Home গল্প ভিটেমাটির কান্না -মঞ্জুরুল ইসলাম

ভিটেমাটির কান্না -মঞ্জুরুল ইসলাম

অনেক দিন আগে মারা গেছে দাদা, মাঝে মধ্যে দাদার কবর জিয়ারাত করে মনে সান্ত¡না খোঁজে ইমান আলী। আগামীকাল দাদার মৃত্যুবার্ষিকী, কী করা যায় তাই ভাবছে ইমান আলী। চিন্তা করতে করতে, জোহরের নামাজ আদায়ের উদ্দেশ্যে গ্রামের মেঠো পথ ধরে হেঁটে চলছে, কিছুক্ষণ চলার পর মসজিদে পৌঁছায় ইমান আলী। অজু করে নামাজ আদায় শেষে মসজিদে শুয়ে আছে। প্রচ- সূর্যের তাপ পড়ছে, তাই মসজিদের বাইরে অনেক গরম। আবার দুপুরে মসজিদে ঘুমাতে বেশ ভালোই লাগে। এইসব কারণে প্রায় নিয়মিত গ্রামের কিছু মুরুব্বি মসজিদে শুয়ে থাকেন, কেউ আবার বসে গল্প করে।
ইমাম সাহেব এখনো মসজিদ হতে চলে যায়নি, তিনি বসে কুরআন তিলাওয়াত করছেন। ইমান আলী ইমামের পাশে গিয়ে বসে এবং মনোযোগ দিয়ে কুরআন তিলাওয়াত শুনছে। ইমাম সাহেবের কুরআন তিলাওয়াত শেষ হলে ইমান আলী তার দাদার মৃত্যুবার্ষিকীর ব্যাপারে ইমাম সাহেবের সাথে কথা বলে। সবকিছু শোনার পর ইমান আলীকে কিছু গরিব মিসকিনকে দাওয়াত দিয়ে খাওয়াতে এবং দান সদকা করতে বলেন।
আগামীকাল দাদার রুহের মাগফিরাত কামনা করে কিছু গরিব ও অসহায় মানুষদের দাওয়াত দেওয়া হয়েছে। প্রস্তুতি বেশ ভালো। অনেক আত্মীয়-স্বজন এসেছে। ইমান আলী একাকী সকল কাজ করছে, তবে অন্যের সহযোগিতা প্রয়োজন হলে সহযোগিতা নিচ্ছে। এভাবে প্রায় অর্ধেক রাত শেষ, এখন ঘুমাতে যাবে কিন্তু ঘুমতো আসছে না। চোখে যেন দাদার ছবি ভাসছে। অনেক চিন্তার মাঝে কখন যে ঘুমিয়ে গেছে বুঝতে পারেনি। ফজরের নামাজের আজান শুনে ঘুম ভাঙে ইমান আলীর। নামাজ শেষে আবার কাজ নিয়ে ব্যস্ত হয়ে যায়। দুপুরের মধ্যে সব রেডি করতে হবে। সকল কাজ শেষ করে ইমান আলী যে সকল আত্মীয়-স্বজন আসেনি তাদেরকে ফোন করতে থাকে।

