ফুটবলবিশ্বে সর্বকালের সেরা কে এটি নিয়ে বিতর্ক বহু বছরের। পেলে, ডিয়াগো ম্যারাডোনা আর লিওনেল মেসিকে নিয়েই এই বিতর্ক বেশি চলে। কখনো ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদোও জায়গা করে নেন এই বিতর্কে। তবে একটা জায়গায় পেলেকে এগিয়ে রাখতেই হবে- সেটি তার অর্জন। একমাত্র ফুটবলার যিনি তিনটি বিশ^কাপ জিতেছেন। ক্লাবের হয়েও জিতেছেন অনেক শিরোপা। তখনকার সময়ে এত উন্নত ট্রেনিং, কোচিংয়ের ব্যবস্থা ছিল না। ছিল না ইনজুরিতে পড়লে ভালো চিকিৎসার ব্যবস্থা। তারপরও পেলে জাতীয় দল এবং ক্লাবকেও এনে দিয়েছেন একের পর এক শিরোপা।
১৯৪০ সালের ২৩ অক্টোবর ব্রাজিলের ত্রেস কোরাকোয়েস শহরের এক বস্তিতে জন্ম। অভাবের সংসারের চাহিদা মেটাতে লেখাপড়া বাদ দিয়ে যাকে শৈশবেই কাজে নামতে হয়েছে, সেই পেলেই ব্রাজিলকে উপহার দিয়েছেন অনেক স্মরণীয় মুহূর্ত। পুরোনাম ঊফংড়হ অৎধহঃবং উড় ঘধংপরসবহঃড়. (পর্তুগিজ উচ্চারণ এদসোঁ আরাঁচ দু নাসিমেঁতু)। তবে শৈশবেই সে বন্ধুদের কাছে পেলে ডাকনাম পায়।
১৫ বছর বয়সে ব্রাজিলের শীর্ষ ক্লাব সান্তোসে সুযোগ পাওয়ার পরের বছরই জায়গা হয় ক্লাবের মূল দলে। প্রথম মৌসুমেই লিগের সেরা গোলদাতার পুরস্কার ওঠে তার হাতে। পরের বছর সুযোগ হয় ব্রাজিল জাতীয় দলে। চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী আর্জেন্টিনার বিরুদ্ধে অভিষেক ম্যাচে পেলে গোলের দেখাও পান। ওই সময়ে সেটি ছিলো সবচেয়ে কম বয়সে আন্তর্জাতিক ফুটবলে গোল করার বিশ^রেকর্ড। যদিও ব্রাজিল হেরে যায় ম্যাচটি। পরের বছর সান্তোসকে এনে দেন লিগ শিরোপা। ইউরোপের বড় বড় ক্লাবগুলোর নজর পড়ে পেলের ওপর। এক পর্যায়ে সমর্থকদের প্রতিবাদের কারণে ব্রাজিল সরকার পেলেকে জাতীয় সম্পদ ঘোষণা করেন, যাতে তিনি ইউরোপে খেলতে না যান। পেলেও রাষ্ট্রের সেই দাবিকে সম্মান জানিয়ে টানা ১৮ বছর খেলছেন সান্তোসে। জিতেছেন ২৫টি শিরোপা। ১১ বার হয়েছেন মৌসুমের সেরা গোলদাতা। ক্যারিয়ারের শেষ দিকে এসে দুই বছর খেলেছেন যুক্তরাষ্ট্রের ক্লাব নিউ ইয়র্ক কসমসে। সেখানেও জিতেছেন দুটি শিরোপা।
দক্ষিণ আমেরিকা মহাদেশের ক্লাব ফুটবলে সবচেয়ে সম্মানজনক আসর কোপালি বার্তোদোরেস। ১৯৬০ সাল থেকে শুরু হওয়া এই টুর্নামেন্টে সান্তোস শিরোপা জেতে ১৯৬২ আর ১৯৬৩ সালে। পেলে পরবর্তী যুগে শিরোপা পেতে ক্লাবটির আবার সময় লাগে ৫৮ বছর। পরবর্তী শিরোপা তারা পায় ২০১১ সালে।
ইউরোপ আর লাতিন আমেরিকা মহাদেশের সেরা ক্লাবগুলোকে নিয়ে অনুষ্ঠিত ইন্টারকন্টিনেন্টাল কাপও সান্তোস জিতেছে দুবার। দুবারই পেলের সময়ে। ১৯৬২ সালে ফাইনালে তখনকার ইউরোপের সেরা ক্লাব বেনফিকার বিপক্ষে হ্যাটট্রিক করেন পেলে। পরের বছর এসি মিলানকে হারিয়ে শিরোপা এনে দেন সান্তোসকে। ইন্টারকন্টিনেন্টাল কাপের ইতিহাসে একমাত্র খেলোয়াড় হিসেবে হ্যাটট্রিক করার রেকর্ড পেলের। তবে নাম পরিবর্তন করে ক্লাব বিশ্বকাপ হওয়ার পর ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো ২০১৬ সালে হ্যাটট্রিক করেছেন এই আসরে।
