জারিফ আর জাহিন আসরের সালাতের পর প্রতিদিন রায়হানকে ডাকতে আসে ক্রিকেট খেলার দাওয়াত নিয়ে। কিন্তু কয়েকদিন পর ক্যালিগ্রাফির একটা প্রতিযোগিতা আছে বলে আজকে সে বিকেলে খেলতে গেল না। ক্যালিগ্রাফি মশ্ক বা অনুশীলন করছে। জারিফ বলল, ভাইয়া ক্যালিগ্রাফি দেখতে তো খুব সুন্দর লাগছে, তোমার ক্যালিগ্রাফি দেখে আমারও এটা করতে ইচ্ছে করছে। জাহিন বলল, আমারও খুব ইচ্ছে হচ্ছে, কিন্তু ক্যালিগ্রাফি শিখবো কেমন করে?
রায়হান বলল, শোনো, ক্যালিগ্রাফি হচ্ছে ছবি আঁকার মতো একটা শিল্পকলা। তুমি কাগজে মনের মতো রঙ দিয়ে যেমন ইচ্ছেমত ছবি আঁকতে পারো, তেমনি এই ধরনের মাথা তেরচা করে কাটা কলম দিয়েও ক্যালিগ্রাফি করতে পারো। তুমি যেমনই আঁকো কেউ তোমাকে বাধা দেবে না। কিন্তু কোনো প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে হলে তোমাকে সেই প্রতিযোগিতার আইন-কানুন নিয়ম-বিধি মেনে অংশ নিতে হবে, তা নাহলে বাছাই পর্বেই প্রতিযোগিতা থেকে বাদ পড়তে হবে। এজন্য মৌলিক শিক্ষা নিতে হবে। আর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছাড়া ক্যালিগ্রাফি শেখা প্রায় অসম্ভব। এখন খুঁজে দেখতে হবে ক্যালিগ্রাফি শেখার প্রতিষ্ঠান কোথায় আছে। আর প্রতিষ্ঠান হয়ত তোমরা পেয়েছো কিন্তু তারা আসল ক্যালিগ্রাফি শেখায় কি না তা যাচাই করতে হবে। ক্যালিগ্রাফি যেকোনো মাধ্যমে যেকোন উপায়ে করতে পারো, তবে না জানলে আসল ক্যালিগ্রাফি করা খুবই কঠিন। জাহিন বলল, দাঁড়াও, দাঁড়াও! আমি বুঝবো কেমন করে কে আসল ক্যালিগ্রাফি শেখাতে পারবেন।
রায়হান হেসে দিয়ে বলল, এই যে আমার হাতে একটা কলম দেখছো, এটার নাম কলমুল খত বা ক্যালিগ্রাফি কলম। এটা বাশের কঞ্চির বলে এটার নাম কলম বুস। এরকম কলম বুরা, কলম কামিস, কলম তুমার ইত্যাদি নামের ক্যালিগ্রাফি কলম আছে। এই কলমে বিধি মোতাবেক লিখতে পারাটা হচ্ছে প্রথম যোগ্যতা। তারপর কোন পদ্ধতি ও সেই পদ্ধতির কোন কোন পর্যায় ক্যালিগ্রাফি শেখাবেন সেটা যাচাই করা।
আচ্ছা, পদ্ধতি আর তার পর্যায়গুলো কী? জাহিন জানতে চাইল। রায়হান বলল, পৃথিবীতে আরবি ক্যালিগ্রাফির খুব নামডাক আছে। এজন্য আরবি ক্যালিগ্রাফি অনেকে শিখতে চায়। আর এটা যেহেতু মুসলমানদের নিজস্ব শিল্পকলা, তাই এর মৌলিক পদ্ধতি সবদেশে প্রায় একই রকম। শুরুতেই যে পদ্ধতি অনুসরণ করা হয় এর নাম নিজাম আল নুকাত বা নোকতা পদ্ধতি। এর সাথে নিজাম আল দায়েরা ও নিজাম আল তাশাবুহ পদ্ধতিতে ক্যালিগ্রাফি শেখানো হয়।
জারিফ বলল, আমরা আরবি হরফে যে নোকতা দেখি সেটা দিয়ে কীভাবে ক্যালিগ্রাফি শেখানো হয়?
