বিশ্ব সাহিত্য অঙ্গন জুড়ে আছে বড়োদের সাহিত্যের পাশাপাশি শিশু-কিশোর সাহিত্যের সম্ভার। নানা পুরস্কারে শিশুসাহিত্যের একটি ভাগও থাকে। আমাদের দেশের শিশু-কিশোর সাহিত্যের সাথে বিশ্ব অঙ্গনের শিশু-সাহিত্যের একটি বড়ো পার্থক্য হলো সেখানে বইটি কোন পাঠক বা কত বয়সী পাঠককে লক্ষ্য করে বের করা হয়েছে তা নির্ধারণ করা থাকে। প্রচারের সময় তার উল্লেখ থাকে, কভারে অনেক সময় উল্লেখ থাকে। বই বিক্রেতাও পাঠককে দেখে তুলে দেয় সেই বই। বড়োদের উপন্যাসে শিশু চরিত্রের উপস্থিতির কারণে ছোটরা গুরুত্ব পায়, সেই সুবাদে শিশুসাহিত্যও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। নোবেল পুরস্কারের প্রথম দিকে ১৯০৯ সালে সুইডেনের সেলমা লেগারলফের বই ‘দ্য ওয়ান্ডারফুল অ্যাডভেঞ্চার অফ নিলস’ নোবেল জেতার পর বিষয়টি আরো গুরুত্ব পায়। এটি একটি শিশুসাহিত্য। বিশ্বের সবচেয়ে বেশি বিক্রি হওয়া বই হ্যারি পটার সিরিজও শিশুসাহিত্যই। ১২ বছর বয়স্ক জাদুকর এই গল্পের নায়ক। কিন্তু বড়োরাও এর পাঠক। এই সিরিজ লিখে কোটিপতি হয়ে গেছেন ব্রিটিশ লেখিকা জে কে রাউলিং। আজকের পৃথিবীতে শরণার্থী হওয়া শিশু-কিশোররা সবচেয়ে দুঃখী। ফিলিস্তিনি, ইরাকি, সিরীয়, ইয়েমেনি, রোহিঙ্গা, কাশ্মিরি, হুতু, উইঘুর শিশুরা আছে এ তালিকায়। যেখানেই যুদ্ধ সেখানেই শিশুদের কষ্ট।
ফিলিস্তিনি শিশুদের কথাই ধরা যাক। তারা ৭০ বছরের বেশি সময় ধরে দুঃখ-কষ্টের শিকার। আরো কিছু কথা বলে নেই, তাহলে বুঝতে সুবিধা হবে। ফিলিস্তিনিদের উচ্ছেদ করে ১৯৪৮ সালে অবৈধ ইহুদি রাষ্ট্র ইসরাইল প্রতিষ্ঠিত হয়। তখন লাখ লাখ ফিলিস্তিনি উদ্বাস্তু হয়ে পড়ে। ফাতাহ আন্দোলনের নেতা ইয়াসির আরাফাতের নেতৃত্বে শুরু হয় প্রতিরোধ আন্দোলন। সবগুলো সংগঠন মিলে হয় পিএলও- ফিলিস্তিনি মুক্তি সংস্থা। আরাফাত এরও নেতৃত্ব দেন। ১৯৬৭ সালের যুদ্ধে ইসরাইল আরবদের আরো কিছু এলাকা দখল করে নেয়। এর মধ্যে অনেক রক্ত ঝরে। অসলো চুক্তির মাধ্যমে ১৯৯৩ সালে ফিলিস্তিনি জাতীয় কর্তৃপক্ষ প্রতিষ্ঠিত হয়। ২০১২ সালে এর নাম হয় স্টেট অফ প্যালেস্টাইন, তখন থেকে এটি জাতিসংঘের পর্যবেক্ষক সদস্য, পূর্ণাঙ্গ সদস্য নয়। তবে তারা ১৪২টি দেশের স্বীকৃতি পেয়েছে। দেশটি পূর্ব জেরুসালেমকে রাজধানী নির্ধারণ করেছে কিন্তু ইসরাইল ও তার দোসররা তা মানতে নারাজ। রামাল্লা শহর থেকে কাজ চলে এই কর্তৃপক্ষের। জেরুসালেম মুসলমান, ইহুদি ও খ্রিস্টান তিন জাতিরই পবিত্র স্থান। মুসলমানদের প্রথম কেবলা ছিল পূর্ব জেরুসালেমে অবস্থিত আল আকসা মসজিদ। যা এখন জেরুসালেম ইসলামিক ওয়াকফ কর্তৃপক্ষের নিয়ন্ত্রণে। তবে ইসরাইল এটা নিয়ন্ত্রণ করতে চায়, প্রায়শই আশপাশের রাস্তা বন্ধ করে দেয়। সম্প্রতি আমেরিকাসহ গুটিকয় দেশ তেল আবিবের স্থলে জেরুসালেমকে ইসরাইলের রাজধানীর স্বীকৃতি দিয়েছে, যা মেনে নেয়নি ফিলিস্তিনিরা এবং মুসলিম দেশগুলো। এই হলো ইসরাইল ও ফিলিস্তিনের ইতিহাস।
আবার আগের কথায় আসি। ফিলিস্তিনি সেই শিশুরা বড়ো হয়ে হয় সৈনিক হয়েছে বা বাঁচার জন্য কোনো একটা কাজ বেছে নিয়েছে। এখনকার শিশুরা আগের মতোই বোমা হামলা, বিমান হামলা ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলার শিকার হয়েছে। কয়েক মাস আগেও ইসরাইলি আগ্রাসনে আড়াইশো ফিলিস্তিনি শহীদ হয়, তার মধ্যে ৭০ জনের বেশিই শিশু। দেখা যাচ্ছে তাদের দুঃখের অবসান হচ্ছে না। সাহিত্যে উঠে এসেছে তাদের কষ্ট আর সংগ্রামের সেই বিবরণ। বহু বই লেখা হয়েছে তাদের নিয়ে।
২.
