Home খেলার চমক টি-টোয়েন্টির জন্মকথা -আবু আবদুল্লাহ

টি-টোয়েন্টির জন্মকথা -আবু আবদুল্লাহ

ক্রিকেটের তিন ফরম্যাটের মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয়তা পেয়েছে টি-টোয়েন্টি। ২০ ওভারের এই ক্রিকেট চালু হওয়ার পর থেকেই বিশ^ব্যাপী শুরু হয়েছে জোয়ার। মজার ব্যাপার হলো, ক্রিকেটের এই সংস্করণটির ধারণা কোন ক্রিকেট বিশেষজ্ঞের মাথা থেকে আসেনি, এসেছে এক মার্কেটিং কর্মকর্তার কাছ থেকে। ওই কর্মকর্তার নাম স্টুয়ার্ট রবার্টসন। সে সময় তিনি ছিলেন ইসিবির মার্কেটিং ম্যানেজার। এবার সেই গল্পই জানাবো তোমাদের।

গত শতাব্দীর নব্বইয়ের দশকের শেষভাগের কথা। কাউন্টি ক্রিকেটে দর্শক না থাকায় স্পন্সর সঙ্কটে পড়ে ইংল্যান্ড অ্যান্ড ওয়েলস ক্রিকেট বোর্ড (ইসিবি)। মূলত দর্শকরা মাঠে না আসাতেই স্পন্সর কোম্পানিগুলো এগিয়ে আসছিল না। টুর্নামেন্টের খরচ জোগাতে ইসিবি তার মার্কেটিং বিভাগকে নির্দেশ দেয় সীমিত ওভারের ক্রিকেটে কীভাবে দর্শক টানা যায় তার উপায় বের করতে। কারণ দর্শকরা খেলা দেখলেই স্পন্সর প্রতিষ্ঠানগুলো সেখানে বিজ্ঞাপন দেবে।

২০০১ সালে ইসিবির মার্কেটিং বিভাগ একটি জরিপ পরিচালনা করে ক্রিকেটপ্রেমীদের মাঝে। জরিপের উদ্দেশ্য ছিল- দর্শকরা কেন মাঠে আসে না- তার কারণ খুঁজে বের করা। জরিপের পর দেখা গেল বেশির ভাগ দর্শক মাঠে আসে না সময়ের অভাবে। ছুটির দিন ছাড়া অন্যান্য দিনগুলোতে ৮-৯ ঘণ্টা সময় ব্যয় করে ওয়ানডে ম্যাচ মাঠে গিয়ে দেখা তাদের পক্ষে সম্ভব নয়।
স্টুয়ার্ট রবার্টসন এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘আমি জরিপের ব্যবস্থা করলাম। আমরা খুঁজতে শুরু করলাম কারা ক্রিকেট দেখতে আসে, তার চেয়েও বেশি খুঁজলাম কারা আসে না এবং কেন আসে না। দেখলাম হাতে টাকা থাকলেও মানুষ সময়ের অভাবে মাঠে আসছে না।’

জরিপের ফলাফল দেখে রবার্টসনের মাথায় চিন্তা আসে কীভাবে কম সময়ে ক্রিকেট ম্যাচ আয়োজন করা যায়। কাউন্টি ক্রিকেটের চেয়ারম্যানের কাছে তিনি ২০ ওভারের ম্যাচ আয়োজনের প্রস্তাব দেন। তার যুক্তি ছিল, অল্প সময়ে ম্যাচ শেষ করতে পারলে দর্শকরা মাঠে আসবে। প্রস্তাবটি ওঠে কাউন্টির ক্লাবগুলোর সভায়। ১১-৭ ভোটে সেটি পাস হয়। মজার ব্যাপার হচ্ছে, সে সময় কাউন্টির জনপ্রিয় দল মিডলসেক্স, সাসেক্স, ইয়র্কশায়ার, ওয়ারউইকশায়ার, সমারসেট, গ্লামারগন ও নরথান্টস ২০ ওভারের টুর্নামেন্টের বিপক্ষে ভোট দেয়। তবে সংখ্যাগরিষ্ঠের ভোট পাস হওয়ায় ইসিবি দ্রুত এই ফরম্যাটের টুর্নামেন্ট আয়োজনের পরামর্শ দেয়। এর নাম দেওয়া হয় টোয়েন্টি টোয়েন্টি, পরবর্তীতে যা হয়ে গেছে টি-টোয়েন্টি।

২০০৩ সালের ১৩ জুন দিনটি ছিল টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের আনুষ্ঠানিক সূচনার দিন। সেদিন বিভিন্ন স্টেডিয়ামে একযোগে কয়েকটি কাউন্টি ম্যাচ দিয়ে শুরু হয় টুর্নামেন্ট। ধীরে ধীরে দর্শকরাও আসতে শুরু করে মাঠে। এর ঠিক এক বছর পর ২০০৪ সালের ১৫ জুলাই লর্ডস স্টেডিয়ামে মিডলসেক্স ও সারের মধ্যকার ম্যাচ দেখতে উপস্থিত হয় ২৭ হাজার ৫০০ দর্শক। লর্ডসে সেটিই ছিল প্রথম টি-টোয়েন্টি ম্যাচ। ওই ম্যাচের পর ক্রিকেট কর্মকর্তারা বুঝতে পারেন, দর্শকরা নতুন ধারার এই ক্রিকেটকে লুফে নিয়েছে। কারণ এর আগের পঞ্চাশ বছরেও ইংল্যান্ডের ঘরোয়া ক্রিকেটের কোনো ম্যাচে এত দর্শক হয়নি। তারা এই টুর্নামেন্ট নিয়ে গুরুত্বের সাথে ভাবতে শুরু করে।

