জীবনে সাফল্য অর্জনের সবচেয়ে বড়ো শক্তি জ্ঞান। জ্ঞান এমন একটি ধারালো অস্ত্র, যা দিয়ে চিন্তা জগতে জয়-পরাজয় নির্ধারিত হয়। পৃথিবীতে স্ব-মহিমায় টিকে থাকা এবং না থাকা পুরোটাই জ্ঞানের ওপর নির্ভর করছে। যার জ্ঞানের পরিধি যত বেশি সে তত শক্তিশালী এবং সে মারা যাওয়ার পরও তার আবেদন ফুরিয়ে যায় না। তাঁর সৃষ্টিশীল কর্মের মাধ্যমে মানুষের হৃদয়ে অনন্তকাল বেঁচে থাকেন। জ্ঞান মানুষের অন্তর্চক্ষু এবং অনুভবের দরোজা খুলে দেয়। খালি চোখে মানুষ যা দেখে, অন্তর্চক্ষু দিয়ে মানুষ তারচেয়েও বেশি দেখতে পায়। বর্তমান পৃথিবীতে মানুষ যে উন্নত ও উৎকৃষ্ট উপকরণ নিয়ে বসবাস করছে, তা জ্ঞান সাধনারই ফল। অসংখ্য আবিষ্কার-উদ্ভাবনের মাধ্যমে মানুষ পৃথিবীকে করতলগত করেছে। চাঁদ ও মঙ্গলগ্রহে পৌঁছার পেছনে আছে জ্ঞানের শক্তি।
মানুষের অর্থবিত্ত ও জনবল শক্তি হিসেবে বিবেচিত হয়ে থাকে কিন্তু জ্ঞানের সাথে তার তুলনা হতে পারে না। মানুষের ধনসম্পদ সবই একদিন ফুরিয়ে যেতে পারে কিন্তু জ্ঞানের বিনাশ নেই। একমাত্র মানুষ, আল্লাহ প্রদত্ত জ্ঞানের অধিকারী হয়েছে বলেই সে আশরাফুল মাখলুকাত তথা সৃষ্টির সেরা জীব। জ্ঞান মানুষের জীবনকে সর্বতো সুন্দর, সুখকর ও পরিচ্ছন্ন করে তোলে। তাই জ্ঞান শুধু শক্তিই নয়, শ্রেষ্ঠ শক্তি। এ প্রসঙ্গে মহামতি সক্রেটিস বলেছেন-
Knowledge is power by which things are done.
গ্রিক দার্শনিক এরিস্টটল শিক্ষার একটি উৎকৃষ্ট সংজ্ঞা দিয়েছেন,
Education is the creation of sound mind in a sound body.
উপনিষদে বলা হয়েছে- ‘শিক্ষা হলো এমন একটি প্রক্রিয়া যার চূড়ান্ত অর্থ মানুষের মুক্তি।’
পাশ্চাত্যের দার্শনিকগণ শিক্ষার তাত্ত্বিক মর্মার্থ বুঝিয়েছেন এভাবে- ‘মানব সমাজের জন্য কল্যাণকর, নৈতিক ও নান্দনিক জীবনের বিকাশই শিক্ষা।’
শিক্ষা সম্পর্কে প্যারাডাইস লস্টের কবি জন মিল্টনের উদ্ধৃতি না দেওয়ার লোভ সামলাতে পারছি না, তিনি বলেছেন- Education is the harmonious development of body mind. অর্থাৎ শিক্ষা হলো শরীর, মন এবং আত্মার সমন্বিত বিকাশ।
শিক্ষা সম্পর্কে সবচেয়ে চমৎকার কথা বলেছেন আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)। তিনি জ্ঞানার্জন সম্পর্কে বলেছেন- ‘প্রত্যেক মুসলিম নর-নারীর ওপর জ্ঞানার্জন করা ফরজ।’ শিক্ষার দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গি বুঝিয়েছেন এভাবে- ‘তোমরা দোলনা থেকে কবর পর্যন্ত জ্ঞানার্জন করো।’
