর পটকা ফুটিয়ে ঈদের খবর জানানো হয়। একালে চাঁদ দেখার দায়িত্ব ইসলামিক ফাউন্ডেশনের। চাঁদের খবর দিবে চাঁদ দেখা কমিটি। দেশবাসী বসে থাকে টিভি পর্দার সামনে। চাঁদ দেখা না গেলে কমিটির মুণ্ডপাত করতে থাকে। সীতাকুন্ড পাহাড়ে চড়লেইতো চাঁদ খুঁজে পাওয়া যেত। একালের কবিরা রোজা ও ঈদ নিয়ে কবিতা লেখে নতুন ঢংয়ে :
নামাজ পড়তে মন চায়না, রোজা রাখতে কষ্ট হয়
ইফতার খেতে মজাই লাগে, ঈদ উৎসবে নেইতো ভয়
সুদের টাকা, ঘুষের টাকা, টাকার গায়ে লেখা নেই
সেই টাকাতে মার্কেটিংয়ে তাইতো কোনো বাধা নেই।
হালফ্যাশনের জামা জুতা, শাড়ি গয়না কসমেটিক
ঈদের বাজার গরম করে ঈদ উৎসব জমবে ঠিক
কয়েনগুলো জমা আছে, ফকির মিসকিন পাতলে হাত
সত্তর গুণ ছোয়াব কিনে করে ফেলবে বাজিমাত
খাও দাও ফুরতি করো ঈদ উৎসবে বাধা নেই
নামাজ রোজা করার জন্য হুজুররাতো আছেই।
ঈদ পুনর্মিলনী শব্দটি একালের আবিষ্কার। তবে সেকালেও ঈদ পুনর্মিলনী হতো। ঈদের ছুটির পর প্রথম কর্মদিবস ছিল উপভোগ্য ঈদ পুনর্মিলনী। অফিস আদালতে তেমন কাজকর্ম হতো না। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে স্যারদের হাতে বেত থাক্ত না। ক্লাসে ক্লাসে শুধু ঈদের স্মৃতিচারণ।
এক হতভাগার। অনেক দিনের স্বাদ ছিল একজোড়া নতুন জুতার। তাও পূরণ না হওয়ায় আফসোস করে বলে :
– আমার কপালে জুতা নাই। এক সহপাঠী নিজের চটি খুলে তার কপালে গোটা দুই চাটি মারে।
সবকালেই ঈদ বাজার জুতা ব্যবসায়ীদের ভরা মওসুম। অচল মাল সচল করার সুযোগ নেয় অনেক ব্যবসায়ী। ছলচাতুরী করে অনেকে সহজ সরল ক্রেতাদের বোকা বানায়।
এক ক্রেতা সুন্দর এক জোড়া জুতা পছন্দ করে জিজ্ঞেস করে :
-এই জোড়ার দাম কত?
-এক হাজার টাকা।
-পাঁচশ টাকায় হয় না?
-হবে না কেন? দেন, টাকা দেন।
পরদিন সেই ক্রেতা আবার দোকানে হাজির। দোকানিও তার অপেক্ষায় ছিলেন। তিনি জানতেন, ব্যাটা আসবেই।
-ভাই, আপনি ভুল করে জুতা একটা দিয়েছেন।
– জোড়া এক হাজার টাকা হলে পাঁচশ টাকায় কয়ডা পাইবেন? হিসাব কিতাব সব ভুইলা গেছেন নাকি?
– জুতা কি কেউ একটা কিনে?
– যাদের পা একটা, তারা দুইডা কিনবো কোন দুঃখে? জাগো একটা হারায়া গেছে, তারা কয়ডা কিনবো?
