বাতাসির ভালোলাগার দুয়ারটা যখন খুলে যায়। আর তখনই ভালোবাসাগুলো যেন তাকে ঘিরে থাকে। আজ যেন তেমনই এক দুপুর। বেশ কয়েকটি দিন বিছানাতেই সেটে ছিল বাতাসি। জ্বর যেন কিছুতেই শরীর থেকে যাচ্ছিলো না। তিনবেলা বড়ি গিলে গিলে অনেকটাই দুর্বল হয়ে বিছানায় পড়ে আছে। শরীরে তাপ না থাকলেও মাথাটা যেন দুমনি বোঝা হয়ে আছে। আর শুয়ে আছে বলেই হয়তো তার সারাদিনের টইটই করে ঘুরে বেড়ানোর ছবিগুলো ওর মনের মাঝে ভাসে। চৌধুরী বাড়ির দেয়াল ঘেঁষে থাকা আম গাছটায় কাঁচা আমগুলো কী লোভনীয় হয়ে ঝুলে ছিল। সবেমাত্র আটি খানিকটা শক্ত হয়েছে। কাঞ্চি দিয়ে গুঁতো দিতেই বেশ কিছু কচি আম মাটিতে। বাতাসি এদিক ওদিক তাকিয়ে মুঠোয় করে সেই আম নিয়ে নিতুদের তাল পুকুরপাড়ে। ঘনগাছে ঘেরা পুকুরটার গাছের আড়ালে নিজেকে আড়াল করে। এই নির্জন দুপুরে এই দিকটায় এখন আর কেউ আসবে না। মনের সুখে সাথে আনা নুন দিয়ে সেই আম চিবুতে থাকে। আ-হা কী স্বাদ কী স্বাদ। এই স্বাদের কাছে মায়ের বকুনি, দাদির আদরমাখা কথাগুলো মনেই আসে না।
বাপ নেই সংসারে মা-ইতো সংসারটা ধরে রেখেছে গেরেস্থ বাড়িতে কাম করে। কোনো কোনো সকালেতো পান্তাভাতও জুটেনা। হাঁড়িতে থাকা পান্তাকটা দাদির মুখে তুলে দিয়ে, বাতাসি এবাড়ি ওবাড়ি ফরমাস খেটে কিছু খাবার জুটায়। আবার কেউ ভালোবেসে পাঁচ দশ টাকা দেয়। সেই পাঁচ দশ টাকা বাতাসি কিছুতেই খরচ করে না। এনে মা-কে দেয়। পরের বাড়ির পুরনো কাপড় আর জাকাতের দেওয়া শাড়িতেই মা আর দাদির বছর পার হয়। আর তাইতো চাহিদার লোভ বাতাসিকে কষ্ট দেয় না। দাদির কথাগুলোকেই জীবনের সত্য বলে মনে হয়।
দাদির যে কী অসুখ বাতাসি বুঝতেই পারে না। বুড়ো হলে মানুষ কী বিছানায় শুয়ে শুয়ে হাতের তসবিহ ঘুরায়। এইতো সেদিন এশার নামাজের পর ভাতের থালায় করে দাদির জন্যে ভাত নিয়ে এলো। ঘরের আধো আলোয় মুখে বিড়বিড় করে হাতের তসবিহ ঘুরিয়েই যাচ্ছে। হারিকেনের সলতেটা একটু বড়ো করে দিয়ে বিছানায় বসে বাতাসি। দাদির মাথায় হাত রাখতেই চোখ মেলে চায় সুফিয়া খাতুন।
দাদি তুমি কত ঘুমাও বলতো? এখন ওঠো।
মুখে আলগা হাসি দিয়ে ওঠে বসে সুফিয়া খাতুন।
বুবুরে তোরে কই। এই যে আমরা ঘুমাই এটাও কিন্তু ছোটো করে একটা মরণ। মানুষের আয়ু কখন শেষ হয় তা কেউই কইতে পারে না। আর তাইতো আমাদের সবসময় আল্লাহকে স্মরণ করা দরকার। আল্লাহর ফরজ মেনে চলা দরকার। কথা বলতে বলতেই বিছানায় ওঠে বসে সুফিয়া খাতুন। বাটিতে রাখা পানিতে হাত ধুয়ে ভাতের থালা টেনে নেয়। গরম ভাতের একপাশে কচুশাক আর মুরগির সালুন। খুশিতে চোখ চিকচিক করে বৃদ্ধার। মুরগির সালুন চোখে দেখে না কতদিন। তৃপ্তি নিয়ে খেতে খেতেই বলে নাতনিকে।
জানিস বুবু রিজিক আল্লাহর দেওয়া নেয়ামত। আল্লাহই জানেন কোথায় আমাদের কতটুকু রিজিক আছে। আর তাইতো আমাদের প্রত্যেকের মহান আল্লাহর হুকুম মেনে চলা দরকার।
দাদি ফরজ কী? পানির গ্লাসটা দাদির হতে তুলে দিতে দিতেই বাতাসি জানতে চায়।
ফরজ হলো আল্লাহর হুকুম মেনে চলা। যেমন আমাদের পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আর রমজানের রোজা রাখা। যাদের সামর্থ্য আছে তাদের হজ্ব, যাকাত ফরজ। বুবু তুমি আরও বড়ো হও। আমি তোমাকে আরও অনেক কিছু জানাবো।
