Home ফিচার জনপ্রিয় হচ্ছে ছাদকৃষি -লতিফুর রহমান

জনপ্রিয় হচ্ছে ছাদকৃষি -লতিফুর রহমান

কনক্রিটের স্থাপনার আড়ালে হারিয়ে গেছে সবুজের সমারোহ। নগরায়ণের ফলে নির্মিত হচ্ছে আবাসিক দালান, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, অফিস, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, কলকারখানা, রাস্তাঘাট ইত্যাদি। মাঠের কৃষিজমি কমে যাচ্ছে, কাটা পড়ছে গাছপালা, জলাশয় ভরে যাচ্ছে। প্রকৃতি হারাচ্ছে বাস্তুসংস্থান, পাশাপাশি দূষণের মাত্রা বেড়েই চলেছে।
আচ্ছা বন্ধুরা! কেমন হয় দালানের ছাদে শাক-সবজি, ফলমূল, মাছ, মুরগি ইত্যাদি চাষ করলে? হ্যাঁ বন্ধুরা অনেকেই তা করছেন। এর মাধ্যমে আমাদের সেই হারানো সবুজ ফিরে পেতে শুরু করেছি। ভবনের ছাদে চাষাবাদকে বলা হচ্ছে ছাদকৃষি।
ছাদকৃষি অনেক আগে থেকেই আছে। তবে ইদানীং এর প্রচার ও প্রসার বেড়েছে। ভবন মালিকরা আগ্রহী হচ্ছেন। পত্রিকা ও টেলিভিশনে খবর হচ্ছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছবি ও ভিডিও ছড়িয়ে পড়েছে। অনেক প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে যারা বাণিজ্যিকভাবে ছাদকৃষির কাজ করে দেয়।
মজার বিষয় কি জানো মাটি ছাড়াও ছাদে বাগান করা যায়। অবিশ্বাস্য হলেও লক্ষ্য করবে মাটি ছাড়া ছাদে থরে থরে শাক-সবজি, ফল ধরে আছে। মাটি না থাকলেও যাবতীয় পুষ্টি পানিতে দিয়ে গাছের শিকড় ভিজিয়ে রাখা হয়। এতে ফলনও ভালো হয়। এই পদ্ধতির নাম হাইড্রোপনিক্স .
মাছ ও সবজি চাষ একসাথে করা হয় এমন প্রযুক্তির নাম অ্যাকুয়াপনিক্স. এখানেও কোনো মাটি ব্যবহার করা হয় না। ড্রামে মাছ উৎপাদনের সময় যে ময়লা পানি তৈরি হয় সেটাকে গাছের খাবার হিসেবে ব্যবহার করা হয়।
ছাদকৃষির অনেক সম্ভাবনা রয়েছে। বাজারের শাক-সবজি, ফলমূলে নানা কীটনাশক ও রাসায়নিক মেশানো থাকে। অনেক সময় টাটকা জিনিস পাওয়া যায় না। কিন্তু ছাদকৃষির মাধ্যমে নিজের বাগান থেকে সরাসরি শাক-সবজি, ফলমূল ও মাছ-মুরগি পাওয়া যায়। এতে সবকিছু টাটকা, রাসায়নিকমুক্ত ও স্বাদের পাওয়া যায়।
অনেকের ছাদবাগানে এতো ফলন হয় যে নিজেরা খেয়ে আত্মীয়-স্বজন ও পাড়া-প্রতিবেশীদেরও দেওয়ার সুযোগ হয়। আর শহর জীবনে একটু গাছগাছালির ছোঁয়া যদি নিজের ছাদেই মেলে তাহলে সেই অনুভূতি বলে বুঝানো যাবে না। বাগান ও চাষাবাদের মধ্যে অন্যরকম তৃপ্তি রয়েছে। প্রশান্তির বাতাসে বুক ভরে শ্বাস নেওয়া যায়।
ছাদবাগানে ঘুরে বেড়াতে ভালোলাগে। তবে এটা গড়ে তুলতে অনেক পরিশ্রম করতে হয়। যারা বাগান গড়া ও পরিচর্চার কাজে সময় দেন তাদের জন্যেও নিদারুণ আনন্দের জায়গা ছাদবাগান। অবসরে যাওয়া চাকরিজীবী ও ঘরের নারীদের জন্য খুবই আনন্দদায়ক কাজ ছাদবাগানে সময় দেওয়া।
