ছুটিতে বাড়ি গেলে খুব ব্যস্ত সময় কাটে। বন্ধু-বান্ধবদের পর্যাপ্ত সময় দেওয়া হয়ে ওঠে না। সাংবাদিক বন্ধু আব্দুস সামাদ খান এবার কিছুতেই ছাড়লেন না। শেষে দাওয়াত গ্রহণ করতেই হলো। খান আমাদের পত্রিকার বেলকুচির প্রতিনিধি। ঠিক কথামতো দু’দিন পর খান মোটরসাইকেল নিয়ে এসে হাজির। যেতে হবে। বেশ রোমাঞ্চ অনুভব করলাম : অনেকদিন গ্রাম দেখা হয় না। নদী, পাখ-পাখালি, সবুজ বন… খান বারবার বলছিলেন, এনায়েতপুর আধুনিক হাসপাতাল ঘুরিয়ে দেখাবেন। গ্রামে হাসপাতালের কী দেখব! এমন একটা ভাব ভেতরে চেপে রেখেছিলাম। বাস্তবে যখন দেখলাম তখন এর যথার্থ গুরুত্ব অনুধাবন করলাম। সে গল্প না হয় একটু পরে করা যাবে।
যা হোক, খানের মোটরসাইকেলে চেপে বসলাম। আমাদের উল্লাপাড়া থেকে বেলকুচির দূরত্ব পঁচিশ কিলোর মতো। বন্ধুটি যে এত ভালো চালক তা জানতাম না। অনেক দিন পর মোটরসাইকেলে জার্নি করছি। বুকের ভেতর একটু দুরু-দুরু করছিল। একটা অজানা আশঙ্কা কাজ করছিল। কিছুক্ষণের মধ্যেই সে ভাব কেটে গেল। আমার দু’চোখ সবুজে নিবদ্ধ হলো। রাস্তার দু’পাশে সামাজিক বনায়নের অফুরন্ত সমারোহ। সবুজ ঘন বনের সাথে মিতালি করতে করতে আমরা যেন ছুটে চলেছি। কিছুক্ষণের মধ্যে আমরা উল্লাপাড়া পৌরশহর পেছনে ফেলে ঘাটিনা রেলব্রিজ ঘাটে এসে পৌঁছলাম। ঘাটিনা ব্রিজ মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি বিজড়িত একটি স্থান। এখানে ভয়ঙ্কর যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল। ‘ফুলজোড়’ নদীর ওপর এ রেলব্রিজটি আজও সে ইতিহাস ধারণ করে আছে। আমরা খেয়া নৌকায় উঠলাম নদী পার হওয়ার জন্য। বেশ বড়ো নৌকা। বর্ষার পানিতে টান ধরেছে।
তাই প্রবাহ ক্ষীণ। হরেকরকম মানুষ পেশার উপকরণ নিয়ে খেয়া নৌকায় উঠেছে। গ্রামের মানুষের জীবনেরই একটা চালচিত্র এ খেয়াপাড়ের তরী। যেন জীবনেরই সেতুবন্ধন। নদীর পানি ছুঁয়ে দেখতে ইচ্ছা করল। খরা জালে মাছ ধরছে জেলেরা। মাছরাঙার তির্যক দৃষ্টি। শিশুরা পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়ছে। সাঁতার কাটছে। মুক্তিযুদ্ধের সময় আমরা শহর ছেড়ে এই ফুলজোড় নদী পাড়ি দিয়ে ওপারে নানাবাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিলাম। নানার সাথে গ্রামের হাটে যেতাম। তখন এই খেয়া নৌকায় ওঠার সুযোগ হতো। আব্বার সাথে নদীতে গোসল করতে, সাঁতার শেখার আনন্দের আর শেষ ছিল না। দেশ স্বাধীন হলো আমরা শহরে ফিরে এলাম। তারপর বহুকাল আর ফুলজোড় দেখা হয়নি। একটু ধাক্কা লাগতেই সম্বিত ফিরে পেলাম। কখন যে শৈশবে ফিরে গেছি বুঝতে পারিনি। বন্ধু বললেন, পাড়ে এসে গেছি নামতে হবে।
