এ পৃথিবীতে মানুষের আয়ুষ্কাল খুবই সামান্য। এই সামান্য মুহূর্তকে যারা ভালোভাবে কাজে লাগায় তারাই কেবল শ্রেষ্ঠ মানুষ। তাই সময়ের মূল্য না বুঝলে কোনও কিছুতেই সফল হওয়া যায় না।
তুমি যদি একজন ভালো ছাত্র হতে চাও, তাহলে অবশ্যই তোমাকে সময়ের মূল্য দিতে হবে। চাকরিতে বা ব্যবসায়ে সফল হতে চাইলেও সময়ের মূল্য দেওয়ার বিকল্প নেই। সময়ের পড়া সময়ে করা, সময়ের কাজ সময়ে করা- ছাত্র বা কর্মজীবনে সফল হওয়ার সবচেয়ে বড়ো শর্ত। আজ পর্যন্ত পৃথিবীতে যত সফল মানুষ জন্মেছেন, তাঁরা সবাই সময়ের মূল্য দেওয়ার ব্যাপারে অন্যদের চেয়ে এগিয়ে ছিলেন। কোন কাজটি কোন সময়ে করবেন- তা তাঁরা আগেই ঠিক করে রাখেন, এবং সময়মতোই কাজ করেন। যার ফলে তারা সহজেই জীবনে সফলতা লাভ করতে পারেন। আর যারা হেলায় সময় অতিবাহিত করে তাদের জন্য অপেক্ষা করে দুঃখ। তাদের জীবনে নেমে আসে অন্ধকার। চলো সময়ের গুরুত্বের ব্যাপারে মনীষীরা যেসব মূল্যবান নসিহত করেছেন সেদিকে একটু নজর দেই।
ইবনুল কায়্যিম (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, ইমাম ইবনে তাইমিয়্যাহ (রাহিমাহুল্লাহ) আমার কাছে বর্ণনা করেন যে, “একবার আমি অসুস্থ হয়ে পড়লাম। চিকিৎসক আমাকে বললেন, আপনার এত অধিক অধ্যয়ন ও ইলমি আলোচনা আপনার ক্ষতির কারণ হবে, রোগ আরো বাড়িয়ে দেবে। কিছুদিনের জন্য এ থেকে বিরত ও বিশ্রামে থাকুন।’ আমি বললাম, ‘আমি এটা মানতে পারবো না। তবে আমি আপনার কাছে আপনার জ্ঞান অনুযায়ী ন্যায়বিচার দাবি করছি। বলুন তো, মানুষ যখন আনন্দিত ও উৎফুল্ল হয়, মন মেজাজ কি তখন ভালো হয়ে উঠে না? আর তা কি অসুস্থতা দূর করে দেয় না? সুস্থতা আনয়ন করে না?’ তিনি বললেন, ‘অবশ্যই’। তখন বললাম, ‘আমি আনন্দিত হই কিতাবের মুতাআ’লা দিয়ে, মন মেজাজ ভালো হয় ইলমের আলোচনা ও চর্চা দিয়ে। আমি তাতে প্রশান্তি ও স্বস্তি বোধ করি। তারপরও কি বলবেন…?’ তখন চিকিৎসক (নিরুপায় হয়ে) বললেন, ‘এটা আমাদের চিকিৎসাবিদ্যার বাইরের বিষয়।’
কবি সুইনবার্গ বলেন, ‘Life is a vision of a watch between a sleep and sleep. অর্থাৎ দুই প্রান্তেই ঘুম, ঘুমের মতো অন্ধকার, মাঝে একটু বেঁচে থাকাই হলো জীবন।
বাংলার লোককবিদের কণ্ঠেও উচ্চারিত হয়েছে এরকমই উক্তি, ‘এপার গঙ্গা ওপার গঙ্গা, মাঝখানে চর’ অর্থাৎ এপারে জন্ম ওপারে মৃত্যু মাঝখানে সীমাবদ্ধ জীবন। জীবনের এই সীমাবদ্ধতার জন্যই সময় এত বেশি মূল্যবান।
জনৈক ইংরেজি কবি বলেন, Time and tide wait for none. অর্থাৎ সময় এবং স্রোত কারো জন্যই অপেক্ষা করে না।’
ছোট সময়ে আমরা ভাবসম্প্রসারণে পড়েছিলাম– When money is lost nothing is lost, when health is lost something is lost, when time is lost everything is lost.
