আজ তোমাদের পরিচয় করিয়ে দেবো এমন এক ক্রিকেটারের সাথে যাকে ক্রিকেট জগতের সবাই শান্ত, নম্র আর চমৎকার মানুষ হিসেবে চেনে। শুধু যে ব্যক্তিগত আচরণে তিনি এমন তাই নয়, ব্যাট হাতেও তিনি ধীরস্থির। কখনোই মেজাজ হারান না। পরিস্থিতি অনুযায়ী ব্যাটিং করে চলেন অত্যন্ত নিখুঁতভাবে। ব্যাট হাতে তিনি যেন এক শিল্পী। উইকেটের চারদিকে আঁকেন আলপনা। অবশ্য এই লেখা যখন তোমরা পড়ছো, তার আগেই তিনি আন্তর্জাতিক ক্রিকেটকে বিদায় বলেছেন।
বলছি দক্ষিণ আফ্রিকার সাবেক ওপেনার হাশিম আমলার কথা। জাতীয় দল থেকে অবসর নিয়ে এখন তিনি কাউন্টি ক্রিকেটে খেলছেন। টেস্ট, ওয়ানডে আর টি-টোয়েন্টি তিন ফরম্যাটের ক্রিকেটেই তিনি সমান তালে খেলার যোগ্যতা রাখেন। যখন সেরা ফর্মে ছিলেন, পাল্লা দিয়ে রান করেছেন বিরাট কোহলির সাথে। অনেক ক্ষেত্রে তো কোহলির চেয়েও এগিয়ে ছিলেন। ওয়ানডে ক্রিকেটে দ্রুততম দুই হাজার, পাঁচ হাজার ও সাত হাজার রানের রেকর্ড হাশিম আমলার দখলে। এসব রেকর্ডে তিনি পেছনে ফেলেছেন ভিভ রিচার্ডস ও বিরাট কোহলিকে। ওয়ানডেতে সবচেয়ে কম ইনিংসে ১০টি সেঞ্চুরিতে পৌঁছানোর কৃতিত্বও হাশিম আমলার। ওয়ানডেতে সব মিলে ১৮১ ম্যাচে প্রায় পঞ্চাশ গড়ে রান করেছেন আট হাজারের বেশি। সেঞ্চুরি করেছেন ২৭টি। আর ১২৪ টেস্টে ২৮ সেঞ্চুরিতে রান করেছেন ৯ হাজারের বেশি। টেস্টে হাশিম আমলার গড় ৪৭ প্রায়।
ঠাণ্ডা মাথায় খেলতেন বলে শুরুর দিকে অনেকে হাশিম আমলাকে টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটার হিসেবে মানতে চাইতেন না; কিন্তু সংক্ষিপ্ত ফরম্যাটের ক্রিকেটেও তার সেঞ্চুরি রয়েছে দুটি। আইপিএলেও খেলেছেন কয়েক মৌসুম।
ক্রিকেটে হাশিম আমলার পথ চলাটা সহজ ছিল না। দক্ষিণ আফ্রিকার ক্রিকেটে বর্ণবৈষম্যের রেশ এখনো রয়ে গেছে। দেশটিতে কৃষ্ণাঙ্গ ক্রিকেটারদের সুযোগ দিতে জাতীয় দলে রয়েছে কোটাপদ্ধতি। তাই আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারের প্রথম দিকে যখন ভালো করতে পারছিলেন না, তখন অনেকেই তাকে কোটার খেলোয়াড় হিসেবে কটূক্তি করতেন। তবে শান্ত আর চুপচাপ স্বভাবের হাশিম আমলা এসবের জবাব দিয়েছেন ব্যাট হাতেই। দক্ষিণ আফ্রিকার ক্রিকেটে শ্বেতাঙ্গ স্টাবলিশমেন্টের বিরুদ্ধে আমলার পুরো ক্যারিয়ারই ছিলো একটি প্রতিবাদ।
২০১২ সালে টেস্ট র্যাঙ্কিংয়ে এক নম্বরে ওঠে দক্ষিণ আফ্রিকা। সেই সাথে তারা প্রথম দল হিসেবে তিন ফরম্যাটেই এক নম্বর দলের জায়গা নেওয়ার গৌরব অর্জন করে। এই অর্জনে বড়ো ভূমিকা ছিলো হাশিম আমলার। ইংল্যান্ডের মাটিতে সিরিজের প্রথম টেস্টে ৩১১ ও তৃতীয় টেস্টে ১২১ রানের ইনিংস খেলে দক্ষিণ আফ্রিকাকে টেস্ট র্যাঙ্কিংয়ে শীর্ষে ওঠাতে ভূমিকা রাখেন।
দক্ষিণ আফ্রিকার ডারবানে হাশিম আমলার জন্ম ১৯৮৩ সালের ৩১ মার্চ। পুরো নাম হাশিম মোহাম্মাদ আমলা। তার পরিবার ভারতের গুজরাট থেকে দক্ষিণ আফ্রিকায় অভিবাসী হয়েছিল। মধ্যবিত্ত আর ধার্মিক পরিবারের সন্তান হাশিম ডারবান হাইস্কুলে পড়াশোনা করেছেন। বড়ো ভাই আহমেদ আমলাও ছিলেন ক্রিকেটার। দক্ষিণ আফ্রিকা অনূর্ধ্ব-১৯ দলের হয়েও খেলেছেন।