জাতীয় দলের হয়ে পেলে প্রথম বিশ^কাপ খেলেন ১৯৫৮ সালের সুইডেন আসরে। মাত্র ১৭ বছর বয়সে ব্রাজিলের মতো দলের হয়ে বিশ্বকাপ খেলা সহজ কথা নয়। ঘরোয়া লিগের দুর্দান্ত পারফরম্যান্সই তরুণ পেলেকে জায়গা দিয়েছে বিশ^কাপে স্কোয়াডে। প্রথম ম্যাচেই সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে তার অ্যাসিস্টে গোল করেন ভাভা। কোয়ার্টার ফাইনালে ওয়েলসের বিরুদ্ধে পেলের একমাত্র গোলে ব্রাজিল সেমিফাইনালে পৌঁছে। এই গোল করে বিশ্বকাপে সর্বকনিষ্ঠ (১৭ বছর ২৩৯ দিন) গোলদাতা হিসেবে রেকর্ড বুকে নাম লেখান পেলে। এরপর সেমিফাইনালে ফ্রান্সের বিপক্ষে হ্যাটট্রিক করে বিশ্বকাপের সর্বকনিষ্ঠ (১৭ বছর ২৪৪ দিন) হ্যাটট্রিককারী হিসেবে নাম লেখান। ফাইনালেও স্বাগতিক সুইডেনের বিপক্ষে দুই গোল করেন। সেই বিশ্বকাপের সিলভার বল ও সিলভার বুট দুটোই জেতেন পেলে। এছাড়া বিশ্বকাপের সেরা উদীয়মান তারকার পুরস্কারও জেতেন এই তরুণ।
চার বছর পর ১৯৬২ সালে চিলিতে যখন আবার বিশ^কাপ খেলতে যান, পেলে তখন ফুটবল বিশে^র সবচেয়ে বড় তারকা। তবে দ্বিতীয় ম্যাচেই ইনজুরিতে পড়ে দেশে ফিরতে হয় তাকে। সেই আসরে ব্রাজিল চ্যাম্পিয়ন হলেও দর্শকরা বঞ্চিত হয়েছেন পেলের খেলা দেখার সৌভাগ্য থেকে।
ইংল্যান্ডে ১৯৬৬ সালের বিশ^কাপে রীতিমতো মহাতারকা হিসেবে খেলতে যান পেলে। এবারও ইনজুরিতে পড়েন পেলে। প্রথম ম্যাচে বুলগেরিয়ার বিপক্ষে মারাত্মক ফাউলের শিকার হয়ে দ্বিতীয় ম্যাচেই মাঠের বাইরে থাকতে হয়। ব্রাজিল হেরে যায় হাঙ্গেরির বিপক্ষে সেই ম্যাচ। তৃতীয় ম্যাচে পর্তুগাল পেলেকে এত ফাউল করেছে যে খেলতেই পারেননি তিনি। আরেকটি হারের ফলে বিশ^কাপের প্রথম রাউন্ড থেকে বিদায় নেয় ব্রাজিল। তবে ১৯৭০-এ মেক্সিকো বিশ^কাপে আগের বারের আক্ষেপ ঘোচান পেলে। ফাইনালে ইতালির বিপক্ষে গোল করে দলকে এনে দেন তৃতীয় বিশ^কাপ। তিনবার জেতার ফলে সেবার স্থায়ীভাবে জুলেরিমে কাপটি নিজেদের করে নেয় ব্রাজিল।
এছাড়া ১৯৫৯ সালের কোপা আমেরিকায় আর্জেন্টিনার কাছে হেরে রানার্সআপ হলেও সেরা গোলদাতা ও সেরা খেলোয়াড়ের দুটো পুরস্কারই জিতেছিলেন পেলে।
কাজেই এতসব অর্জনই তাকে ফুটবলের মহারাজার আসনে বসিয়েছে। কখনো স্ট্রাইকার হিসেবে প্রতিপক্ষের রক্ষণ ভেঙে বল জালে জড়াতেন, কখনো প্লেমেকার হিসেবে দলের খেলা গুছিয়ে নিয়ে গোল করাতেন সতীর্থদের দিয়ে। ৯৫ ম্যাচে ৭৭ গোল করে এখনো ব্রাজিলের পক্ষে সর্বোচ্চ গোলদাতা তিনি। সান্তোসের হয়ে তার ৬৪৩ গোলের রেকর্ড গত ডিসেম্বরে মাত্র ভেঙেছেন লিওনেল মেসি। তবে পেলের ওই গোলগুলোর মধ্যে অনেকগুলো প্রীতিম্যাচের গোল হিসাব করা হয়নি। সেগুলো ধরা হলে এখনো মেসির চেয়ে এগিয়ে থাকতেন তিনি। সব ধরনের খেলা মিলে তার ১২৭৯ গোল এখনো গিনেজ বুকের রেকর্ড।
ফিফা কর্তৃক বিংশ শতাব্দীর সেরা ফুটবলার, টাইম ম্যাগাজিনের শতাব্দীর সেরা একশো প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব, অলিম্পিক কমিটি কর্তৃক শতাব্দীর সেরা ক্রীড়াবিদসহ অসংখ্য সম্মাননা পেয়েছেন এই কিংবদন্তি।