বিশ্বের বিখ্যাত ব্যক্তিদের দিকে তাকালে দেখা যায় তারা কেউই সময়ের মূল্য সম্পর্কে উদাসীন ছিলেন না। তাদের জীবনের প্রতিটি মুহূর্তই ছিল কর্মচঞ্চল ও কর্মবহুল। সময়ের মূল্য সম্পর্কে অবগত থাকাই হলো সময়ানুবর্তিতা। তাই প্রত্যেকের উচিত সময়ানুবর্তিতা মেনে জীবন পরিচালনা করা।
এদিকে বিদায় হজের ভাষণে হযরত মোহাম্মদ (সা.) বলেন,
‘হে মানুষ! প্রত্যেককেই শেষ বিচারের দিনে সকল কাজের হিসাব দিতে হবে। অতএব সাবধান হও।’
অর্থাৎ মানুষ কীভাবে তাদের জীবন পরিচালনা করেছে তার হিসাব দিতে হবে।
অপর দিকে পবিত্র বাইবেলে বলা হয়েছে যে, ‘আর একটু ঘুম, আর একটু তন্দ্রা, বিছানায় আর একটু গড়াগড়ি। এসব কিছু দরিদ্র ও অভাব দস্যুর মতো তোমার অন্তরে হানা দেবে।’ (হিতোপদেশ ২৪:৩৩ ও ৩৪)
ভগবত গীতায় বলা হয়েছে, ‘মানুষের অধিকার শুধু কর্মে। ফলে তার অধিকার নাই। কাজ কর। নিজেকে কর্মফলের ধারক মনে করো না। আবার নিজেকে নিষ্ক্রিয় হয়ে যেতে দিও না।’ (সংখ্যা যোগ-৩৭:৩৮)
তিরমিজি শরিফে বলা আছে শেষ বিচারের দিনে মানুষকে পাঁচটি বিষয়ের হিসাব দিতে হবে।
১. সময় কীভাবে ব্যয় করেছে?
২. মানসিক ও দৈহিক শক্তি কীভাবে ব্যয় করেছে?
৩. সম্পদ কীভাবে উপার্জন করেছে?
৪. কোন পথে সম্পদ ব্যয় করেছে?
৫. যা সত্য বলে জেনেছে, তা কতটুকু অনুসরণ করেছে।
হযরত মোহাম্মদ (সা.) বলেছেন পাঁচটি অবস্থানে জীবন অতীব মূল্যবান মনে কর।
১. বার্ধক্য আসার পূর্বে যৌবন কালকে।
২. রোগে আক্রান্ত হওয়ার পূর্বে সুস্থতাকে।
৩. দরিদ্রতা আসার পূর্বে সচ্ছলতাকে।
৪. ব্যস্ততার পূর্বে অবসরকে।
৫. মৃত্যুর পূর্বে জীবনকে।
এ থেকে বুঝা যায় জীবনের সবক্ষেত্রেই সময়ের মূল্য দিতে হবে। সময়ের কাজ সময়ে করা বা সময়কে মূল্য দেওয়া নিয়ে পবিত্র কুরআন ও হাদিস শরিফের বিভিন্ন স্থানে সতর্ক করা হয়েছে।
সূরা আসরে বলা হয়েছে, ‘সময়ের শপথ। নিশ্চয় মানুষ ক্ষতির মধ্যে নিমজ্জিত। তবে তারা নয়, যারা বিশ্বাস স্থাপন করে ও সৎকর্ম করে এবং পরস্পরকে সত্য ও ধৈর্য ধরার উপদেশ দেয়।’
বিশিষ্ট সুফি সাধক শামস তাবরেজি বলেন, অনেক দিন এ সূরার মর্মবাণী উপলব্ধি করার চেষ্টা করছিলাম। একদিন বাজারে শুনতে পেলাম একজনের চিৎকার। তিনি বলছেন, হে লোকসকল আমার মূলধন পানি হয়ে যাচ্ছে। সামনে গিয়ে দেখি তিনি একজন বরফ ব্যবসায়ী। অর্থাৎ তার বরফ দ্রুত গলে পানি হয়ে যাচ্ছে। এভাবে তার মূলধনও হারিয়ে যাচ্ছে।
পৃথিবীর বিখ্যাত, প্রতিষ্ঠিত, কালজয়ী মানুষদের দিকে তাকালে দেখা যায়, তারা কেউই সময়ের অপচয় করেননি।
যুক্তরাষ্ট্রের ১৬তম প্রেসিডেন্ট, যাকে গণতন্ত্রের প্রবক্তা বলা হয় সেই আবরাহাম লিংকন থেকে শুরু করে বিশ্ববিখ্যাত সবাই সময়ের ব্যাপারে সচেতন ছিলেন।
আমেরিকার অন্যতম প্রেসিডেন্ট বারাক হুসেইন ওবামা মাত্র ৪৪ বছর বয়সে যুক্তরাষ্ট্রের ৪৪তম প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন। তিনি মূলত আমেরিকায় এসেছিলেন অভিবাসী হয়ে। যিনি একাধারে অভিবাসী ও নিগ্রোও ছিলেন। আমেরিকানরা যাদেরকে অপছন্দ করেন তাদের সব বৈশিষ্ট্যই তার মধ্যে ছিল। কিন্তু ওবামা তার নিরলস পরিশ্রম ও সময়ের সদ্ব্যবহারের মাধ্যমে তার স্বপ্নকে বাস্তবায়ন করেন।