পাকিস্তানের বোলিং আক্রমণের সোনালি সময় বলা হয় নব্বই দশককে। বছরের পর বছর ধরে ক্রিকেট বিশ্বে চলা ক্যারিবীয় পেসারদের দাপটে ওই সময়টায় এসে ভাগ বসায় পাকিস্তান। আর এই বোলিংয়ের সেরা দুই অস্ত্র ছিলেন ওয়াসিম আকরাম ও ওয়াকার ইউনুস। ইমরান খানের উত্তরসূরি হিসেবে যারা পাকিস্তানের বোলিং আক্রমণকে ব্যাটসম্যানদের জন্য করে তুলেছিলেন ভয়ঙ্কর। এই দুই সেনানীর একজন ওয়াকার ইউনুসের ক্যারিয়ারের নানা দিক জানাবো এই লেখায়।
ওয়াসিম-ওয়াকার জুটি ছিল ক্রিকেট ইতিহাসের সবচেয়ে সফল বোলিং জুটি। অনেকে উপমা দিতে গিয়ে বলেন, তারা এক সাথে ক্রিকেট মাঠে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিলেন। দু’জনের বোলিংয়ের প্রধান অস্ত্র ছিল রিভার্স সুইং। অর্থাৎ প্রথাগত সুইংয়ের উল্টো দিকে বাতাসে বলকে ঘোরানো। পুরনো বলে এই রিভার্স সুইংয়ে অনেক দক্ষ ছিলেন ওয়াকার ইউনুস। বিশেষ করে ইনিংসের শেষ দিকে তাকে মোকাবেলা করা ব্যাটসম্যানদের জন্য ছিল রীতিমতো দুঃস্বপ্ন। সেই সাথে ছিল প্রচণ্ড গতি আর ইয়র্কার ডেলিভারি। লেগস্ট্যাম্পের ওপর তার ইয়র্কারে বহু ব্যাটসম্যানের পায়ের আঙুল ভেঙেছে। অনেকে বলেন, ওয়াকার ইউনুসের কারণেই ব্যাটসম্যানদের জন্য টো গার্ডের প্রচলন হয়েছে।
পুরনো বলে ওয়াকার ইউনুস কতটা ভয়ঙ্কর ছিলেন তার দু’একটি উদাহরণ দেই : ১৯৯৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে ডারবানে ত্রিদেশীয় সিরিজের প্রথম ম্যাচে আগে ব্যাট করে স্বাগতিক দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ২০৮ রান তোলে পাকিস্তান। এই রান তাড়া করতে নেমে এক পর্যায়ে দক্ষিণ আফ্রিকার সংগ্রহ ছিল ১ উইকেটে ১৫৯ রান। সেখান থেকে ওপেনার এন্ড্রু হাডসনকে (৯৩) বোল্ড করে ধ্বংসযজ্ঞের সূচনা করেছিলেন ওয়াকার। শেষ পর্যন্ত ১৯৮ রানে অলআউট হয় প্রোটিয়ারা। ১০ ওভার বোলিং করে মাত্র ২৫ রানে ৫ উইকেট নিয়ে ম্যাচসেরা হন ওয়াকার। সেদিন তার সবগুলো উইকেটই এসেছিল পুরনো বলের বিধ্বংসী এক স্পেলে।
১৯৯৪ সালের মার্চে অকল্যান্ডের ইডেন পার্কে পাকিস্তানের দেওয়া ১৬২ রানের সহজ টার্গেট তাড়া করতে নেমে এক পর্যায়ে নিউজিল্যান্ডের সংগ্রহ ছিল ৪ উইকেটে ১৪২ রান; কিন্তু পুরনো বলে ওয়াকারের বিধ্বংসী বোলিংয়ে মাত্র ১৯ রানে শেষ ৬ উইকেট হারায় স্বাগতিকরা, যার চারটিই ওয়াকারের। নিশ্চিত হারা ম্যাচ টাই করে মান বাঁচায় পাকিস্তান। সব মিলে ৩০ রানে ৬ উইকেট নেন ওয়াকার ইউনুস।