ইংল্যান্ডের সাফল্য দেখে অন্য দেশগুলোও আগ্রহী হয়। একই বছর পাকিস্তান একটি ঘরোয়া টি-টোয়েন্টি টুর্নামেন্ট আয়োজন করে। দর্শকপ্রিয়তা পায় সেই টুর্নামেন্ট। ২০০৫ সালে অস্ট্রেলিয়ায় শুরু হয় ২০ ওভারের টুর্নামেন্ট বিগ ব্যাশ। এসব দেখে আইসিসিও টি-টোয়েন্টি চালু করার উদ্যোগ নেয়। ওই বছর ১৭ ফেব্রুয়ারি প্রথম আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টি ম্যাচ মাঠে গড়ায়। অকল্যান্ডের ইডেন পার্কের সেই ম্যাচে মুখোমুখি হয় অস্ট্রেলিয়া ও স্বাগতিক নিউজিল্যান্ড। তবে সে ম্যাচটিকে উভয় দলই প্রীতিম্যাচ হিসেবে আমলে নিয়েছিল। উভয় দলের খেলোয়াড়দের জার্সি ছিল আশির দশকের মতো। সেদিন অস্ট্রেলীয় পেসার গ্লেন ম্যাকগ্রা একটি আন্ডার আর্ম বলও করেছিলেন। আবার এই কারণে আম্পায়ার বিলি বাউডেন পকেট থেকে লাল কার্ড বের করে দেখিয়েছিলেন ম্যাকগ্রাকে। ম্যাচে ৪৪ রানে জয়ী হয় অস্ট্রেলিয়া। অর্থাৎ শুরুতে টি-টোয়েন্টিকে মজা হিসেবেই নিয়েছিল অনেকে।

এরপর দ্রুত জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকে টি-টোয়েন্টির। দর্শকদের আগ্রহ দেখে স্পন্সর প্রতিষ্ঠানগুলো টাকার বস্তা নিয়ে হাজির হয় এই ক্রিকেটে। যার ফলে আইসিসিও এই ক্রিকেটকে গুরুত্বের সাথে নেয়। ২০০৭ সালে আয়োজন করা হয় প্রথম টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ। দক্ষিণ আফ্রিকার জোহানেসবার্গের নিউ ওয়ান্ডারার্স স্টেডিয়ামের শ্বাসরুদ্ধকর ফাইনালে শোয়েব মালিকের পাকিস্তানকে হারিয়ে শিরোপা জেতে মহেন্দ্র সিং ধোনির ভারত।

পাকিস্তান-ভারতের সেই জমজমাট ফাইনালের পর উপমহাদেশে হু হু করে বাড়তে থাকে টি-টোয়েন্টির জনপ্রিয়তা। বিশ^ ক্রিকেট পেয়ে যায় বিনোদনের নতুন উপলক্ষ্য। ২০০৭ সালের নভেম্বরে ভারতের জি এন্টারটেইনমেন্ট গ্রুপের আয়োজনে সাবেক অধিনায়ক কপিল দেবের নেতৃত্বে শুরু হয় ইন্ডিয়ান ক্রিকেট লিগ বা আইসিএল। তবে সেই টুর্নামেন্ট ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ড ও আইসিসির অনুমোদন পায়নি। যে কারণে দুটি আসরের পর সেটি বন্ধ হয়ে যায়। বিদ্রোহী লিগ নামে পরিচিত সেই টুর্নামেন্টে বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের একটি দলও অংশ নিয়েছিলো হাবিবুল বাশারের নেতৃত্বে। বিসিবির অনুমতি ছাড়া সেই টুর্নামেন্টে অংশ নেওয়ায় বেশ কয়েকজন ক্রিকেটারকে বিভিন্ন মেয়াদে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছিল।

২০০৮ সালে ভারতে শুরু হয় প্রথম ফ্রাঞ্চাইজি-ভিত্তিক ক্রিকেট টুর্নামেন্ট ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগ (আইপিএল)। কোটি কোটি ডলার নিয়ে শুরু হওয়া এই টুর্নামেন্টে খেলতে আসেন বিশে^র সব বড়ো তারকারা। অন্যান্য দেশও আয়োজন করে ঘরোয়া ফ্রাঞ্চাইজি টুর্নামেন্ট। বাংলাদেশে শুরু হয় বিপিএল। সারা বিশ্বেই জোয়ার শুরু হয় টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের।

এই ক্রিকেটের জনপ্রিয়তা নিয়ে রবার্টসন বলেন, ‘সে সময় আমি কল্পনাও করতে পারিনি যে কী ঘটতে চলেছে। সেই পদক্ষেপ ছিল শুধু কাউন্টি ক্রিকেটে দর্শক টানার একটি পদ্ধতি। মানুষ যখন টি-টোয়েন্টির ইতিহাস নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে আমার নাম উচ্চারণ করে সেটি আমাকে গর্বিত করে।’
তিনি বলেন, ‘অনেকেই আমার বিরোধিতা করেছে, আবার অনেকের সহায়তাও পেয়েছি। ১১-৭ ভোটে এটি পাস হয়েছে। কাউন্টির চেয়ারম্যান নিজে এই ক্রিকেটের বিরোধিতা করেছিলেন।’
কাউন্টি চ্যাম্পিয়নশিপের বোর্ড মিটিংয়ের সেই ভোটাভুটিতে আর মাত্র দুটি দল যদি প্রস্তাবটির বিপক্ষে ভোট দিত তাহলে হয়তো পেশাদার ক্রিকেটে আসতোই না টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট।

SHARE

Leave a Reply