মহানবী (সা.)-এর শিক্ষার এই মহাদর্শন গোটা বিশ্বে প্লাবনের মতো ছড়িয়ে পড়েছিল। পরবর্তী সময়ে মহান পুরুষদের জীবনে আমরা সে চিত্রই দেখতে পাই। এই পৃথিবীতে যারাই মহান মানুষ হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছেন তারা প্রচুর অধ্যয়ন করেছেন। যিনি দরিদ্রতার কারণে ঘড়ি বিক্রি করে দিনে আধা পেট খেয়ে সারাদিন লাইব্রেরিতে পড়ে থাকতেন আর পৃথিবীকে পরিমাপ করতেন, তিনিই পরবর্তীকালে রূপকথাকে হার মানিয়ে জগদ্বিখ্যাত বিজ্ঞানী গ্যালিলিও হয়েছিলেন। যিনি ল্যাবরেটরিতে নিরবচ্ছিন্ন গবেষণার জন্য জীবনে পাঁচটি বিয়ের আসর ভেঙে গিয়েছিল তিনিই হয়েছিলেন হাইড্রোফোবিয়া তথা জলাতঙ্ক রোগের আবিষ্কর্তা লুই পাস্তুর। হেলেন কিলার ছিলেন সম্পূর্ণ অন্ধ; অথচ শুধু ইচ্ছেশক্তির জোরে চক্ষুষ্মান অনেক লোকের চেয়েও অধিক সংখ্যক বই পড়েছেন এবং তিনি লিখেন ত্রিশেরও অধিক বই।
এবার তোমাদেরকে ভিন দেশের একটা মজার গল্প শোনাই। আজ থেকে প্রায় আড়াই হাজার বছর আগের কথা। খ্রিষ্টপূর্ব ৪৬৯ সাল। গ্রিসের ছোট্ট শহর এথেন্স। লোকসংখ্যা মাত্র সাড়ে তিন লাখ। চারদিক কাঁপিয়ে আকাশ থেকে এক দৈববাণী ভেসে এলো; মহামতি সক্রেটিস এর জন্ম হয়েছে। পিতা সফরেনিকাশ ছিলেন খুদে স্থপতি। পাথরের নানা মূর্তি গড়তেন। মা ফেনআরেট ছিলেন ধাত্রী।
পিতা-মাতা দু’জনেই ভিন্ন পেশায় নিযুক্ত থাকলেও অভাব অনটন সবসময় সংসারে লেগেই থাকতো। তাই ছেলেবেলায় পড়াশোনার পরিবর্তে পাথর কাটার কাজ নিতে হলো সক্রেটিসকে। তিনি জ্ঞানের প্রতি এতটাই কমিটেড ছিলেন যে, যখন যেখানে যতটুকু জানার সুযোগ পেতেন সেইটুকুই সঞ্চয় করে নিতেন নিজের জ্ঞানভান্ডারে।
অর্থাভাবে চাকরি নিতে হলো সেনাবাহিনীতে। যুদ্ধে অসামান্য সাহসিকতার পরিচয় দিলেন। স্বীকৃতিও পেয়ে গেলেন। তবে যুদ্ধের প্রতি তার মন ক্রমশই বিরূপ হয়ে উঠল। চিরদিনের জন্য সৈনিক পদ ছেড়ে দিয়ে ফিরে এলেন এথেন্সে। এথেন্স তখন জ্ঞান-বিজ্ঞান, ব্যবসা-বাণিজ্যে, শৌর্যে-বীর্যে পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ দেশ। শিক্ষা সাহিত্য ও সংস্কৃতির এক স্বর্ণযুগ। এই জ্ঞানরাজ্যের পরিবেশে অবস্থান করে সক্রেটিস নিজেকে জ্ঞানের জগৎ থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে পারলেন না। স্থির সিদ্ধান্ত নিলেন, জ্ঞানচর্চা ও বিশ্বপ্রকৃতি জানার সাধনায় নিজেকে উৎসর্গ করবেন।
