Home গল্প রম্যগল্প রস -জাফর তালুকদার

রস -জাফর তালুকদার

ওষুধ কিনতে এসে রসমালা সুইটস থেকে দুটো বড়ো সাইজ রসগোল্লা খেয়ে নিয়েছি গবগব করে। ডায়াবেটিক রোগী। মনে ভয়, স্বজনরা কেউ আবার যদি দেখে ফেলেন! যদিও এই অপকর্মটি সুযোগ পেলেই লুকিয়ে-চুরিয়ে করি। কথায় বলে, চোরের দশ দিন, গৃহস্থের একদিন। আজ সেই একদিনের পাল্লায় পড়ে শিয়ালের মুরগি চুরির মতো রীতিমতো বেইজ্জত হলাম বিবি সাহেবের কাছে।
এজন্য দায়ী আমার নাভি লম্বিত দাড়ি আর ঝোপকাঁটা গোঁফের বিপুল সমাহার। আগে বড়ো কবি আর সাধু-সন্ন্যাসীদের একক এখতিয়ারে ছিল বিষয়টি। কিন্তু লকডাউনের সুবাদে সেই প্রথা এখন চালু হয়েছে ঘরে ঘরে। আগে সাধুবাবাদের মুখে এই জায়জঙ্গল দেখে বিস্ময়ের অন্ত ছিল না। গভীর চোখে দাড়িগোঁফের ভেতর অনেক খোঁজাখুঁজি করেও তাদের মুখের ঠিকানা মিলত না সহজে। গল্প আছে, গাঁয়ে এক নতুন সাধু দেখে পিছনে লাগলো কিছু ইঁচড়েপাকার দল। তারা সুর করে বলতে লাগল, ‘ও সাধু, তোর মুখ কই?’ সাধু নির্বিকার হেঁটে চলেছেন। কিন্তু অর্বাচীনদের অত্যাচারে তেষ্টাতে না পেরে একসময় যে মধুর বাক্যটি বললেন তা মুদ্রণযোগ্য নয়। এই গোঁফ নিয়ে সেদিন পড়েছিলাম আর এক মহাবিপাকে। দোকানে একটু বাজারসদাই করে ঘেমে-নেয়ে রাস্তায় বেরিয়ে দেখি লেখক গুন্টার গ্রাস হেঁটে যাচ্ছেন। আরে জার্মান ভদ্রলোক আবার তালতলায় কেন? পেছন থেকে গলা বেঁকিয়ে বিশেষ একটু ভাব নিয়ে হাঁক দিলাম, ‘হ্যাল্লো, হাউ আর ইউ?’ পাত্তা না পেয়ে আরো একটু চড়িয়ে দিলাম গলার স্বর, ‘হ্যালো রাইটার, হ্যালো।’ ভদ্রলোক ফিরলেন। কাছে এলেন। চুল আর গোঁফের বাহার ঠিক আছে। কিন্তু..!
আমার দেড় ব্যাটারি চোখের প্রতারণায় এই ভুলটি ঘটেছে দেখে চটপট ক্ষমা চেয়ে নিলাম। বিষয় সেটা নয়। আমি নিজেই যে কখন চুলদাড়িতে সাধুবাবায় রূপান্তরিত হয়েছি মালুম হয়নি এতদিন। আজ অলক্ষ্যে রসগোল্লার টুকরো ওই জঙ্গলের কাঁটায় বাঁধিয়ে এনে একেবারে ধরা খেলাম হাতেনাতে। আসলে দোষটি যে কাকে দেব ঠাহর করতে পারছি না। জীবনে ওই একটাই তো স্বপ্ন দেখে এসেছি ছেলেবেলা থেকে। ধন নয়, মান নয়, শুধু একটুখানি রসগোল্লা।
এই রসগোল্লার রসে একবার দারুণ মাতাল হয়েছিলাম সেই ছেলেবেলায়। তখন কতই বা বয়স। স্কুলের কাছে ফুলতলা হাটে আমি আর মধু মামা যে বাসায় থাকতাম, তার পাশে ছিল নারায়ণ মিষ্টান্ন ভাণ্ডার। রাতদিন রসগোল্লার মাথাখারাপ ঘ্রাণে টুকুস টুকুস লালা ঝরত আমার। অংকের শূন্যকেও মনে হতো গোল রসগোল্লা। একেবারে নাজেহাল অবস্থা। ইতিহাস বই খোলা রেখে বেড়ার ফাঁক দিয়ে ট্যারা চোখে তাকিয়ে থাকতাম কড়াই ভর্তি রসগোল্লার দিকে। পড়ায় মন উঠে গেল। শয়নে স্বপনে কেবল ঘুরেফিরে আসে রসেডোবা ওই মনোহর ছবি। লোভ বড়ো সংক্রামক জিনিস। দেখলাম মধু মামাও একই রোগে আক্রান্ত ব্যাকুল মাছি। এখন আর লজ্জা করে কী হবে!
মামা ভাগ্নে বসে গেলাম গভীর গবেষণায়। কী করে ওই জিনিস ভাগে আনা যায় এই নিয়ে নতুন নতুন পরিকল্পনা। একবার মনে হলো, সিঁদ কেটে তুলে নিয়ে আসি রসগোল্লার আস্ত কড়াইটা। মামা সঙ্গে সঙ্গে খারিজ করে দেন। তাহলে চাঁচের বেড়া কেটে ঢুকলে কেমন হয়! সে- প্রস্তাবও বাতিল হয়ে যায় কণ্ঠভোটে। ওইসব চলবে না। প্রেস্টিজের ব্যাপার। একেবারে ভদ্রগোছের একটা উপায় বের করতে হবে। যাতে সাপও মরে, লাঠিও না ভাঙে। তাহলে কী হবে সেটা? টমাস আলভা এডিসনের মতো অনেক মাথা খাটিয়ে উপায় একটা বের হলো শেষ পর্যন্ত। ইউরেকা বলে দুজনে এমনভাবে লাফিয়ে উঠলাম যেন রসগোল্লার কড়াইটা ছটাং করে নাকে এসে পড়েছে।
রাতেই শুরু হবে অপারেশন। বিকেলে রেকি করে দেখে এসেছি সব। চুলোর পাঁক থেকে নেমে কড়াইটা যেখানে ঠাণ্ডা হবে ওটাই মূল টার্গেট। সব খাপে খাপে মিলে যাচ্ছে। গাঁওগ্রামের হাট। দশটা বাজতেই রাত গভীর। শুরু হল অপারেশন রসগোল্লা। আমাদের টিনের বেড়ার ফাঁক থেকে লম্বা পাটকাঠি বের করে ধীরে ধীরে ঢুকিয়ে দিলাম নারায়ণ মিষ্টান্ন ভাণ্ডারের বেড়ার ফাঁকে। ডাক্তার এন্ডোস্কোপির জন্য যে রকম কায়দা করে নল ঢুকায় পাকস্থলীতে, পাটকাঠিটা সেভাবে এসে ঠেকল রসগোল্লার গরম কড়াইতে।
অপারেশন সাকসেসফুল। এবার ঘরে বসে মহা আরামে পাটকাঠির ওলানে চুকচুক চুমুক দিয়ে ছাগল ছানার মতো টেনে চললাম রসগোল্লার গরম রস। এই ক্ষুদ্র কপালে নাইবা জুটল আস্ত রসগোল্লা, কিন্তু মিনিমাগনা গরম রসটুকুওবা কম কীসে!

SHARE

Leave a Reply