২০০০ সালে শারজায় কোকাকোলা কাপের ফাইনালে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে প্রথমে ব্যাট করে পাকিস্তান করেছিল ২৬৩ রান। জবাবে শুরুতে দু’টি উইকেট হারালেও নেইল ম্যাকেঞ্জিকে (৫৮) নিয়ে ঘুরে দাঁড়ান অধিনায়ক হ্যান্সি ক্রনিয়ে (৭৯)। সেদিন প্রথম স্পেলে ব্যয়বহুল বোলিং করার পরও পাকিস্তানকে জিতিয়েছিলেন ওয়াকার। দ্বিতীয় স্পেলে রিভার্স সুইংয়ে এক ভয়াল প্রদর্শনীতে তুলে নেন চারটি উইকেট। যে কারণে খরুচে বোলিং করেও (৪/৬২) ম্যাচসেরার পুরস্কারটা ওঠে ওয়াকার ইউনুসের হাতে।
ওয়াকার প্রকৃত ম্যাচ উইনার ছিলেন। বহু ম্যাচ প্রতিপক্ষের হাতের মুঠোয় থেকে কেড়ে এনেছেন গতি, রিভার্স সুইং, আর ইয়র্কারের ম্যাজিকে। তার ১৫০ কিলোমিটার গতির বলে ব্যাটসম্যান চমকে যেত, সুইংয়ে বিভ্রান্ত হতো আর ইয়র্কারে পেছনে ফিরে দেখতো স্ট্যাম্প উড়ে গেছে।
১৯৭১ সালে পাঞ্জাব প্রদেশের বুরেওয়ালা নামক ছোট্ট শহরে জন্ম ওয়াকার ইউনুসের। বাবার কাজের সুবাদে বড়ো হয়েছেন সংযুক্ত আরব আমিরাতে। ছোটবেলা থেকেই সাঁতার, হাইজাম্প, জ্যাভেলিন থ্রোয়িংসহ অ্যাথলেটিকসে দক্ষ ছিলেন; কিন্তু পাকিস্তানের আর সব তরুণের মতোই তাকে পেয়ে বসে ক্রিকেটের নেশায়। পাকিস্তানে ফেরার পর শুরু করেন ক্রিকেট শেখা। অবাক করা বিষয় হলো, শুরুতে লেগস্পিন বোলিং করতেন ওয়াকার; কিন্তু এরপর তাকে পেয়ে বসে গতির নেশা। যে কারণে হয়ে যান ফার্স্ট বোলার।
দুরন্ত স্বভাবের ছিলেন ছোটবেলা থেকেই। কৈশোরে ব্রিজ থেকে খালে ঝাঁপ দিতে গিয়ে তার ক্রিকেট ক্যারিয়ারই থেমে যেতে বসেছিল। ওই দুর্ঘটনায় তার বাম হাতের কনিষ্ঠ আঙুল কেটে ফেলতে হয়। কৈশোরের এই দুরন্তপনাই তাকে পরবর্তীতে ব্যাটসম্যানদের সামনে তেড়েফুড়ে বোলিং করার সাহস জুগিয়েছে। মাত্র ১৭ বছর বয়সে মুলতানের হয়ে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে অভিষেক। আর জাতীয় সুযোগ পাওয়াটা এক নাটকীয়তা। ওয়াকার তখন মাত্র ৬টি প্রথম শ্রেণির ম্যাচ খেলেছেন, ঘরোয়া ক্রিকেটেও নিয়মিত ছিলেন না দলে। ১৯৮৯ সালে একটি ম্যাচে পেসার সেলিম জাফর ইনজুরিতে পড়ায় সুযোগ হয় ওয়াকারের। ভাগ্যক্রমে সেই ম্যাচটি টিভিতে দেখছিলেন পাকিস্তান দলের অধিনায়ক ইমরান খান। টিভিতে ওয়াকারের বোলিং দেখে মুগ্ধ হয়ে ইমরান ছুটে যান মাঠে। ওয়াকারকে কাছে ডেকে বলেন, ‘আগামী মাসে ত্রিদেশীয় সিরিজ খেলতে তুমি শারজায় যাচ্ছ।’