সেই রাতেই বাতাসি মনে মনে ঠিক করে নেয়। বড়ো হলে কোনদিন নামাজ রোজা বাদ দেবে না।
শরীরে খানিকটা বল ফিরে পেতেই বাতাসির মন যেন আর ঘরে টিকেই না। জ্বরের কারণে বেশ কিছুদিন তো বিছানায় পড়ে রইলো। এখন কেবলই চোখে ভাসে রতনদের ভিটার পুকুর ঘেষে দাঁড়িয়ে থাকা তেঁতুল গাছ। পাকা তেঁতুলগুলোর দিকে তাকালেই জিভে পানি আসে। নিশানা দিয়ে ঢিল ছুড়লেই বাঁকা তেঁতুল অমনি মাটিতে। সবুজদের গাছের বড়ো বড়ো পেয়ারা। কতদিন খাওয়া হয় না। চৈতীকে সাথে নিয়ে সেই দিন যখন পেয়ারা খাচ্ছিলো খুব লুকিয়ে। আলপথে রহিম চাচাকে আসতে দেখেই বাতাসি আরও একটু কাছাকাছি হয় চৈতীর। মুখ দিয়ে কথাই সরছিল না। আর কথা-ইবা কইবে কী করে। মুখে যে লাল লংকার গুঁড়ো আর নুন দিয়ে কামড় বসিয়েছে পেয়ারায়। বেতফলের কথা-ই বা ভুলে কী করে। এই কয়েক দিনে ছোটো ছোটো বেতফল আরও বড়ো হয়েছে। ইস এতো কিছুর লোভ বাতাসি সামলায় কীভাবে।
বিকেল আসতে এখনো অনেক দেরি। মা যখন বাড়ি ফেরে, সূর্যিমামা তখন তার সোনারঙ বদলে লাল আবির মেখে আস্তে আস্তে ডুব দেয় পশ্চিম আকাশে। ততক্ষণে বাতাসি ঠিক ফিরে আসবে। দাদির ঘরে উঁকি দিয়ে দেখে। দাদি দুপুর ঘুমে অচেতন। বাতাসি চৌকাঠের বাইরে পা রেখে খুব আস্তে দুয়ার বন্ধ করে। এরপর আর পিছন ফিরে তাকাবার অবকাশই নেই। এক দৌড়ে তাল পুকুর পাড়। সেখানেই জটলা হয়ে বসে আছে চৈতী, ময়না, আমেনা। বাতাসিও বসে যোগ দেয় তাদের সাথে। আ-হা কত দিন পর প্রাণ ভরে নিঃশ্বাস নেওয়া। সেই বসাতেই ঠিক হয়ে যায়। পেয়ারা গাছে উঠবে চৈতী আর ময়না। বাতাসি আর আমেনা নিচে থাকবে। যেই ভাবা সেই কাজ। পেয়ারা পর্ব শেষ করেই রতনদের পুকুর পাড়ের তেঁতুল গাছের নিচে। খুশিতে সবাইর মন টকবক।
পেয়ারা খেতে খেতেই চৈতীকে প্রশ্ন করে বাতাসি।
আমার অসুখের সময় তোরা কেউ একজন দেখতে এলি না। বিছানায় শুয়ে শুয়ে তোদের কথা কতো মনে হয়েছে।
আমেনা বলে কী করে যাবো বল। মা-কে ঘরের কাজে সাহায্য করে দুপুর সময়টা গাছের শুকনো পাতা কুড়াতেই যাই। নইলে যে রান্নাটাই পড়ে থাকবে।
ময়না বলে ওঠে আমারও সময় হয়নি রে। ছোটো ভাইবোনের দেখাশোনা করে মা-কে এটা ওটা এগিয়ে দিতেই হয়। তবে মা-কে সাহায্য করার সময়ও তোর কথা কতো মনে হয়েছে।
এইসব হাজারো কথার মাঝে খুব জমে ওঠে ওদের আড্ডা। এক সময় চৈতী বলে ওঠে।
এই দেখ দেখ পাকা তেঁতুল কী সুন্দর ঝুলে আছে। নিশানা করে ঢিল ছোড়লেই মাটিতে পড়বে। বলার সাথে সাথে ওঠে দাঁড়ায় চৈতী। পড়ে থাকা একটা শুকনো ডাল নিয়ে নিশানা করে ছুড়তে যাবে। ওমনি হাত চেপে ধরে বাতাসি।
না চৈতী ঢিল ছুড়বিনা।
কেন? ঘুরে দাঁড়িয়ে চৈতী জানতে চায়।
এই গাছের তেঁতুলের ওপর আমাদের কোনো হক নেই। অন্যের জিনিস না বলে নিলে অন্যায়। আল্লাহ সবকিছু দেখেন। একদিন কেয়ামতের মাঠে আমাদেরই এর কৈফত দিতে হবে। চল আমরা না বুঝে এত দিন যে অন্যায় করেছি। তার থেকে আল্লাহর কাছে মাফ চাই। আল্লাহ ক্ষমাশীলদের প্রার্থনা কবুল করেন।
আমেনা, ময়না, চৈতী সবাই একসাথে বলে।
আমরা আর এই অন্যায় করবো না। আল্লাহ আমাদের মাফ করুক।