বৃষ্টি হলেই আকাশ থেকে পানি ঝরে, সঙ্গে কখনও কখনও ঝরে পড়তে পারে শিলাও। কিন্তু বৃষ্টির সঙ্গে হীরা পড়ে এমনটা কখনও শোনা যায়নি। আকাশ থেকে হীরা ঝরে পড়ে এটা সত্যি তবে তা পৃথিবীতে নয়। এটি ঘটে সৌরজগতের কয়েকটি গ্রহে। হীরা ওখানকার মহাকাশে বৃষ্টির মতো ঝরতে থাকে! অর্থাৎ, সেখানে হীরার বৃষ্টি হয়! ধারণা করা হয়, কার্বোনাডো হীরা শত শত কোটি বছর আগে একটি বিশেষ গ্রহাণুর বিস্ফোরণে সৃষ্টি হয়েছে।
ইউরেনাস ও নেপচুনে হীরার বৃষ্টি নিয়ে অনেক আগে থেকেই গবেষণা চলছে। জ্যোতির্বিদ ও পদার্থবিদরা প্রায় ৪০ বছর ধরে অনুমান করছেন যে, নেপচুন ও ইউরেনাসে হীরা বৃষ্টি হয়ে থাকে। তবে এখন শনি আর বৃহস্পতি গ্রহেও হীরার বৃষ্টির খোঁজ পাওয়া গেছে। সেখানে বৃষ্টিতে ঝরে পড়ে ডায়মন্ড বা হীরার টুকরো। বিজ্ঞানীরা জানান, বৃষ্টিতে ঝরে পড়া সবচেয়ে বড় হীরার টুকরোটির ব্যাস হতে পারে এক সেন্টিমিটার পর্যন্ত।
লরেন্সের গবেষক মার্ভিন রস ১৯৮১ সালে সর্বপ্রথম ‘হীরাবৃষ্টি’র ধারণাটি প্রকাশ করেন একটি আর্টিকেলের মাধ্যমে। নেপচুন ও ইউরেনাসকে বলা হয় আমাদের সৌরজগতের দৈত্যাকার বরফ।
শনি ও বৃহস্পতি গ্রহের বায়ুমণ্ডল বিশ্লেষণ করে গবেষকরা বলেছেন, সেখানে কার্বনের চকচকে কঠিন রূপ হীরা রয়েছে প্রচুর পরিমাণে। শনি ও বৃহস্পতি গ্রহের বায়ুমণ্ডলে ব্যাপক মাত্রায় বজ্রপাত হয়, ফলে সেখানে থাকা মিথেন গ্যাস কার্বনে রূপান্তরিত হয়। এরপর সেগুলো কার্বনেরই দুটি ভিন্ন রূপ গ্রাফাইট ও ডায়মন্ড-এ রূপ নেয়।
বিজ্ঞানীরা বলছেন, গ্রহ দু’টিতে পাওয়া হীরার টুকরো আংটিতে খুব সহজেই ব্যবহার করা যেতে পারে। তবে তার আগে হীরাগুলোকে কেটে নিতে হবে সুন্দরভাবে। এভাবে প্রতি বছর শনির বুকে প্রায় ১০০০ টন হীরা ঝরে পড়ে।
বেইনেস ও ডেলিৎস্কি গ্রহ দু’টির অভ্যন্তরের তাপমাত্রা ও চাপসংক্রান্ত তথ্য উপাত্ত বিশ্লেষণ করেন এবং এটাও পর্যবেক্ষণ করেন কিভাবে কার্বন ভিন্ন ভিন্ন পরিবেশে ভিন্ন আচরণ করে। এই দুইজন বিজ্ঞানী বলেন, শনির একটি বিরাট অংশ জুড়ে হীরার টুকরো বর্ষিত হয়। আর এগুলো তৈরি হয় শনির বায়ুমণ্ডলের একদম ওপরের অংশে যেখানে ক্রমাগত ঝড় ও বজ্রপাতের ফলে মিথেন গ্যাস কার্বন কণায় রূপ নেয়। আর এই কার্বন কণাগুলো যতই নিচের দিক বরাবর গ্রহগুলোর পৃষ্ঠের দিকে এগিয়ে যেতে থাকে, ততই এদের ওপর চাপ বাড়তে থাকে। ১০০০ মাইল পথ অতিক্রম করায় কার্বন কণাগুলো গ্রাফাইটে ও ৬০০০ কিমি উচ্চতায় নেমে আসার পর গ্রাফাইট কণাগুলো হীরার টুকরোতে রূপান্তরিত হয়।
ইউনিভার্সিটি অব উইসকনসিন-ম্যাডিসনের প্রফেসর এবং নাসার জেট প্রপালসন ল্যাবরেটরির বিশেষজ্ঞ ড. কেভিন বেইন্স বলেন, পরে অবশ্য বৃষ্টি হয়ে হীরাগুলো তীব্র উত্তপ্ত তরল গ্রহের সাগরে পড়ে ধীরে ধীরে গলে যায়। সেখানে বড় আকারের একটি হীরকখণ্ডের ব্যাস এক সেন্টিমিটারের মতো হবে।