শারজায় ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ওয়ানডে অভিষেক সে বছর অক্টোবরে। পরের মাসে করাচিতে ভারতের বিপক্ষে টেস্ট অভিষেক। ওটা ছিল ভারতীয় ক্রিকেটের ‘বিস্ময়বালক’ শচীন টেন্ডুলকারেরও অভিষেক টেস্ট। সেদিন ইনিংসের শুরুতেই দ্রুতগতির এক বাউন্সারে শচীনের নাক ফাটিয়ে দেন ওয়াকার। ব্যক্তিগত ১৫ রানের মাথায় তাকে বোল্ড করে সাজঘরেও ফেরান। অভিষেক টেস্টের প্রথম ইনিংসে উইকেট নিয়েছিলেন আরো তিনটি। শচীন ছাড়াও আউট করেছিলেন সঞ্জয় মাঞ্জরেকার, মনোজ প্রভাকর ও কপিল দেবকে। তবে ইনজুরির কারণে দ্বিতীয় ইনিংসে বোলিং করেননি।
পরের বছর ঘরের মাঠে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে তিন ম্যাচের টেস্ট সিরিজটা পাকিস্তান জিতেছিল ৩-০ ব্যবধানে। ওয়াকার নিয়েছিলেন ২৯ উইকেট, মাত্র ১০.৮৬ গড়ে! এর মধ্যে লাহোর টেস্টে ১০ উইকেটের পর ফয়সালাবাদে নিয়েছিলেন ১২ উইকেট। আর তিন ম্যাচের ওয়নাডে সিরিজে নেন ১১ উইকেট। এরপর একের পর এক ম্যাচ জিতিয়েছেন পাকিস্তানকে। ওয়াসিম আকরামের সাথে জুটি বেঁধে দেশকে উপহার দিয়েছেন অনেক স্মরণীয় বিজয়। ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, ওয়েস্ট ইন্ডিজ- সবখানেই বল হাতে হয়ে উঠেছেন ব্যাটসম্যানদের ঘাতক। ওয়ানডেতে সবচেয়ে বেশি ১৩ বার ৫ উইকেট নেওয়ার রেকর্ডটা এখনো তার দখলে।
পাকিস্তানকে ১৭টি টেস্ট আর ৬২টি ওয়ানডেতে নেতৃত্ব দিয়েছেন ওয়াকার। টেস্টে ৭টি হারের বিপরীতে জয় ১০টি আর ওয়ানডেতে ২৩টি হারের বিপরীতে জয় পেয়েছেন ৩৭টিতে। ২০০৩ বিশ^কাপে তার নেতৃত্বে খেলেছে পাকিস্তান। তবে প্রথম রাউন্ড থেকে বাদ পড়ায় তখনই আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারে ইতি টানেন এই কিংবদন্তি পেসার।
ওয়ানডেতে দ্রুততম ৪০০ উইকেট পাওয়ার রেকর্ডটা এখনো তার দখলে। আছে টানা তিন ওয়ানডেতে ৫ উইকেট নেওয়ার রেকর্ডও। ওয়ানডেতে আছে একটি হ্যাটট্রিক। টেস্টে কমপক্ষে দুইশো উইকেট আছে এমন বোলারদের মাঝে স্ট্রাইক রেট দ্বিতীয়।
ইনজুরি তার ক্যারিয়ারের অনেকটা সময় কেড়ে নিয়েছে। না হলে পরিসংখ্যানটা অনেক সমৃদ্ধ হতো। এই ইনজুরিই তাকে ১৯৯২ এর বিশ্বকাপ জয়ী পাকিস্তান দল থেকে ছিটকে দিয়েছিল টুর্নামেন্ট শুরুর কয়েকদিন আগে। এর পরেও অনেকবার ইনজুরির কারণে তাকে মাঠের বাইরে থাকতে হয়েছে।