কাওয়াজুলু নাটাল আঞ্চলিক দল দিয়ে হাশিম আমলার সিনিয়র ক্রিকেটে অভিষেক। ২০০২ যুব বিশ্বকাপে দক্ষিণ আফ্রিকা দলকে নেতৃত্ব দেন, ফাইনালে অস্ট্রেলিয়ার কাছে পরাজিত হয় তার দল। মাত্র ২১ বছর বয়সে প্রাদেশিক দলের অধিনায়ক হিসেবেও দায়িত্ব পান।
২০০৪ সালের নভেম্বরে ভারত সফরে কলকাতায় সিরিজের দ্বিতীয় টেস্টে অভিষেক হয় তার। শুরুটা ভালো না হলেও দেড় বছর পর দেশের মাটিতে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ১৪৯ রানের ইনিংস খেলেন। আর ২০০৭ সালে নিউজিল্যান্ড সফরে পরপর দুই টেস্টে অপরাজিত ১৭৬ ও ১০৩ রানের ইনিংস খেলার পর স্থায়ী জায়গা করে নেন দলে। ২০০৮ সালের মার্চে চট্টগ্রামে বাংলাদেশের বিপক্ষে ওয়ানডেতে অভিষেক হয়।
২০১০ সালটা ছিল তার ক্যারিয়ারের সেরা বছর। ভারত সফরে তিন ইনিংসে একটি ডাবল সেঞ্চুরিসহ করেন ৪৯০ রান। সে বছর ১৫ ওয়ানডেতে ৫ সেঞ্চুরির পাশাপাশি করেন ৪ হাফ সেঞ্চুরি। যার ফলে ওয়ানডে র্যাঙ্কিংয়ের শীর্ষে ওঠেন। একই বছর টেস্টেও করেন ৫টি সেঞ্চুরি।
২০১৪ সালের জুনে প্রথম অশে^তাঙ্গ হিসেবে দক্ষিণ আফ্রিকার টেস্ট ক্যাপ্টেনের দায়িত্ব পান। ১৪ টেস্ট ও ৯ ওয়ানডেতে নেতৃত্ব দিয়েছেন দলকে। তবে অধিনায়কত্বের চেয়ে ব্যাটিংয়ে মনোনিবেশ করতেই তার আগ্রহ ছিল বেশি। যে কারণে ২০১৬ সালের জানুয়ারিতে স্বেচ্ছায় নেতৃত্ব ছেড়ে দেন।
ধর্মপ্রাণ মুসলিম হাশিম আমলা সব সময়ই চেষ্টা করেন ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলতে। দক্ষিণ আফ্রিকার জার্সিতে স্পন্সর হিসেবে একটি বিয়ার কোম্পানির লোগো ছিল; কিন্তু আমলা কোনো অ্যালকোহল কোম্পানির প্রচারণা নিজের জার্সিতে রাখতে চাননি। বোর্ড তার দাবি মেনে নিয়েছিল। ম্যাচ জেতার পর অন্য ক্রিকেটাররা পার্টি করলেও তিনি নিজেকে সরিয়ে নিতেন। সফরকালে ব্যাগে সব সময়ই থাকে কোরআন আর জায়নামাজ। অনুশীলনের ফাঁকে কিংবা যাত্রা পথে সুযোগ পেলেই কোরআন পড়েন।
মুসলিম হওয়ার কারণে তাকে বিভিন্ন সময় খারাপ পরিস্থিতির শিকার হতে হয়েছে। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে তার যখন অভিষেক সে সময় ইরাক যুদ্ধ চলছিল। মুসলিমদের সন্ত্রাসী হিসেবে পরিচিত করার অপচেষ্টা চলছে পশ্চিমা বিশে^। তেমনি একটি সময়ে দক্ষিণ আফ্রিকার মতো দলে দাড়িওয়ালা এক মুসলিম ক্রিকেটারের খেলে যাওয়া সহজ ছিল না। ২০০৬ সালের আগস্টে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে টেস্ট সিরিজে কুমার সাঙ্গাকারার ক্যাচ নেওয়ার পর অস্ট্রেলীয় ধারাভাষ্যকার ডিন জোনস আমলাকে ‘টেরোরিস্ট’ বলে কটূক্তি করেন।
২০১৯ সালের ওয়ানডে বিশ্বকাপের পর এই তারকা আন্তর্জাতিক ক্রিকেটকে বিদায় বলে দেন। সে আসরটা ভালো কাটেনি প্রোটিয়াদের জন্য। প্রথম রাউন্ড থেকেই বিদায় নিতে হয়েছে। তবু জীবনের শেষ ম্যাচটায় শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ৮০ রানের অপরাজিত এক ইনিংস খেলে দলকে এনে দিয়েছেন সান্ত¡নার জয়। বিশ^কাপের কয়েক মাস আগেই ছেড়েছেন টেস্ট ক্রিকেট। দারুণ ফর্মে থাকার পরও বয়স ৩৫ হয়ে যাওয়ায় তরুণদের জায়গা করে দিতে নিজেকে সরিয়ে নেন স্বেচ্ছায়।