– আমি ঐ রহম কোনো দলে পড়ি না। আমার এক জোড়াই দরকার। আল্লাহ সব কিছু জোড়া জোড়া বানাইছেন।
– প্যাচাল না পাইরা আরো পাঁচশ টাকা দিয়া জোড়া লইয়া যান। ঈদের বাজার কথা কম, কাম বেশি। বাজারে জোড়া কলা পাওয়া যায়। একটার দামে আর একটা ফ্রি।
বিভিন্ন শ্রেণি ও পেশার মানুষ নানান পদ্ধতিতে ঈদ করে। জুয়ারিরা জুয়ার আড্ডায়, মাদক সেবীরা মদের আড্ডায়। বিষাক্ত মদ খেয়ে প্রতি বছর দু’চার জন মারা যায়।
জুয়ার আড্ডায় সর্বস্ব হারিয়ে অনেকে সুইসাইড করে। রোজাদারদের তুলনায় বেরোজদারদের ইফতার ও ঈদ উৎসব সব কালেই বেশি। তাদের যুক্তিও সাংঘাতিক :
– রোজা না রাইখা এক পাপ করছি, ইফতারও না কইরা বেইমান অইয়া মরমু নাকি?
ঈদ মওসুমে চোর ছ্যাচ্চোরদের উপদ্রব বেড়ে যায়। চোরেরাও ঈদ করে। এক গরু চোরের ছেলে বাবাকে কুরবানি করার আবদার করে। সে আবার স্কুলেও পড়ে। ছেলের মন রক্ষার জন্য একটি গরু চুরি করে যথানিয়মে কুরবানি দেয়। তার সোজা হিসাব। চুরি করায় পাপ হয়েছে, কুরবানি করায় সওয়াব হয়েছে। প্লাসে মাইনাসে রেজাল্ট জিরো। কিন্তু গোস্তগুলো রয়ে গেছে। খাইলেও লাভ, ডিসকাউন্টে বেচলেও লাভ।
ঈদের সবচেয়ে বড়ো আকর্ষণ, নিম্ন ও মধ্যবিত্তদের আপডাউন ঈদযাত্রা। নাড়ির টানে বাড়ি ফেরা, জীবিকার টানে কর্মস্থলে। বিশেষ ট্রেন, বিশেষ লঞ্চ, বিশেষ কোচ দিয়েও ঠেলা সামলানো যায় না। কোমরে দড়ি বেঁধে ছাদে যাত্রী তোলার দৃশ্য দেখে আনন্দ পায় দর্শক স্রােতারা। লাইভ সম্প্রচারে সাক্ষাৎকার দিয়ে আনন্দ পায় হতভাগা যাত্রীরাও।
নিম্নবিত্তরা যখন নাড়ির টানে বাড়ি যায়, উচ্চবিত্তরা তখন বাড়ি ছেড়ে বাইরে গিয়ে ঈদ করে। দেশ-বিদেশের পর্যটন কেন্দ্রগুলোতে তাদের উপচেপড়া ভিড়। হোটেল মোটেল রেস্তরাঁয় ঠাঁই নাই, ঠাই নাই স্লোগান।
দার্জিলিংয়ের পাহাড়ি রাস্তায় গাড়ি উলটে মারা যায় নাসিম গ্রুপ অব কোম্পানির পরিবার। কক্সবাজার থেকে ফেরার পথে চকরিয়ায় খাদে পড়ে মারা যায় নানকের ছেলে। মদ খেয়ে গাড়ি চালাতে গিয়ে ব্রিজকে সাইড দিতে এই দুর্গতি। একালও অদূর ভবিষ্যতে সেকালে পরিণত হবে। নতুন মাত্রা যোগ হবে ঈদ উৎসবে। আগামীকাল কী ঘটবে, তাও মানুষ জানে না। অনাগত ভবিষ্যৎ নিয়ে ভেবে কী হবে?
তবে কিয়ামত পর্যন্ত একই নিয়মে সূর্য উঠবে, প্রতি মাসে আকাশে বাঁকা চাঁদ উঠবে। ঈদ আসবে কখনো শীতে, কখনো বর্ষায়। যেহেতু সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের সুন্নতের কোনো পরিবর্তন নেই। সেই আল্লাহর বিধান মতো রোজা ও ঈদ ব্যবসা-বাণিজ্য, ঘর-সংসার করলে কোনো কালেই লাভ ছাড়া কারো কোন ক্ষতি নেই।

SHARE

Leave a Reply