‘তোমার মামার ফোনটা এনে দাও।’ মায়ের আঁচল ধরে টানতে টানতে ইনিয়ে বিনিয়ে আবদার করছে হানজালা।
‘আচ্ছা, দিচ্ছি।’ ধৈর্যহারা হয়ে বললেন মা।
হানজালা একদম পিচ্চি ছেলে। বয়স মাত্র চার। আইডিয়াল মাদরাসার ছাত্র। শিশু শ্রেণিতে পড়ে। দুষ্টের হাড্ডি। তবে রোল এক। আইডিয়ালে ক্লাসের পড়া ক্লাসেই মুখস্থ করানো হয়। তাই বাসায় পড়াশোনার তেমন চাপ নেই। হাতের লেখা লিখতে হয়। আর সামান্য একটু পড়লেই সারে। টাইম পাসের জন্য আছে টিভি। তাতে সারাক্ষণ কার্টুন দেখাতেই ব্যস্ত। কখনো বড়াপু যুথীর সাথে বাধে ঠোকাঠুকি। রিমোট কার কাছে থাকবে তা নিয়ে হয় ঝগড়া। আম্মু এসে মীমাংসা করেন। আব্বুর ফোন নিয়ে পড়ে থাকে। গেম খেলে। গান-গজল দেখে।
নানাবাড়ি এসেছে বেড়াতে। খালাতো বোন জীম, জিন্নাত ও মহুয়াও এসেছে। এসেছেন খালামণিও। ছোটো মামা রাকিব, ভাইয়া অভি এবং যুথির সাথে এক গেম লুডু খেলেছে। মোবাইলে। সবাইকে হারিয়ে ফার্স্ট হয়েছে হানজালা। ওর তীক্ষè মেধা। সহসা কেউ ওর সাথে পেরে ওঠে না। খেলাধুলা এবং পড়াশোনাতেও। নানাবাড়ি টিভি নেই। নানা এসব পছন্দ করেন না। হজ করে এসেছেন। ছিলেন কৃষি অফিসার। পেশাগত জীবনে সৎ ও যোগ্যতার স্বাক্ষর রেখেছেন। লম্বা জুব্বাই তার নিয়মতান্ত্রিক পোশাক। বাসার সামনে দিয়েছেন মসজিদ।
সেখানেই সময় কাটে। তাই হানজালা নানাবাড়ি এলে টিভি দেখার সুযোগ পায় না। এ নিয়ে তার আফসোস নেই। তবে একটা মোবাইল তার চাই। যেটা দিয়ে কখনো গেম চলবে। কখনো দেখবে ছোটোদের মজার কার্টুন।
জীম তাদের ফোনে কার্টুন দেখছে। হানজালা যেটা দেখতে চাচ্ছে ও সেটা প্লে করছে না। তাই হানজালার খুব রাগ হলো। হলো একটু অভিমানও। অপরদিকে আব্বুর ফোনে চার্জ নেই। কারেন্ট সেই যে লাপাত্তা হলো, তার আর খোঁজখবর নেই। কোথায় হাওয়া খেতে গেছে কে জানে! এজন্যই বারবার মাকে বলছে মামার ফোনটা এনে দিতে
যদিও ছোটো খালামণির হাজব্যান্ডের মোবাইলটা অবসর যাপন করছে, তবুও সেটা ধরার বা চাওয়ার সাহস সে করছে না। এর কারণও আছে। ছোটো আঙ্কেলটা একদম অল্প বয়সী। তিনি হানজালাকে অত্যন্ত আদর করেন। ভালোবাসেন। একদিকে তিনি হানজালার উস্তাদও। হানজালা যে মাদরাসায় পড়ে, সেখানকার শিক্ষক তিনি। হানজালার কার্টুন আসক্তি কমানোর চেষ্টা তিনি করেন।
ছোটোরা যেহেতু কার্টুনের ভক্ত। ছোটো আঙ্কেল বেড়াতে এলে তার মোবাইলে কার্টুন লোড করে আনেন। তবে সেগুলো অনর্থক ও আজগুবি কিচ্ছার কার্টুন নয়। শিক্ষণীয়। ইসলামিক কার্টুন। তিনি একবার সবাইকে নিয়ে বসলেন একটা কার্টুন দেখতে। দেখার আগে তাদের একটু প্রস্তুত করলেন। আগ্রহী করলেন। দুর্দান্ত ও চমৎকার একটি কার্টুন আছে নাকি তার কাছে।