প্রতিদিন ভোরবেলায় ঘুম থেকে উঠে সামান্য প্রাতরাশ সেরে বেরিয়ে পড়তেন। খালি পা আর গায়ে জড়ানো থাকতো মোটা একটা কাপড়। মাঝে মধ্যে গিয়ে বসতেন নগরীর কোনো দোকানে, মন্দিরের চাতালে কিংবা বন্ধুর বাড়িতে। নগরের যেখানেই লোকজনের ভিড় সেখানেই খুঁজে পাওয়া যেত সক্রেটিসকে। দেখা যেত প্রাণ খুলে গল্প করছেন, কথা বলছেন বিভিন্নজনের সাথে। জমজমাট আড্ডা দিচ্ছেন, মাঝে মধ্যে খুব গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন করছেন। ভাবটা এমন দেখাতেন, যেন তিনি কিছুই জানেন না; বোঝেনও না, শুধু নিজে জানার জন্যই লোকজনকে প্রশ্ন করছেন। আসলে প্রশ্ন করা, বিতর্ক করা ছিল সে যুগের এক শ্রেণির লোকদের ব্যবসা। এদের বলা হতো ‘সোফিস্ট’।
যারা নিজেদের মধ্যে পাণ্ডিত্যের অহঙ্কার করত, বীরত্বের বড়াই করত, তাদেরকে তিনি সরাসরি জিজ্ঞেস করতেন, বীরত্ব বলতে তারা কী বোঝে? পাণ্ডিত্যের স্বরূপ কী? তারা যখন কিছু একটা উত্তর দিত, তিনি আবারও প্রশ্ন করতেন। প্রশ্নের পর প্রশ্ন সাজিয়ে অবশেষে সঠিক উত্তর দিয়ে বুঝিয়ে দিতেন তাদের ধারণা কত ভ্রান্ত। সক্রেটিস এর আর্থিক দৈন্যদশা দেখে একবার তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধু অ্যালসিবিয়াদিশ তাঁকে ভালো একটা বাসস্থান তৈরি করবার জন্য বিরাট এক খণ্ড জমি দিতে চাইলেন। সক্রেটিস বন্ধুর দান সকৌতুকে ফিরিয়ে দিয়ে বললেন- ‘আমার একটা জুতা সেই কবে ছিঁড়ে গেছে, অর্থাভাবে আর সেলাই করতে পারিনি। এখন আমার প্রয়োজন মাত্র একটি জুতা, আর তুমি দিচ্ছো বিরাট একটি চামড়া, এ নিয়ে আমি কী করব জানি না।’
পার্থিব সম্পদের প্রতি সক্রেটিস এর ছিল নিঃস্পৃহতা। জ্ঞান অর্জন এবং বিতরণই ছিল তাঁর সারাজীবনের একমাত্র ধ্যানজ্ঞান। একবার একটা মজার কাণ্ড ঘটেছিল তাঁর দাম্পত্য জীবনে। সেটা কী, জানো? তাঁর স্ত্রী জ্যানথিপি (ঢধহঃযরঢ়যব) ছিলেন ভয়ঙ্কর রাগী মহিলা। সাংসারিক ব্যাপারে সক্রেটিস এর উদাসীনতা মেনে নিতে পারতেন না। একদিন সক্রেটিস গভীর মনোযোগের সাথে একটা বই পড়ছিলেন। প্রচণ্ড বিরক্তিতে জ্যানথিপি গালিগালাজ শুরু করে দিলেন। প্রথম দিকে সক্রেটিস স্ত্রীর বাক্যবাণে র্কুপাত করলেন না। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আর ধৈর্য রক্ষা করতে না পেরে বাইরে এসে আবার পড়তে আরম্ভ করলেন। জ্যানথিপি আর সহ্য করতে না পেরে এক বালতি পানি এনে তাঁর মাথায় ঢেলে দিলেন। সক্রেটিস মৃদু হেসে বললেন- ‘আমি আগেই জানতাম, মেঘ যখন গর্জন করছে শেষ পর্যন্ত এক পশলা বৃষ্টি হবেই।’
তিনি বিশ্বাস করতেন শিক্ষাই মানুষের শ্রেষ্ঠ সম্পদ। শিক্ষার মাধ্যমেই মানুষের অন্তরজ্যোতি উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। জ্ঞানের মধ্য দিয়েই মানুষ একমাত্র সত্যকে চিনতে পারে। যখন সে সত্যকে সত্য বলে জানে, তখন সে আর পাপ করে না, অন্যের ক্ষতি সাধনের চেষ্টা করে না। মনে রাখবে, অজ্ঞতা থেকে পাপের জন্ম। আর অজ্ঞতা হচ্ছে কারাবাসের সমতুল্য।
