সত্যিকারের শিক্ষাটা কী?
তোমরা মনে রাখবে, শুধু শ্বাস নিয়ে বেঁচে থাকার নামই বেঁচে থাকা নয়। বেঁচে থাকা মানে নতুন কিছু জানা, দেখা ও জয় করা। সারা দুনিয়ায় এ মুহূর্তে কোথায় কী ঘটছে তা সম্পর্কে মোটামুটি একটা ধারণা রাখা। এর জন্য নিয়মিত খবরের কাগজ পড়তে হয়। ভালো ম্যাগাজিন পড়তে হয়। সিম্পোজিয়াম-সেমিনারে অংশ নিতে হয়। টেলিভিশন দেখতে হয়। সারা দুনিয়া সম্পর্কে ওয়াকিবহাল থাকাটাই প্রকৃত শিক্ষা।
আমাদের স্রষ্টা কে? পৃথিবীর আনুমানিক বয়স কত? কীভাবে পৃথিবী সৃষ্টি করলেন? মানুষকে কেন সৃষ্টি করা হলো? অতীতে মানুষ কীভাবে জীবন-যাপন করতো? কীভাবে তার বিবর্তন হলো? মানুষের সভ্যতা, সংস্কৃতি ও সমাজ পরিবর্তনের পথে কোন কোন আবিষ্কার তাকে সাহায্য করল? এসব কিছুর পূর্ণাঙ্গ বিবরণ জানাও প্রকৃত শিক্ষা।
যে অন্যদের জানে সে শিক্ষিত। গোটা পৃথিবী সম্পর্কে যে আপডেট ধারণা রাখেন এবং যার অর্জিত জ্ঞান অন্যের উপকারে আসে সে শিক্ষাটাই যথার্থ শিক্ষা। কিন্তু জ্ঞানী হলো সেই ব্যক্তি যে নিজেকে জানে। জ্ঞান ছাড়া কোনো শিক্ষা কাজে লাগে না। সক্রেটিসও (৪৭০-৩৯৯ ইঈ) আমাদের সেই একই কথা বলেছেন- “কহড়ি ঃযুংবষভ” অর্থাৎ নিজেকে জানো। সক্রেটিস আরো বলেছেন- “ভালো খাবার ছাড়া যেমন শারীরিক সুস্থতা অর্থহীন তেমনি জ্ঞান চর্চা ছাড়াও আত্মার উন্নয়ন অসম্ভব।” একজন প্রকৃত জ্ঞানীর কাজ হচ্ছে কোনো ব্যক্তিকে প্রশ্ন করে তার কাছ থেকে উত্তর জেনে দেখানো যে, জ্ঞানটা তার মধ্যেই ছিল।
শিক্ষা বলতে সাধারণত আমরা অধিকাংশ ক্ষেত্রে সনদভিত্তিক শিক্ষাকেই বোঝাতে চাই। প্রকৃত আর সনদভিত্তিক শিক্ষা-দুটিই আমাদের প্রয়োজন। উদাহরণ হিসেবে একজন শল্যবিদ বা সার্জনের কথা ধরা যাক। একজন সার্জনকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে প্রায় এক দশক পড়ালেখা করতে হয়, ক্লিনিক্যাল প্রশিক্ষণ নিতে হয়। এই দীর্ঘ প্রশিক্ষণ অস্ত্রোপচারের কাজে তাঁকে দক্ষ করে তুলতে হয়। যেহেতু সার্জনের ওপর রোগীর চিকিৎসা নির্ভর করে, দায়িত্বশীল কর্তৃপক্ষ সনদের মাধ্যমে তাঁর যোগ্যতার আশ্বাস দেন। কিন্তু তিনি প্রকৃত শিক্ষায় কতটা শিক্ষিত হয়েছেন, সনদ সেই নিশ্চয়তা দিতে পারে না।
ভাষার দক্ষতা, সংখ্যা নিয়ে কাজ করার দক্ষতা, আইডিয়া বা ধারণা প্রকাশ করতে পারার ক্ষমতা মৌলিক শিক্ষার ন্যূনতম উপাদান মাত্র। জ্ঞান অর্জনের জন্য এসব বুনিয়াদি সরঞ্জাম। সত্যিকার শিক্ষিত হওয়ার জন্য এগুলো প্রয়োজনীয়, তবে পর্যাপ্ত নয়। শিক্ষিত মানুষ হওয়ার জন্য এসবের চেয়েও বেশি প্রয়োজন মানবতার শিক্ষা। অন্যের কল্যাণের জন্য শিক্ষা।