একটি বইয়ের কথা বলি। ‘এ লিটল পিস অফ গ্রাউন্ড’ (অ খরঃঃষব চরবপব ড়ভ এৎড়ঁহফ- বাংলায় ‘ছোট্ট এক টুকরো জমি’) হলো ব্রিটিশ লেখিকা ও মানবাধিকার কর্মী এলিজাবেথ লেয়ার্ড ও ফিলিস্তিনি লেখিকা ও শিক্ষাবিদ সোনিয়া নাম্রের লেখা একটি কিশোর উপন্যাস। একটি কিশোর এ উপন্যাসের নায়ক। ছেলেটি এবং তার পরিবার ফিলিস্তিনে দখলদারির ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে। ২০০৩ সালে প্রকাশনা সংস্থা ‘ম্যাকমিলান’ বইটি প্রথম প্রকাশ করে এবং ২০০৬ সালে ‘হেইমার্কেট বুকস’ এটি পুনর্মুদ্রণ করে। শ্রেণি বিন্যাসের ক্ষেত্রে এটিকে ‘মিডল গ্রেড ফিকশন’ বলা হয়েছে। ২০০৩ সালে এটি কার্নেগি পদকের জন্য মনোনীত হয় এবং ২০০৪ সালে হ্যাম্পশায়ার বুক পুরস্কার জিতে নেয়। বইটি আরবি ভাষায় অনুবাদ করা হয়েছে।
১২ বছর বয়সী করিম আবুদি এই উপন্যাসের প্রধান চরিত্র। উপন্যাসের ঘটনাস্থল ফিলিস্তিনের রামাল্লা শহর। বড়ো ভাই এবং দুই ছোটো বোনের সাথে রামাল্লায় করিম বড়ো হচ্ছে। সে ফুটবল খেলে, ভিডিও গেম খেলে, ভাইয়ের সাথে খুনসুটি করে এবং কারফিউ প্রত্যাহারের সময় স্কুলে যায়। এখন অবশ্য সে একদমই স্কুলে যেতে পারে না কারণ ভবনটি ইসরাইলি দখলদারদের দ্বারা ধ্বংস হয়ে গেছে। করিমের জীবনের প্রতিদিনের ছন্দ নির্ধারণ করা হয় কারফিউ দিয়ে, প্রায়ই তা জারি করে ইসরাইলিরা এবং তা কতক্ষণ চলবে তা অজানা। এসব নিয়ে করিম দিন কাটায় অশান্তির মাঝে। তারা এক সময়ে তাদের বাড়িটিতে দাগ দেওয়া দেখতে পায় আর কারা যেন সেখানে নিশান টাঙিয়ে রেখে গেছে, ফেলে রেখেছে ভাঙা কার ইত্যাদি। তাদের খেলার মাঠটিও দখলে চলে যায় অন্য কারো। এই ছোট্ট একখণ্ড জমিতে করিম ও তার খেলার সাথীরা এমন একটি জগৎ খুঁজে পেয়েছিল যা আর কোথাও পায়নি। করিম তার বন্ধু হপার এবং জনি দখলদারদের প্রতিরোধ করার উপায় খুঁজে বের করে, তাদের প্রচেষ্টা যতই নিরর্থক হোক না কেন। এরা বয়সে ছোটো হলেও এসব অত্যাচারের প্রতিরোধ করতে গিয়ে তারা বয়স্কদের মতো সবকিছু বুঝতে শেখে।
ছোট্ট কয়েক টুকরো জমির কথা আছে উপন্যাসে যা এর কাহিনির জন্য গুরুত্বপূর্ণ। একটি জমি হলো পাথুরে, আবর্জনায় ভরা জায়গা যেখানে করিম এবং তার বন্ধুরা খেলা করতো, যার কথা আগে বলেছি। তারা বন্ধুত্বের বন্ধনে আবদ্ধ ছিল। একটি পরিত্যক্ত গাড়িও ছিল তাদের খেলার স্থান। তারা রঙ দিয়ে তৈরি পতাকা দিয়ে তাদের জমি চিহ্নিত করে এবং সেখানে তারা একসাথে ফুটবল খেলে। এই ছোট্ট এক টুকরো জমি ইসরাইলিরা দখল করে নিতে চাইলে তাদের আর দুঃখের সীমা থাকে না। এই বইয়ে সব ফিলিস্তিনির দুঃখ দুর্দশার চিত্র