হীরক বৃষ্টি নিয়ে শনি এবং বৃহস্পতি গ্রহ গবেষকদের আগ্রহ বেশি। কারণ, সেখানে প্রচুর কার্বন আছে। আর হীরা কার্বনেরই একটি রূপান্তরিত অবস্থা। এ কথা বলেন প্রফেসর রেইমন্ড জিনলজ। ইউরেনাস এবং নেপচুনে হীরা থাকার বিষয়টি যারা উত্থাপন করেন তাদের মধ্যে তিনি অন্যতম।
এবার বলা যাক নেপচুন ও ইউরেনাস গ্রহের কথা। এই গ্রহগুলোর বাইরের স্তর হাইড্রোজেন ও হিলিয়াম দিয়ে গঠিত। পানি, অ্যামোনিয়া এবং মিথেন এসব গ্রহের উপাদান। এই যৌগগুলোর প্রত্যেকটিই হাইড্রোজেনের ধারক যা এই গ্রহগুলোকে বরফপূর্ণ করে তুলতে ভূমিকা রাখে।
ধারণা করা হয়, অভিকর্ষজ ত্বরণ এ বরফকে সঙ্কুচিত করে ঘনত্ব বৃদ্ধি করে এবং অভ্যন্তরীণ তাপমাত্রাও বৃদ্ধি করে থাকে। এ ছাড়া বায়ুমণ্ডলীয় চাপের এক মিলিয়ন গুণ বেশি উচ্চচাপ বরফকে সঙ্কুচিত করে উত্তপ্ত তরলে পরিণত করে। এভাবে এসব গ্রহে মিথেনের কার্বন ও হাইড্রোজেন পরমাণুসমূহ উচ্চচাপ ও তাপমাত্রায় পৃথক হয়ে থাকে। পরবর্তীতে কার্বন পরমাণুসমূহ গুচ্ছ হীরার গঠনে পরিণত হয়, যা কার্বনের সবচেয়ে সুস্থিত গঠন। অনুমান করা হয়, ঘনত্ব বেশি হওয়ায় এসব হীরার খণ্ড গ্যাসের স্তরে নিমজ্জিত হয়ে হীরা বৃষ্টি হয়ে থাকে।
মার্ভিনের ধারণাটি অত্যন্ত চমকপ্রদ হলেও এটি ছিল অনুমান-নির্ভর এবং পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে এর পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা দরকার ছিল। কিন্তু কোনো প্রযুক্তি দিয়ে নেপচুন ও ইউরেনাসের এ দশা পর্যবেক্ষণ প্রায় অসম্ভব ছিল।
বিজ্ঞানীরা চিন্তা করলেন পৃথিবীতে কৃত্রিম পরিবেশ সৃষ্টির মাধ্যমেই তারা তাদের গবেষণা শুরু করবেন। ল্যাবরেটরিতে গ্রহের অভ্যন্তরীণ পরিবেশের অনুরূপ পরিবেশ সৃষ্টি করা হয়। গবেষণাটি করা হয় ক্যালিফোর্নিয়ার ম্যানলো পার্কের স্ল্যাক ন্যাশনাল অ্যাক্সেলেটর ল্যাবরেটরিতে।
লেজার ব্যবহার করে শক ওয়েভ দেওয়ার মাধ্যমে ল্যাবরেটরিতে কৃত্রিমভাবে উচ্চ তাপ ও চাপ সৃষ্টি করা হয়। হাইড্রোকার্বন হিসেবে ব্যবহার করা হয় পলিস্টিরিন। প্রায় ৪,৫৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় এবং পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের ১.৪৮ গুণ মিলিয়ন বেশি চাপে হীরার নিদর্শন পাওয়া যায়।
গবেষকগণ উল্লেখ করেন, এ হীরা স্বচ্ছ ও সুগঠিত স্ফটিক ছিল না এবং তাদের ধারণা নেপচুন ও ইউরেনাসে উৎপাদিত হীরাও এরূপ খাদযুক্ত। তবে তারা এটাও উল্লেখ করেন যে, তাদের ধারণানুযায়ী গ্রহে উৎপাদিত হীরা এর চেয়ে কয়েক লক্ষ গুণ বড় হয়ে থাকে। কারো কারো মতে, গ্রহে এ হীরাখণ্ড বরফের স্তরের সাথে যুক্ত হয়ে আরও পুরু স্তরের সৃষ্টি করে। আবার কারো মতে, উচ্চচাপ ও তাপে এ হীরা গলে যায়। তবে এই হীরা বৃষ্টি নিয়ে আরও ব্যাপক গবেষণার প্রয়োজন আছে বলে বিজ্ঞানীরা মনে করেন।