Home চিত্র-বিচিত্র মরু উদ্ভিদ -আতাউর রহমান

মরু উদ্ভিদ -আতাউর রহমান

১.
মরুভূমির অদ্ভুত উদ্ভিদগুলোর মধ্যে সবচেয়ে অন্যরকম দেখতে ওয়েলউইটসিয়া মিরাবিলিস। দূর থেকে দেখলে মনে হতে পারে, কিছু ছেঁড়া কাপড় মাটিতে পড়ে আছে।
আরেকটু কাছে গেলে মনে হবে কাণ্ডবিহীন একটি উদ্ভিদ, যার রয়েছে এলোমেলো অসংখ্য পাতা। তবে একেবারে কাছে পৌঁছলে দেখা যাবে, এর কাণ্ড নেই, পাতাও কেবল দুটি। এ দুটি পাতার বৃন্ত থেকেই ক্রমাগত নতুন নতুন উপপত্রক জন্মাতে থাকে। ওয়েলউইটসিয়া সর্বোচ্চ এক হাজার ৫০০ বছর বাঁচতে পারে।
এটি সর্বোচ্চ প্রতিকূল পরিবেশেও বেঁচে থাকতে সক্ষম। এর শেকড় পানির খোঁজে এতটাই গভীরে যায় যে পানি যদি পৃথিবীর কেন্দ্রেও থাকে, তাহলে সেটি সেখানেই পৌঁছে যাবে। বিজ্ঞানীদের ধারণা, এটি জুরাসিক যুগে আবির্ভূত হয়। নামিবিয়ার মরুভূমিতে এ উদ্ভিদ সবচেয়ে বেশি দেখা যায়।

২.
আমেরিকার দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় মরুভূমিতে অদ্ভুত সুন্দর ব্যারেল ক্যাকটাস জন্মায়। সৌন্দর্যের পাশাপাশি এটি বিপজ্জনকও। এর ফাঁপা নলাকার শরীরজুড়ে আছে ৪ ইঞ্চি লম্বা মোটা কাঁটা, যা একে পোকামাকড়ের আক্রমণ থেকে রক্ষা করে। আমেরিকার মরুভূমিগুলোতে যেসব ক্যাকটাস পাওয়া যায়, ব্যারেল ক্যাকটাস তার মধ্যে সবচেয়ে বড়ো।
অগভীর শেকড়বিশিষ্ট এ উদ্ভিদ ১০ মিটার পর্যন্ত লম্বা হতে পারে। তবে সবচেয়ে অদ্ভুত ব্যাপারটি হলো, ব্যারেল ক্যাকটাসকে মাটি থেকে তুলে রেখে দিলেও তা অনধিক ছয় বছর বাঁচতে পারে।
কেননা, এটি এর দেহের ওজনের চেয়ে বেশি পরিমাণ পানি সেখানে জমা করে রাখে, যা ধীরে ধীরে ব্যবহার করে। তবে নির্বিঘেœ মাটিতেই থাকতে দিলে একেকটি ব্যারেল ক্যাকটাস প্রাকৃতিক সব প্রতিকূলতা জয় করে ১৫০ বছর পর্যন্ত বেঁচে থাকে।

৩.
আর একটি উদ্ভিদ হিডনোরা আফ্রিকানাক। দূর থেকে দেখে অনেকে কৃষ্ণচূড়াও মনে করতে পারে। তবে কাছে গেলে নতুন কোনো প্রজাতির ফাঙ্গাস মনে হতে পারে হিডনোরা আফ্রিকানাকে।
আফ্রিকার মরুভূমিতে প্রাকৃতিকভাবে জন্মানো এই উদ্ভিদের কোনো পাতা নেই। যা আছে, তা হলো এর গাঢ় বাদামি রঙের কাণ্ড। তবে এর লাল বা কমলা রঙের জন্য মৌসুমি ফুলের সময়ে এটি দেখতে সুন্দর লাগে। ফুলগুলো দিয়ে আকৃষ্ট হয়ে ভ্রমর এই উদ্ভিদের পরাগায়ণে সহায়তা করে। যখন ফুল থাকে না, তখন একে ছত্রাক ভেবে ভুল করেন অধিকাংশই।
শুধুমাত্র কাণ্ডনির্ভর এই উদ্ভিদের শেকড় বেশ গভীরে পৌঁছে। তথাপি, প্রতিকূল পরিস্থিতির জন্য প্রচুর পরিমাণ পানি জমা করে রাখে কাণ্ডের ভেতর। এই কাণ্ডের আবার অর্ধেকের বেশি অংশই মাটির নিচে থাকে। মজার ব্যাপার হলো, মরুভূমিতে অনেকেই ভুল করে হিডনোরার ফলকে আলু মনে করে খেয়ে ফেলেন। অবশ্য দেখতে আলুর মতো ফলটির স্বাদও প্রায় একই রকম এবং জন্মায়ও মাটির নিচেই।