আছে। শুধু মুসলমানই নয় খ্রিস্টানরাও আছে। যেমন হপার ও জনি চরিত্র। তারাও করিমের বয়সী কিশোর। উপন্যাসে ইসরাইলিরা অদৃশ্য; তবে বুঝতে অসুবিধা হয় না যে তারাই ফিলিস্তিনি শিশু-কিশোরসহ সকলের দুর্দশার কারণ। করিমের চাচা বলার চেষ্টা করেন তাদের জমি যারা দখল করছে সেই দখলদাররাও অন্য সবার মতোই মানুষ। কিন্তু করিম এটা মেনে নিতে পারে না। করিম এক সময় তার চাচাকে প্রশ্ন করে :
– মানুষ? আপনি এই সেটলারদের মানুষ বলছেন? জবাবে তিনি বলেন-
– হ্যাঁ। মানুষ। আমাদের মতো। আর এটাই খুব হতাশাজনক। তারা দেখিয়েছে মানুষের স্বভাব কত খারাপ হতে পারে। বিজয়ীরা যখন পরাজিতদের শাসন করে তখন এটি ঘটে।
করিম কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে, তারপর বলে, ‘আমরা খারাপ নই, তারাই। কত ফিলিস্তিনি শিশুকে তারা হত্যা করেছে। আমরা তাদের দিকে পাথর নিক্ষেপ করি তারা আমাদের লক্ষ্য করে গুলি করে, আমাদের হত্যার জন্য। করিম আরো বলে- “তাহলে, আমাদেরও তাদের ওপর বোমা ফেলার অধিকার আছে? যেসব স্কুলছাত্রী আজ মারা গেছে- তাদের কি মরার কথা? তাদের পরিবারের আজ রাতে কেমন লাগছে? যারা আহত হয়েছে তাদের কী হবে? পা এবং বাহু উড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, জীবন ক্ষত-বিক্ষত, সম্ভবত অন্ধও হয়ে যাবে?” এসব প্রশ্ন করিমের একার নয় সব ফিলিস্তনি শিশুর। করিম আবার বলে- “তারা (ইসরাইলিরা) আমাদের ঘৃণা করে। তারা আমাদের ধ্বংস করার চেষ্টা করছে। আমি তাদের ঘৃণা করি, তাদের সবাইকে। এভাবেই উপন্যাসে ক্রোধ প্রকাশ করে করিম। আর তা হয়ে ওঠে সব ফিলিস্তিনি কিশোরের কথা।”
এই বইতে এক টুকরো জমির কথা বলা হয়েছে, বাস্তবে বলতে চাওয়া হয়েছে অনেক কিছু। এটা এমন একটা কাহিনি যেখানে নির্যাতনের চিত্র আছে, অধিকারের কথা আছে, প্রতিরোধের কথা আছে। বলা চলে এটি একটি বৃহত্তর গল্পে বোনা একক অভিজ্ঞতার কাহিনি। করিমের বাবা গ্রামের কৃষক পরিবার থেকে উঠে আসা একজন সচ্ছল বণিক। অবৈধ বন্দোবস্ত কার্যক্রমের কারণে তার পরিবারে একটি দুঃস্বপ্ন নেমে আসে। আবুদি পরিবারের যা আছে তা ইসরাইলি অবৈধ দখলদারদের হয়ে যায়। অবৈধ বসতি স্থাপনকারী বা সেটলার ইহুদিরা তাদের বাড়ি দখল করে নেয়, করিমের খেলার মাঠ বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দেয়। করিমের পরিবার উদ্বাস্তু হয়ে পড়ে। এর পর তারা প্রতিরোধ সংগ্রামে লিপ্ত হয়। যা তাদের ইসরাইলি ট্যাঙ্ক এবং সৈন্যদের মুখোমুখি করে। এই বইটিকে ‘বিউটিফুলি রিটেন বাট এ ইনটেন্সলি পেইনফুল বুক’- অর্থাৎ চমৎকারভাবে লেখা একটি গভীর দুঃখের বই বলে বর্ণনা করা হয়েছে।