আমরা ফুলে ফলে সুশোভিত ছাদবাগান দেখি। কিন্তু নিজেরা করতে গেলে দেখা যাবে ফল হচ্ছে না, ফুল আসছে না, গাছ মরে যাচ্ছে, পোকা-মাকড়ে খেয়ে ফেলছে। বাতাসে হয়তো উল্টে পড়ে গিয়েছে। এজন্য বাগান করার আগে ভালো করে জানতে হবে। বিভিন্ন জনের ছাদবাগান ঘুরে দেখতে হবে। এগুলোর জন্য সরকারি বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থা থেকে ট্রেনিং নেওয়া যেতে পারে। অনেক প্রতিষ্ঠান ছাদবাগান তৈরি ও পরিচর্চার কাজে বাণিজ্যিকভাবে সাহায্য করে। তাদের সহযোগিতা নেওয়া যেতে পারে।
খাবার ছাড়া কিন্তু গাছ বাঁচে না। তাই টবে বা বেডে গাছ লাগানোর আগে বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে মাটি প্রস্তুত করতে হবে। মাটি থেকে যদি গাছ পানি ও খাবার না পায় তাহলে বেড়ে উঠবে না, ফল ধরবে না। আবার গাছের গোড়ায় অতিরিক্ত পানি জমে থাকলে গাছ মরে যাবে।
গাছের জন্য সরাসরি রোদ দরকার। কিন্তু সব গাছের জন্য নয়। কিছু গাছ অন্য গাছের নিচে ভালো জন্মে। রোদ শুধু গাছের পাতায় নয়, গাছের গোড়াতেও দরকার। নতুবা ফাংগাস ও পোকামাকড়ের আক্রমণ হয়। এজন্য গাছের ডালপালা ঝুরে দিতে হয়। আবার কিছু গাছের ডালপালা রাখা দরকার।
কখনো দেখা যায় মৌসুম পরিবর্তন হলে গাছের বৃদ্ধি কমে যায়। এমনকি মারাও যায়। এক বছর ভালো ফলন দিলে পরের বছর আর ফলন পাওয়া যাচ্ছে না। কখনো পুষ্টির অভাব হয়, কখনো জীবাণুর আক্রমণ হয়। এজন্য না জেনে কিছু করা যাবে না।
ছাদকৃষিতে কিছু ঝুঁকি আছে। এগুলো আমলে নিতে হবে। নতুবা দুর্ঘটনা ঘটতে সময় লাগবে না। ভবনের অন্যান্য ফ্লোর যেভাবে মজবুত করে বানানো হয় ছাদ সে তুলনায় মজবুত থাকে না। এজন্য ভবন বানানোর সময় বাগানের উপযোগী করে মজবুত করে ছাদ বানাতে হবে। কিংবা ছাদবাগান করার আগে ইঞ্জিনিয়ারকে দিয়ে যাচাই করে নিতে হবে। ছাদের চারিধারে ভারি ভারি টব বা বেড বানালে ভারসাম্য নষ্ট হতে পারে। এগুলো খেয়াল রাখতে হবে।
ঝড়ের সময় ছাদ থেকে টব, বাঁশ, গাছ বা গাছের ফল যাতে নিচে না পড়ে সে জন্য অবশ্য সজাগ থাকতে হবে। বাংলাদেশে ঝড় বাদল খুবই স্বাভাবিক ঘটনা। এ ছাড়া এডিস মশা স্বচ্ছ পানিতে ডিম পেড়ে ডেঙ্গু জ্বরের বিস্তার ঘটায়। ছাদবাগানে যাতে পানি না জমে এজন্য খুবই খেয়াল রাখতে হবে। ছাদে কিছু কিছু গাছ রাখলে এডিস মশা আসে না। যেমন নিম, তুলসী, বেল ইত্যাদি। এ ছাড়া টব বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে প্রস্তুত করলে পানি জমে থাকার কথা না।
ছাদে মাছ, মুরগি ও গাছপালায় নানা পোকামাকড় ও ভাইরাস আক্রমণ হয়। এগুলো মানব দেহের জন্যেও ক্ষতিকর হতে পারে। এজন্য জৈব নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। ছোটদের নাগাল থেকে বাগান পরিচর্চার বিভিন্ন ধারালো ও ভারি উপকরণ দূরে রাখতে হবে।
পরিবেশ বিপর্যয় কমাতে ছাদবাগান নিশ্চয় ভালো সমাধান। কিন্তু যথেষ্ট নয়। নগর পরিকল্পনাবিদরা শহরে প্রয়োজনীয় জলাধার, গাছপালা ইত্যাদি রাখার জন্য বলেন। কনক্রিটের আড়ালে প্রকৃতির নির্মলতা যেন হারিয়ে না যায়। দূরে পার্কে বেড়ানোর চেয়ে বাড়ির আশপাশ যেন পার্ক বানিয়ে রাখতে পারি। গাছপালার সাথে পাখিদের সম্পর্ক আছে। শহরের ছাদগুলো ভরে উঠুক সবুজ বাগানে। পাখিরা ফিরে আসুক আপন নীড়ে।

SHARE

Leave a Reply