‘আমি দেখবো।’ বললো হানজালা। স্যার! আমাকে দেখান। ছোটো আঙ্কেলকে হানজালা স্যার বলে সম্বোধন করে। আঙ্কেল সহসা বলে না। আর খালু পরিভাষা বর্তমানে বিলুপ্তি প্রায়। এ নিয়ে ছোটো আঙ্কেলের ঘোর আপত্তি। মামা, খালু, ফুফা এবং চাচা এদের সবাইকে আঙ্কেল ডাকলে আবার প্রশ্ন ওঠে। ফুফাকে আঙ্কেল ডাকলে জিজ্ঞাসা করতে হবে কোন আঙ্কেল? মূলত আঙ্কেলটা শুধু চাচার ক্ষেত্রেই ব্যবহার করা যুক্তিযুক্ত।
ছোটো আঙ্কেল কার্টুন ভিডিওটি প্লে করলেন। সবাই জড়ো হয়ে বসলো। জীম এতক্ষণ যা দেখছিলো তা বাদ দিয়ে আঙ্কেলের মোবাইলের দিকে চোখ ঘোরালো। এবার পিনপতন নীড়বতা। টুঁ শব্দটি নেই। ভিডিওটি দেখছে আর এ ওর দিকে চাওয়া চাওয়ি করছে। পুরো ভিডিওটি ওরা খুব মনোযোগ সহকারে দেখলো। ভিডিও দেখা শেষ। আঙ্কেল ব্যাখ্যা করা শুরু করলেন। তিনি মনে করলেন ওদের এটা বুঝিয়ে বলা দরকার। যদিও ভিডিওতে সব ক্লিয়ার। তারপরও। সবার বুঝ তো এক না। তাছাড়া ওরা কোমলমতি। চিন্তার দৌড় বেশি দূর নয়। ওদের বুঝিয়ে বলাটাই উচিত।
‘তোমরা যে ভিডিওটি দেখলে তা বিখ্যাত বুজুর্গ বায়েজিদ বোস্তামীর।’ বললেন আঙ্কেল। ‘তার শৈশবের একটি ঘটনা। তিনি তখন অনেক ছোটো। তোমাদের মতো বয়স। আম্মুর সেবা করে জগদ্বিখ্যাত ওলি হয়েছেন। মা পানি চেয়ে ঘুমিয়ে পড়লে, পানি এনে সে মায়ের শিওরেই রাত কাটিয়ে দেন। আর তোমরা কী করো? তোমরা আম্মুর কথা শোনো তো?’ প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়ে ঘটনাটি তাদের মগজে ঢোকানোর কোশেশ করলেন তিনি। ওরা ইতস্ততবোধ করলো। কিছুটা লজ্জিতও হলো। ‘আব্বু-আম্মু অনেক কষ্ট করে তোমাদের লালন-পালন করছেন। তাদের একটু আধটু কথাও কি তোমরা শুনবে না! শুনবে।’ এভাবে কিছুক্ষণ নসিহত করলেন ছোটো আঙ্কেল। সবাই মুগ্ধ হয়ে শুনলো।
সবার মুখে হাসি ফিরিয়ে আনতে বললেন, ‘এক গেম আমিও খেলবো। দেখি কে পারে? হানজালা নাকি আমি?’ হানজালা রাজি হয়ে গেলো। আঙ্কেল ওরফে উস্তাদকে এবার হারানো চাই।
খেলা শুরু। চার ছক্কার মার। ছক্কা যার ওঠে সেই রাজা। কে পায় তাকে। কিন্তু ইচ্ছা করে কি আর ওঠানো যায়! যতই বুদ্ধিমত্তা থাকুক না কেন। যখন যা প্রয়োজন তেমন চাল না উঠলে খেলাই মিস। হানজালার সাথে শেষমেশ কেউ পারলো না। ও হাতটাকে এমন ভঙ্গিতে মুষ্টিবদ্ধ করে বললো, জিতে গেছি। যেন সে পরিণত একজন যুবক। বিশাল কোনো খেলায় জিতেছে।
এরপর যখনই ছুটিতে নানাবাড়ি সবাই মিলিত হন, হানজালা ছোটো আঙ্কেলের কাছে চমৎকার সেই শিক্ষণীয় কার্টুন ভিডিও দেখার বায়না ধরে। তিনি আব্দুল বারীর ভিডিও দেখান। দেখান অন্যান্য শিক্ষণীয় কার্টুন ভিডিও। ছোটো আঙ্কেল মনে করেন, এই আধুনিক যুগে স্মার্টফোন প্রায় সব বাসাতেই আছে। ছেলে মেয়েরা ইচ্ছায় আর অনিচ্ছায় মোবাইলে আসক্ত হয়ে পড়েছে। ছোটোরা গ্যামিং বা কার্টুন দেখে। এখান থেকে পুরোপুরি ফেরানো মুশকিল। তবে এর বিপরীতে সুস্থ সংস্কৃতি তাদের হাতে তুলে দিতে পারলে তারা ভালো কিছু শিখবে।