রায়হান বলল, আসলে হরফ চিহ্নিত করতে যেমন নোকতা ব্যবহার করা হয়, ক্যালিগ্রাফি শিখতেও তেমনি নোকতার ব্যবহার আছে, তবে এর রকমফের আছে। একে পরিমাপের নোকতা বলে, এর আরেকটি নাম হলো কত্। ক্যালিগ্রাফি কলমের মাথা যেহেতু এক কোপে তেরচা করে কাটতে হয়, এজন্য একে কত্ বলে। বাংলায় কাটা আর আরবি কত্ শব্দের একই মানে। হয়ত আরবি থেকে বাংলায় কাটা শব্দটি এসেছে। চৌকোনা নোকতাটা দিয়ে হরফের প্রস্থ ও দৈর্ঘ্য মাপা হয়, একে বলে মিজানুল খত। মিজানুল খত দিয়ে হরফের আকার ও আকৃতি ঠিক হলো কি না তা যাচাই করা হয়। এতক্ষণ যা বললাম এগুলো ক্যালিগ্রাফি শেখার একেবারে প্রাথমিক কথা।
জাহিন বলল, আচ্ছা ভাইয়া, এর সাথে আর কি কিছু আছে যা প্রথম দিকে শিখতে হয়? রায়হান বলল, আরবি ক্যালিগ্রাফির সবকিছু যেহেতু আরবি থেকে এসেছে, তাই এর কিছু পরিভাষা আছে যা ওস্তাদের কাছ থেকে হাতেকলমে শিখতে হয়। মুখে বলে বোঝানো কঠিন। নিজাম আল নুকাতে যখন ওস্তাদজি ক্যালিগ্রাফি শেখান, তিনি তিনটি বিষয় উল্লেখ করেন। এক. জাবিয়া বা কৌণিক অবস্থান, দুই. ইত্তেজাহ বা কলমের গতিপথ নির্দেশনা এবং তিন. কিয়াস তুল ওয়া আরদ বা হরফের দৈর্ঘ্য ও প্রস্থ চিহ্নিত করা।
প্রথম জাবিয়া হলো যে শৈলীতে ক্যালিগ্রাফি শেখানো হবে সে শৈলীর নিয়ম অনুযায়ী কত ডিগ্রিতে কলম কাগজের ওপর রাখতে হবে তা নির্ণয় করা। যেমন সুলুস শৈলীতে কলমের জাবিয়া হলো ৬০ ডিগ্রি আর রুকআ শৈলীর জাবিয়া ৪৫ ডিগ্রি। জাবিয়া নির্ণয়ের সহজ পদ্ধতি আছে সেটা তোমাদের এঁকে দেখাচ্ছি। দ্বিতীয় ইত্তেজাহ হলো হরফ লিখতে কলমটি কোন দিকে যাবে, তা তীর চিহ্ন দিয়ে দেখানো হয়। তৃতীয় কিয়াস, আমরা জানি কোন কিছু সঠিক পরিমাপ ছাড়া সুন্দর দেখানো যায় না। হরফের দৈর্ঘ্যে প্রস্থে তার আকার-আকৃতি কেমন হবে তা কত্ বা চৌকোনা নোকতা দিয়ে দেখানো হয়। আশা করি ক্যালিগ্রাফি শেখার প্রাথমিক ও মৌলিক বিষয়গুলো জানতে পারলে। এছাড়া শুরুর দিকে আরও বিষয় আছে তা অন্য দিন বলবো। জাহিন ও জারিফ বলল, অসংখ্য শুকরিয়া ভাইয়া। আজ ক্যালিগ্রাফি শেখার বহু মূল্যবান কথা জানতে পারলাম।
সালাম দিয়ে তারা বিদায় নিলো।