৪.
দেখতে হুবহু বেসবলের মতো এই উদ্ভিদের বৈজ্ঞানিক নাম ‘ইউফোরবিয়া ওবেসা’। এর এমন চেহারাই এর জন্য ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। মরুভূমি থেকে মানুষ এদের সংগ্রহ করেছে সৌন্দর্যের কারণে। বাণিজ্যিকভাবে এর কদর খুব বেশি।
অতিমাত্রায় সংগ্রহের কারণে প্রকৃতিতে এটি বিলুপ্ত হয়ে গেছে। এই উদ্ভিদ বর্তমানে পাওয়া যায় কেবল নার্সারি আর বোটানিক্যাল গার্ডেনগুলোয়। সবুজ রঙের এই উদ্ভিদগুলোর ব্যাস ১৫ সেন্টিমিটার পর্যন্ত হয়ে থাকে।
এর ফুলের রঙ হলুদাভ সবুজ, যেগুলোকে সিয়াথিয়া বলে। ব্যারেল ক্যাকটাসের মতো মাটির সংস্পর্শ ছাড়া ছয় বছর বেঁচে থাকতে না পারলেও, এটিও ভবিষ্যৎ প্রয়োজনের জন্য দেহে অনেক পানি জমা করে রাখে।

৫.
আর্জেন্টিনা আর বলিভিয়ার উঁচু পর্বতাঞ্চলীয় মরুভূমিতে প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যায় সিলভার টর্চ ক্যাকটাস। এটি ক্যাকটাসিয়া গোত্রের একটি বহুবর্ষজীবী উদ্ভিদ। এর দেহাবয়ব অসংখ্য উলের মতো সূক্ষ্ম তন্তুসমৃদ্ধ বিধায় একে ‘উলি টর্চ’ ক্যাকটাসও বলা হয়। এর সরু, খাড়া, সবুজাভ ধূসর কাণ্ড ৩ মিটার পর্যন্ত লম্বা হলেও সেগুলোর ব্যাস সর্বোচ্চ ছয় সেন্টিমিটার পর্যন্ত হয়। মজার ব্যাপার হলো, এটি প্রচুর সূর্যালোক পছন্দ করলেও অধিক তাপমাত্রায় বেঁচে থাকতে পারে না।
বলিভিয়ান মরুভূমিগুলোর এমন সব স্থানেই এই সিলভার টর্চ ক্যাকটাস জন্মায়, যেখানে পর্যাপ্ত সূর্যালোক থাকলেও তাপমাত্রা অত বেশি নয়, আবার গ্রীষ্মকালে প্রচুর বৃষ্টিপাতও হয়। পর্যাপ্ত পানি আছে, এমন অঞ্চলে জন্মায় বলে এর দেহে অন্যান্য মরু উদ্ভিদের মতো পানি সংগ্রহের ব্যবস্থা বিবর্তিত হয়নি।
এই উদ্ভিদের সবচেয়ে অদ্ভুত বৈশিষ্ট্যটি হলো, এটি অধিক তাপমাত্রা সইতে না পারলেও, ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় টিকে থাকতে পারে! ফ্রান্সে এই উদ্ভিদের চাষাবাদও করা হয়, কেননা এর মূল থেকে বার্গান্ডি নামক একপ্রকার মদ তৈরি করা হয়।

৬.
আফ্রিকা, আরব আর অস্ট্রেলীয় মরুভূমিগুলোতে প্রচুর পরিমাণে জন্মায় অদ্ভুত বাওবাব গাছ। যদিও এদের সবচেয়ে বেশি সংখ্যক সদস্য পাওয়া গেছে মাদাগাস্কারেই। কেবল মরু উদ্ভিদ নয়, সমগ্র উদ্ভিদকুলের মধ্যেই সবচেয় বেশি পরিমাণ পানি ধারণ করতে পারে এই বাওবাব গাছগুলো।
এই গাছের মোটা গুঁড়িগুলো ১-১.২ লক্ষ লিটার পর্যন্ত পানি জমা করে রাখতে পারে! দেহে পর্যাপ্ত পানি ধারণ করে রাখা যায় বলে এই উদ্ভিদগুলো সাধারণত কম বৃষ্টি হয় এরকম শুষ্ক, উত্তপ্ত স্থানে জন্মাতে পছন্দ করে।
বাওবাব পৃথিবীর প্রাচীনতম ‘অ্যাঞ্জিওস্পার্ম’ উদ্ভিদের একটি। অ্যাঞ্জিওস্পার্ম বলতে বোঝায় যেসকল উদ্ভিদ বীজের মাধ্যমে বংশবিস্তার করে। দেহে কোনো ‘গ্রোথ রিং’ তৈরি হয় না বলে রেডিওকার্বন পদ্ধতিতে এর বয়স নির্ধারণ করা কষ্টসাধ্য। তবে বাওবাব গাছ দীর্ঘায়ু হয়ে থাকে, সাধারণত এক হাজার বছরের মতো বেঁচে থাকে সহজেই। দক্ষিণ আফ্রিকায় পাওয়া একটি নমুনার বয়স তো ছয় হাজার বছর নির্ণীত হয়েছে।

SHARE

Leave a Reply