আমার খুব প্রিয় একটা প্রবাদ হলো, ‘মন একটা প্যারাসুটের মতো, খোলা থাকলেই ভালো কাজ করে।’ আমরা সবাই মুক্তমন নিয়ে জন্ম নিই। পারিবারিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও পারিপার্শ্বিক কারণে ধীরে ধীরে আমাদের মন পক্ষপাতমূলক ধারণায় বন্দী হতে থাকে। অনেকে মুক্তমনা ধারণাকে ইসলামবিদ্বেষ হিসেবে দেখেন এবং প্রচার করেন। তারা ইসলাম ধর্মকে মুক্তমনার চিন্তার বিরোধী হিসেবে প্রমাণ করাতে চান। অথচ ইসলাম মুক্তমনা চিন্তার বিরোধী নয়। ইসলাম মানুষকে স্বাধীনভাবে চিন্তা করবার অধিকার দিয়েছে। তার মতপ্রকাশের অধিকার দিয়েছে। একমাত্র ইসলামি শিক্ষাই আমাদেরকে এই পক্ষপাতদুষ্ট একপেশে চিন্তাধারা ভেঙে দিয়ে নির্দ্বিধায় ভাবার ক্ষমতা দিয়েছে।
মানবতার একটি মৌলিক প্রশ্ন, ‘ভালো আর মন্দ’ নিয়ে আমরা হাজার বছর ধরে ভাবছি। ইউরোপের সক্রেটিস, চীনের কনফুসিয়াস, ভারতীয় উপমহাদেশের গৌতম বুদ্ধ আর আমাদের মহানবীসহ অনেক মহান দার্শনিক ভালো আর মন্দের অর্থ অনুসন্ধানে ব্রত ছিলেন। তাঁদের দর্শন ও ভাবনা বিভিন্ন সভ্যতার রূপ দিয়েছে। তাঁদের শিক্ষার প্রভাবে আমাদের চিন্তাধারার অনেক অগ্রগতি হয়েছে। ভালো-মন্দ যাচাই করার ক্ষমতা আছে বলেই মানবজাতি অন্য যেকোনো প্রজাতির চেয়ে আলাদা।
ভালো-মন্দ বিচারের ধারণা থেকেই এসেছে নৈতিকতার শিক্ষা। দুর্ভাগ্যক্রমে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শাখায় নৈতিকতা শেখানো হয় না। আমি মনে করি ‘নৈতিকতার শিক্ষা’ সকল বিশ্ববিদ্যালয়-কলেজের শিক্ষার্থীর জন্য বাধ্যতামূলক হওয়া উচিত। অতিসত্বর একটি কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ না করা গেলে এবং শিক্ষার্থীদের নৈতিক শিক্ষায় শিক্ষিত করা না গেলে আগামীতে একটি শিক্ষিত অথচ অনৈতিক এবং বর্বর বিশ্ব দেখার অপেক্ষা করতে হবে। আমার এই ছোটো জীবনে আমি বহু প্রতিষ্ঠিত মানুষ দেখেছি কিন্তু তারা নৈতিকভাবে ব্যর্থ। তাদের মাধ্যমে সমাজের উপকার হতে দেখিনি। দুর্ভাগ্যজনকভাবে উপমহাদেশের শিক্ষার্থীদের তো বটেই, এমনকি সমাজের উচ্চ আসনে আসীন ব্যক্তিদের নৈতিক মান ও এর প্রয়োগ তুলনামূলক দুর্বল, খুবই দুর্বল বলে মনে হয়।
একটা উদাহরণ দিই- বাংলাদেশের অনেক ধনীর দুলালদের আমেরিকা, কানাডা, ইংল্যান্ডসহ অন্যান্য পশ্চিমা দেশে পড়তে পাঠান। ওখানে বিদেশি শিক্ষার্থীদের টিউশন ফি আমাদের দেশের শিক্ষার্থীদের তুলনায় পাঁচ-আট গুণ বেশি। প্রকৌশল কিংবা মেডিক্যাল বিষয়ে পড়ার বার্ষিক ফি ৪০ হাজার ডলারেরও বেশি। থাকা-খাওয়া ও আনুষঙ্গিক ব্যয় মিলে মোট খরচ পড়বে ন্যূনতম ৬০ হাজার ডলার বা ৫০ লাখ টাকার বেশি। বাংলাদেশ থেকে যাদের সন্তানদের ওখানে পড়তে পাঠান, তাঁদের কেউ কেউ উচ্চ ও মধ্যপদস্থ সরকারি কর্মকর্তা। তাঁদের আয়-ব্যয়ের মধ্যে কোনো সামঞ্জস্য নেই। কারও হয়তো আয়ের অন্য উৎস থাকতে পারে। কিন্তু দেশের সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনা করলে বলতে হয়, বেশির ভাগই অবৈধ পথে উপার্জিত টাকায় সন্তানদের বিদেশে পড়ানোর খরচ বহন করেন।