আবার যাত্রা শুরু হলো। গ্রামের মেঠোপথ পাকা হয়েছে। কোথাও ইট বিছানো। চলার স্বাচ্ছন্দ্য আছে। ‘আজ হারিয়ে যেতে নেই মানা’ কিন্তু পথ হারালে তো চলবে না, জীবনের পথ খুঁজে নিতেই হবে। সে কথাই বলছিলেন বন্ধুবর। গ্রামের উন্নয়ন হয়েছে। মানুষের জীবনযাত্রায় আধুনিকতার ছেঁাঁয়া লেগেছে। গ্রামের মানুষ আজ স্বপ্ন দেখতে পারে।
দেখতে দেখতে এক বিশাল বিলের মধ্যে এসে পড়লাম যেন। দু’পাশে জলাশয় মাঝ দিয়ে রাস্তা বয়ে গেছে। একসাথে এত সাদা ধবল বক আর কখনো দেখিনি। ইতঃস্তত শাপলা ফুটে আছে। দু-একটি ডিঙি নৌকায় বালকরা দুলছে, ছিপ ফেলছে।
বন্ধুকে গাড়ির গতি একটু কমাতে বললাম। এত বক একসাথে বিচরণ করছে কেউ ধরছে না। শিকার করছে না- আশ্চর্য বৈ কি! বন্ধু বললেন, এখানকার মানুষ হয়তো একটু বেশি সচেতন।
মোটরসাইকেল ছুটে চলেছে। পরিবেশগত একটা ভিন্নতা লক্ষ করলাম। আমরা বুঝি বেলকুচি জনপদে ঢুকে পড়েছি। এ উপজেলাটি তাঁতশিল্পসমৃদ্ধ। ঘরে ঘরে তাঁত কারখানা দেখা যাচ্ছে। সুতা কাটার চরকা ঘুরছে। কিন্তু তাঁতের সেই খট্ খট্ শব্দ তেমন শোনা গেল না। বন্ধু বললেন, ছুটিতে অধিকাংশ কারখানা বন্ধ। তা ছাড়া তাঁতশিল্পের আগের সেই সোনালি দিন এখন আর নেই।
জোহরের আজান ভেসে আসে। খান গাড়ি থামালেন। বুঝতে বাকি থাকল না এটি খানের বাড়ি। কেননা খানের মুখেই তার বাড়ির গল্প শুনেছি। সত্যিই অনুপম। পাকা দেয়ালের ওপর কারুকাজ করা টিনের চৌচালা ঘর সবার দৃষ্টি কাড়ে।
একজন রুচিশীল মানুষের বাড়ি। গাড়ির শব্দ শুনে রবীন্দ্রনাথের কবিতার বালিকার মতো একটি মেয়ে বৈঠকখানার দরজা খুলে দিয়ে সামনে এসে দাঁড়ায়। খান পরিচয় করিয়ে দিতেই মেয়েটি মিষ্টি হেসে সালাম দিলো। ঘরে একটু আয়েশ করে বসে টেবিলে রাখা খবরের কাগজে চোখ রেখেছি। মেয়েটি আবার এসে সালাম দিলো। একটু দ্বিধা নিয়েই উত্তর দিলাম। খান দূর থেকে ব্যাপারটা বুঝতে পেরে এগিয়ে এলেন। ততক্ষণে বিষয়টা পরিষ্কার হলো। আমি ভুলে গিয়েছিলাম খানের ছোট মেয়ে যমজ। নূপুর ও ঝুমুর। নূপুরের মতোই ছন্দ তুলে ওরা হাঁটছিল, কথা বলছিল। দুপুরে অন্তরঙ্গ পরিবেশে খাওয়া-দাওয়া হলো। একটু বিশ্রাম নিয়ে আবার বেরিয়ে পড়লাম। মেয়েরা বিদায় জানাল। বলল, ‘আমি যেন আমার মেয়েকে নিয়ে আবার বেড়াতে আসি।’ প্রথমেই আমরা হাসপাতাল দেখতে গেলাম। এনায়েতপুর একটি থানা। এখানেই যমুনার তীরে গড়ে উঠেছে এ হাসপাতাল। হাসপাতাল দেখে আমার পিলে চমকে যাওয়ার অবস্থা। এ রীতিমতো বিশ্ববিদ্যালয়। তিন শ’ বিঘা জমির ওপর কোটি কোটি টাকা ব্যয়ে, বেসরকারি উদ্যোগে নির্মিত এ হাসপাতাল। পাশেই মেডিক্যাল কলেজ। বেশ ক’টি হেলিপ্যাড রয়েছে এখানে। এর উন্নত পরিকল্পনা, অবকাঠামো নকশা পর্যটনের অবদান সৃষ্টি করেছে। এখানে উন্নত চিকিৎসাব্যবস্থা রয়েছে। চিকিৎসা ছাড়াও প্রতিদিন দূর-দূরান্তÍ থেকে বহু লোক দেখতে আসে এ হাসপাতাল। আমি বন্ধুকে বললাম, একদিন স্কুলের ছাত্রদের পড়ানো হবে- সিরাজগঞ্জ এনায়েতপুর আধুনিক হাসপাতাল ও যমুনা সেতুর জন্য বিখ্যাত।
সময় দ্রুত ফুরিয়ে আসছে। সন্ধ্যার আগেই ফিরতে হবে। এবার আমরা যমুনা নদী দেখতে হাসপাতালের পাশ দিয়ে পূর্ব দিকে রওনা দিলাম। প্রায় তিন কিলোমিটার দীর্ঘ একটি স্পার বাঁধ সরাসরি নদীগর্ভে ঢুকে গেছে। বাঁধের মাথায় চিলেকোঠার মতো কংক্রিটের ছাউনি। আমরা সেই চিলেকোঠায় গিয়ে উঠলাম। উত্তর দিক থেকে নদীর ছলাৎ ছলাৎ ঢেউ এসে আছড়ে পড়ছে। এনায়েতপুরের বিখ্যাত কাপড়ের হাট, হাসপাতাল তথা ওই জনপদকে নদীভাঙনের কবল থেকে রক্ষার জন্য পানি উন্নয়ন বোর্ড এই বাঁধ নির্মাণ করেছে। উদ্দেশ্য নদীর গতি থমকে ঘুরিয়ে দেওয়া। মানুষের নদী শাসনের এ কৌশল সত্যিই দেখার মতো। নদীর বক্ষে দাঁড়িয়ে পড়ন্ত বিকেলে আমরা দু’জন এক অপূর্ব নৈসর্গিক দৃশ্য অবলোকন করছি। বাঁধের কারণে দক্ষিণে বিস্তীর্ণ চর পড়েছে। চরে শ্বেত-শুভ্র কাশফুল বাতাসে দোল খাচ্ছে। গাংশালিকেরা ঘরে ফিরছে। শ্যালো ইঞ্জিনচালিত নৌকার ভট্ভট্ শব্দ শোনা যাছে। একটা মৃদু মন্দ পাগলা হাওয়া আমাদের সবকিছু এলোমেলো করে দিচ্ছে। সকালে যখন রওনা দিয়েছিলাম তখন ছিল মেঘমুক্ত আকাশ। এখন নীল আকাশে একখ- কালো মেঘ যেন আমাদের দিকেই ধেয়ে আসছে। ছোটো-বড়ো নৌকাগুলো চরের পাশে গিয়ে নোঙর করল। কিছু বুঝে ওঠার আগেই দমকা হাওয়ার সাথে বৃষ্টি শুরু হলো। একটু ভয় ভয় লাগলেও নদীতে বৃষ্টির সে দৃশ্য অনুভবে আনন্দ ছড়িয়ে দিলো। বলতে গেলে আমরা চিলেকোঠায় আটকা পড়ে গেলাম। প্রায় আধঘণ্টা পর মেঘ কেটে গেল। ততক্ষণে অস্তগামী সূর্য রক্তিম আভা ছড়াচ্ছে দিগন্তে। এবার ফিরতে হয়। বন্ধু খান বললেন, আরো ঘুরে দেখানোর ইচ্ছা ছিল। আমি শুধু কবির ভাষায় বললাম,
‘বহুদিন ধরে বহু ক্রোশ দূরে
বহু ব্যয় করি বহু দেশ ঘুরে
দেখিতে গিয়াছি পর্বতমালা
দেখিতে গিয়াছি সিন্ধু।
দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া
ঘর হতে শুধু দু’পা ফেলিয়া
একটি ধানের শীষের উপরে
একটি শিশির বিন্দু।’