দুপুরে দোয়ার মধ্য দিয়ে দাদার জন্য আয়োজিত অনুষ্ঠান শুরু হয়। সবাইকে ভালোভাবে খাওয়াতে পেরে খুশি ইমান আলী। সকলকে বিদায় দিয়ে, আত্মীয়-স্বজনদের সাথে দীর্ঘ রাত পর্যন্ত সময় কাটিয়ে অনেকটা ক্লান্ত। নিজে রাতের খাবার খেয়ে ঘুমিয়ে যায় ইমান আলী। দাদার প্রতি অনেক ভালোবাসা ইমান আলীর। কিন্তু গ্রামের মানুষ ইমানের দাদা আছেরকে তেমন পছন্দ করত না। পছন্দই বা করবে কেন? তিনি যে কতজনের কত ক্ষতি করেছেন তার কোনো ঠিক নেই।
ইমানের দাদা গ্রামে আছের দাদা বা আছের জাদুকার হিসেবেও পরিচিত ছিল। জমিজমা বিষয়ে তিনি খুবই দক্ষ ছিলেন। তাই গ্রামের সাধারণ, কম ও অশিক্ষিত মানুষ তার কাছে আসতো, তিনি বিভিন্ন পরামর্শ দিতেন। কিন্তু সেই পরামর্শের ফাঁকে লুকিয়ে থাকতো হীনস্বার্থ। মনের মধ্যে থাকতো লোভ আর স্বার্থপরতা। কত মানুষ যে নিজের বাপ-দাদার জমি হারিয়ে সর্বস্বান্ত হয়েছে তার যদি হিসেব করা হতো তাহলে তো প্রায় অর্ধশত মানুষের নাম আসতো। ইমান আলীর দাদা আছের তার নিজের আপন ভাতিজার জমি পর্যন্ত জোর করে, বুদ্ধির মারপ্যাঁচে ফেলে, নিজের করে নিয়ে মামলার চক্করে গ্রামছাড়া করেছিল।
তাই ইমানের দাদার মৃত্যুর সংবাদ শুনেও আসেনি সর্বস্বান্ত হওয়া ভাতিজা সেকেন্দার। আপন চাচার মৃত্যুর আট বছর পর আজ এসেছে সেকেন্দার কবর জিয়ারত করতে। চাচা আছেরের কবর ও তার বাবার কবর পাশাপাশি। দীর্ঘ মোনাজাতে শব্দ করে কান্না করছিল সেকেন্দার। জান্নাতবাসী হয় যেন বাপ-চাচা সেই দোয়া করে সেকেন্দার। চাচার দখলে নেওয়া সেই পুরাতন নিজ ভিটেতে এসে, সকল আত্মীয় স্বজনদের সাথে দেখা করে সেকেন্দার।

সেকেন্দার শুধু একাই, তার কোন আপন ভাই-বোন নেই। শুধু বেঁচে আছে বয়স্ক মা। এখানে শুধু চাচাতো ভাইয়েরা আছে। সেকেন্দারের পিতার চার ভাই ছিল সবাই মারা গেছে, সবশেষে আছের চাচা অর্থাৎ ইমান আলীর দাদা মারা যায়। অনেক বছর পর কয়েক ঘণ্টার জন্য এসে যেন মায়ার বন্ধনে নতুন করে সকলকে আবদ্ধ করে চলে যাচ্ছে সেকেন্দার। বিদায় দিতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়ছে চাচাতো ভাইয়েরা।
আকবর আলী আর আব্দুর রউফ যেতে দিতে চাইছে না। একদিকে যেমন চাচাতো ভাই, আবার অন্য দিকে প্রিয় বন্ধু। তারপরেও যে যেতে হবে সেকেন্দারের। বাড়িতে অনেক কাজ, বয়স্ক মা, ছোটো ছোটো ছেলে সন্তান নিয়ে কষ্টে পড়বে সেকেন্দারের স্ত্রী তাই চলে যেতে হচ্ছে। বিদায়ের শেষ মুহূর্তে ইমান আলীর দাদী অর্থাৎ আছের দাদার স্ত্রী বয়স্ক মানুষ পেছন থেকে কাঁদতে কাঁদতে এসে জড়িয়ে ধরে। সেকেন্দারের মায়ের কথা বারবার জিজ্ঞাসা করে। শরীর কেমন আছে জানতে চায়। একপর্যায়ে উচ্চঃস্বরে কেঁদে উঠে বলে- তোর চাচারে মাফ করে দিস বাজান। সেকেন্দার নির্বাক চেয়ে থাকে। শেষে আপন চাচীর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে, পিতৃভূমি, মাতৃভূমি ছেড়ে চলে যায় সেকেন্দার। যাওয়ার সময় মন যেন নীরবে কাঁদছে। স্মৃতিতে শুধু ভাসছে শৈশব থেকে বেড়ে উঠা কৈশোর আর যৌবনের শুরুতে ঘটে যাওয়া কত শত ঘটনা। অবাধ্য মনকে বাধ্য করে, ক্লান্ত পথিকের মতো সকলকে ছেড়ে আত্মীয়তার বন্ধনহীন ঠিকানার দিকে চলছে সেকেন্দার।

SHARE

Leave a Reply