সক্রেটিসের শিক্ষাকেন্দ্রিক আদর্শকে অনেকে সুনজরে দেখেনি। সক্রেটিসের বয়স যখন সত্তর, তখন অন্যায়ভাবে তাঁর বিরুদ্ধে দু’টি অভিযোগ তোলা হলো।
এক. প্রচলিত দেবতার অস্তিত্ব অস্বীকার করে তিনি নতুন দেবতার প্রবর্তন করতে চাইছেন।
দুই. তিনি যুবকদের নৈতিক চরিত্র কলুষিত করে তাদেরকে বিপথগামী করছেন।
বিচারক আলোচনের সভাপতিত্বে ৫০১ জনের জুরি বোর্ড গঠিত হলো। ষাট ভোটের ব্যবধানে হেরে অপরাধী সাব্যস্ত হয়েছিলেন সক্রেটিস। সে এক আজব বিচারকার্য। বিচারকদের প্রতি ক্ষুব্ধ হয়ে বিচারকমণ্ডলীর সামনে সক্রেটিস এক দীর্ঘ বক্তৃতা দিলেন। তাঁর বিরোধী পক্ষ কী বলেছিল তা জানা যায়নি। তবে সক্রেটিস এর জবানবন্দী লিখে গিয়েছিলেন তাঁর শিষ্য প্লেটো। মূল গ্রিকভাষায় লেখা প্লেটোর ‘The Last Days of Socrates’ নামক গ্রন্থটির ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন Hugh Tredennick এবং বইটি প্রকাশ করেছে Penguin Classicks Publications.
বইয়ের প্রচ্ছদটি সবাইকে বিস্মিত, শ্রদ্ধান্বিত ও সম্মোহিত করে। তিনিই প্রথম শিক্ষাবিদ ও দার্শনিক, যিনি শিক্ষা আন্দোলন করতে গিয়ে মৃত্যুদণ্ডাদেশ পেয়েছিলেন। হাতে তাঁর হেমলকের পেয়ালা। নিজ হাতে হেমলক (এক ধরনের বিষ) পান করে তাঁকে মৃত্যুবরণ করতে হবে। মৃত্যুদণ্ডাদেশ পাওয়ার পরে তাঁর এক বন্ধু বিচারকের কাছে তাঁকে ক্ষমা চাওয়ার জন্য অনুরোধ জানিয়েছিলেন কিন্তু তিনি ক্ষমা চাননি। এমনকি তাঁর ছেলে তাঁকে পলায়ন করতে বললে তাতেও তিনি রাজি হননি। বিচারকদের উদ্দেশে তিনি ছুঁড়ে দেন তাঁর সেই বিখ্যাত ডায়ালগ:
‘I to die and you to live, which is the better only God knows. (Socrates Quoted in: Plato’s Apology). অর্থাৎ আমি চাই মরতে আর তোমরা চাও আমাকে বাঁচাতে, এই দুয়ের মধ্যে কোনটি উত্তম ঈশ্বরই ভালো জানেন।
তোমরা একটু খেয়াল করলে দেখবে আমাদের দেশেও সক্রেটিসদের মতো ভাগ্যবরণ করতে হয়েছে এমন কিছু মনীষীর যারা মরেও আজ কোটি মানুষের হৃদয়ে বেঁচে আছেন, বেঁচে থাকবেন অনন্তকাল। পৃথিবীর ইতিহাস বলে সক্রেটিসের সেই হত্যাকারীরা বিস্মৃতির অতলান্ত সাগরে হারিয়ে গেছে চিরতরে। তিনিও চলে গেছেন নশ্বর পৃথিবী ছেড়ে অসীম যাত্রায়। কিন্তু তাঁর আদর্শ দেদীপ্যমান হয়ে জ্বলছে দ্বিপ্রহরের সূর্যের মতো। তাঁর শিষ্য দার্শনিক প্লেটো, প্লেটোর শিষ্য এরিস্টটল, এরিস্টটলের শিষ্য সম্রাট আলেকজান্ডারের মধ্য দিয়ে সেই চিন্তার এক নতুন জগৎ তৈরি হয়। যে জগৎ আজকের পৃথিবীর মানুষকে জ্ঞানার্জনে উৎসাহিত করছে।