খবরের কাগজ পড়ে আমরা প্রতিনিয়ত জানতে পারি, দেশে পুকুরচুরি কিংবা সাগরচুরি করে কেউ কেউ ভিনদেশে মিলিয়ন ডলারের বাড়ি করেছেন। তাঁরা সবাই কিন্তু সনদপ্রাপ্ত ব্যক্তি। কিন্তু চুরি করে বিশাল সম্পদের অধিকারী হতে তাঁদের একবিন্দু দ্বিধা জাগেনি, বিবেক বাধা দেয়নি। এরা আসলে শুধু সনদই অর্জন করেছে কিন্তু প্রকৃত শিক্ষাটা অর্জন করতে পারেননি।
একটি সম্পূর্ণ বিপরীত উদাহরণও তুলে ধরতে পারি। একবার আমার খুব কাছের একজন শিক্ষক থাইল্যান্ডের রাজধানী ব্যাংককের এক হোটেলের রুমে দুই হাজার ডলার রেখে এসেছিলেন। ভুল বুঝতে পেরে যখন ফেরত গেলেন ডলার আনার জন্য, তখন হোটেল কর্তৃপক্ষ তাঁকে বললেন, রুম পরিষ্কার করার সময় হোটেলের পরিচ্ছন্নতাকর্মী ডলারগুলো পেয়ে কর্তৃপক্ষের হাতে দিয়ে গেছেন। এই পরিচ্ছন্নতাকর্মীর আনুষ্ঠানিক শিক্ষা কতটুকু তা হয়তো আমি বলতে পারব না। তবে আমি জোর দিয়ে বলতে পারি সনদ না থাকলেও নৈতিক শিক্ষাটা তাঁর যথেষ্ট পরিমাণে আছে।
যে দুটি উদাহরণ দিলাম, তার মধ্যে কোনটা ভালো আর কোনটা মন্দ, বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। কিন্তু সব পরিস্থিতি এমন সাদা-কালোর মতো স্পষ্ট নয়। বাস্তবে অধিকাংশ পরিস্থিতি ধূসর অঞ্চলে পড়ে। এসব ক্ষেত্রে ভালো-মন্দ নির্ধারণ করা জটিল। এই জটিলতা বিশ্লেষণ করে যিনি যত বেশি সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন, জ্ঞানের দিক থেকে তাঁর অবস্থান তত উঁচুতে হবে। এতে তাঁরা শুধু যে মনের শান্তি পাবেন তা নয়, কর্মজীবনেও সফলতা আসবে। নীতিবান এবং সৎ মানুষ তার প্রাপ্য সম্মান ঠিক সময়েই পেয়ে যান। হৃদয় গহিনে সততার আগুন দাউ দাউ করে জ্বালাতে না পারলে ব্যবহারিক জীবনে সৎ থাকা যায় না। অন্যায়ের বিরোধিতা করা যায় না। মানবতার স্বপক্ষে অবস্থান নেওয়া যায় না।
যাঁরা এ বিষয়ে জানতে আগ্রহী, তাঁদের জ্ঞানের পরিধি আরও বাড়াতে হবে। নৈতিকতার পাঠ আবার নতুন করে অধ্যয়ন করতে হবে। সত্যিকার অর্থেই তোমরা যাঁরা নৈতিকতার চর্চা করতে চাও তাঁদের ছোটোবেলার পাঠ্যবইতে পড়া খুব সহজ চারটি কথা আমি মনে রাখতে বলব : ১. সদা সত্য কথা বলব। ২. সৎ পথে চলব। ৩. মিথ্যা কথা বলব না। ৪. পরের ক্ষতি করব না।
এ চারটি শিক্ষা যদি মনে-প্রাণে গ্রহণ করতে পারো নিজেদের দৈনন্দিন জীবনে যদি এর প্রতিফলন ঘটাতে পারো তাহলেই সত্যিকার শিক্ষায় শিক্ষিত হওয়ার যাত্রায় অনেকটা এগিয়ে যাবে ইনশাআল্লাহ।