মন্টু মামা কখন যে কী করেন তার ঠিক নেই। তামাম দুনিয়ার লোকজনের সঙ্গে তার চেনাজানা। গলায় গলায় খাতির। লোকগুলোও নানা কিসিমের। তারা দিব্যি বাড়িতে এসে আসন গাড়েন। মামার মাথা ভেঙে খানদান। ঘুরে বেড়ান। আবার সময় হলেই ফুটুস। সাধুর মেলা থেকে এবার যাকে পাকড়াও করলেন তার বাতচিত আলাদা। লোকটার চুল-দাড়ির দড়াচূড়া, নানাবর্ণ তাবিজ কবজের মালা, আঙুলে গুচ্ছের আংটি, হাতে বাঁকানো লাঠি, বুকে তালাবাঁধা শিকলি, পরনের লালসালু- সবমিলিয়ে গুহাবাসী কোনো এক মহাসাধুর আগমন ঘটেছে যেন! মামা তার সেবায় যারপরনাই ব্যতিব্যস্ত। সাধু তেলেঝালে খানা খিঁচিয়ে কাত হয়ে পড়ে থাকেন চোখ মুদে। ধ্যানের মহাস্তর থেকে তিনি যখন আলফা লেভেলে নেমে আসেন, তখন পুরু শরের দুধ, খাঁটি গাওয়া ঘি, সবরিকলা, কচি ছাগলের গোশত, মাগুর মাছের দোপেঁয়াজি আর চিতলের পেটির আস্বাদ নিয়ে মুখোরোচক গল্পে অবতীর্ণ হন। মামা যে সাধুর খেদমতে এইসব জরুরি উপাদান যথাযথ নিবেদনে ব্যর্থ, তা নিয়ে আক্ষেপের দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন ঘনঘন। মামা তার ব্যর্থতার জন্য সবসময় কাচুমাচু থাকেন। আমাদের জিভখানা বিপুল লালায় ভাসিয়ে তিনি করজোড়ে দুটোর বদলে পাঁচখানা বিশাল সাইজের রাজভোগ তুলে দেন সাধুর পাতে। বাগেরহাটের ননীগোপালের খাঁটি চিনিপাতা দইয়ের সঙ্গে দুটো পুরুষ্টু সবরিকলা খেয়ে কষ্টের ঢেকুর তোলেন সাধু। কলার সাইজটা আরো একটু হিম্মতি না হওয়ায় তিনি ভক্তের ওপর কিঞ্চিৎ রুষ্ট। মামা হতাশায় নিমজ্জিত হলে গলায় ঝোলানো লোহার খুঁচুনি দিয়ে দাঁতের গোপন গর্ত থেকে বেয়াদব মাংসের টুকরাটা বের করতে তৎপর হন। নানা রকম এই আয়োজন যথারীতি গেরিলাযুদ্ধের রূপ নেয়। আলসে বলদ যেমন কিষানের পাচনের শত গুঁতো খেয়েও সহজে গা তোলে না, এও তেমনি। গুঁতোগুঁতির আপ্রাণ চেষ্টায় যে সামান্য ভঙ্গুর উপাদান নাগালে মেলে, তা নাকে শুঁকে টুসকি মেরে ছুঁড়ে দেন যত দূরে যায়। বিপদ তাড়ানোর পর তবক দেওয়া পান খেতে খেতে মুখখানা সরু করে দেদার পিকের আলপনা আঁকেন খাটালে। এবার একটু ঝুঁকে ফিসফিস করে বরাবরের মতো গোপন মন্ত্র জোগান মামার কানে- যা বলছি, জোগাড় করছস? সোনারূপার বাকশো সহজে মিলবে নারে পাগলা। দরগায় বড়ো মানত দেওন লাগবে। বস্তা বস্তা চাউল, ডাউল, আলু, তেল-মসলা, হাঁড়িকুড়ি, টাকা-পয়সা, সোনাদানা, যা আছে সব বন্দোবস্ত করে নৌকায় তোল। রাতে রওনা দিয়া ভোরভোর পৌঁছান লাগবে। দিঘির তলের গুপ্তধন থাইকা সোনা-রুপার বাকশো গড়ায় গড়ায় নৌকায় উঠবে। এবার যা করবি কর। আর বলুম না। বেশি কওনে আমল নষ্ট অয়ে যায়।’ সাধুবাবার আমল রক্ষার্থে অবশেষে মাঝারি ধরনের একখানা গয়না নৌকায় লিস্টি ধরে ধরে তোলা হলো রাজ্যির সদাই। কিছু বাকি থাকলো না। সাধু গোঁফে তেল মাখতে মাখতে নিজেই তদারকি করলেন সবকিছু। শিষ্য বড়ই দুর্বল। তার ওপর আস্থা রাখা যায় না। সাধুর বাজচক্ষুর নিশানায় মামার আটচালা ঘরখানা নিমিষে ফাঁকা হয়ে গেল। একেবারে শেষ মুহূর্তে মামী সন্তান আর সোনার গয়নার মোহে গদগদ হয়ে দাদী শাশুড়ির দেওয়া বাজুখানা অতিরিক্ত লুকিয়ে এনে তুলে দিলেন সাধুর হাতে। তিনি গভীর চোখে সেটা পরখ করে শিষ্যর মাথায় হাত রেখে আকাশমুখো হলেন একটু। ভাগ্যিস ওপর থেকে কিছু পতন ঘটলো না। যা ঘটার নিচেই ঘটবে। ভোররাতে দরগার ঘাটে নৌকা ভিড়লো। মামা-মামীকে চোখ বন্ধ করে উপুড় শুইয়ে সাধু নানা রকম পরামর্শ দিলেন ভয়ঙ্কর মাস্টারি গলায়। কোনোরকম আওয়াজেই যেন চোখ না খোলা হয়। খুললেই কানা হয়ে যাবে। সাধু মাঝিকে সরিয়ে দিয়ে উঠে গেলেন কূলে। সময় বয়ে যায়। কোনো সাড়া নেই। একসময় শুরু হলো ঠুন ঠুন আওয়াজ। চলছে তো চলছেই। মামী কনুই দিয়ে গুঁতো মারলেন মামাকে-‘এই, চোখ খুলে দেখুম নাকি একটু?’ মামা সতর্ক বিবেচক- খবরদার, চোখ খুলিস না। কানা হয়ে যাবি। ওনারা গড়ায় গড়ায় নৌকায় উঠতেছেন। দাঁত মুখ খিঁচিয়ে থাক আর একটু।’ একসময় ঠুনঠুন আওয়াজ বন্ধ হয়। বেলা চড়ে। লোকজনের সাড়া মেলে কিনারা থেকে। মাঝির উদ্বিগ্ন গলা শোনা যাচ্ছে। কিন্তু সাধু কই? মামী উত্তেজনায় কাই হয়ে আছেন। আর তর সইছে না। নৌকার এ মাথা থেকে ও মাথা মাছ হাতড়ানোর মতো সোনাদানা খুঁজতে খুঁজতে হঠাৎ এমন মরণ চিৎকার দিলেন যে বজ্র পড়ল বুঝি নৌকায়! মামা এই প্রথম গুরুর আদেশ লঙ্ঘন করে পূর্ণ চোখ খুলে তাকালেন। মালামাল শূন্য খালি নৌকায় সোনা-রুপার কোনো আলামত না দেখে বুক চাপড়ে এতো জোরে বিকট আর্তনাদ করে উঠলেন যা শুনে দরগাহ দিঘির প্রবীণ দুই কুমির ধলা আর কালাপাহাড়ের গাল বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়লো।