Home নিবন্ধ ‘সাগর ভাঙার দিন’ এক ভিন্ন মাত্রার কিশোর উপন্যাস -মামুন মাহফুজ

‘সাগর ভাঙার দিন’ এক ভিন্ন মাত্রার কিশোর উপন্যাস -মামুন মাহফুজ

মোশাররফ হোসেন খান (১৯৫৭)। তিনি কবি হিসাবে যেমন মৌলিক শক্তিমান কিংবদন্তি কবি, তেমনি শিশু-কিশোরদের জন্য লেখা গল্প বা উপন্যাসের ক্ষেত্রেও জীবন্ত এক কিংবদন্তি। তার একেকটি উপন্যাসে একেকটি চরিত্র বাস্তব জীবনের প্রতিচ্ছবি হয়ে দাঁড়ায়। যা দেখে যে কারও গায়ের রোম কাঁটা দিয়ে উঠতে পারে। এতোটা জীবন্ত চরিত্র খুব কম কথাসাহিত্যিকের লেখনীতে দেখা যায়। চরিত্র সৃষ্টিতে তার এই দক্ষতা তার জীবনবোধ, দৈনন্দিন জীবনযাপনের প্রতি গভীর নিরীক্ষণের ফলেই তৈরি হয়েছে। বলাই বাহুল্য জীবনের ঘাত-প্রতিঘাতগুলো তিনি যেভাবে মোকাবেলা করেছেন তারই নিদাঘ দাগ কেটে কেটে তৈরি হয়েছে একেকটি চরিত্র।
‘সাগর ভাঙার দিন’ কবির একটি সার্থক ও ব্যতিক্রমী কিশোর কাব্যিক উপন্যাস। আর যেহেতু কিশোর উপন্যাস সেহেতু কৈশোরের মাঝেই সীমাবদ্ধ থেকেছে এর গল্প। এটি পাঁচটি পর্বে বিভাজিত। পর্বগুলোর আলাদা শিরোনামও রয়েছে। যাকে উপ-শিরোনাম বা সাবটাইটেল বলা যায়। ১. বৃষ্টিভেজা পাখির কান্না, ২. ওই যে নদী আমার নদী, ৩. মাঠের পরে মাঠ চলেছে, ৪. আঁধার ফুঁড়ে আলোর গোলক, ৫. এই রাত শেষ হবে। এই মোট পাঁচটি শিরোনামে মালা গেথে তৈরি হয়েছে ‘সাগর ভাঙার দিন’। এই সাগর বঙ্গোপসাগর নয়, আটলান্টিক মহাসাগর বা ভারত মহাসাগর কিংবা ভূমধ্যসাগরও নয়, এই সাগর কষ্টের সাগর। এই সাগর আনোয়ারের ছোট্ট জীবনে নিঃসীম কষ্টের মহাসাগর।
উপন্যাসটি পড়তে পড়তে বারবার চোখ অশ্রুসজল হয়ে ওঠে। আনোয়ার-সানোয়ার দুই ভায়ের কষ্টের সাথে একাকার হয়ে যে কারও হৃদয় ভারাক্রান্ত হয়ে উঠতে পারে অনায়াসে। উপন্যাসের একটি দৃশ্য আমাকে ভীষণভাবে আবেগাপ্লুত করে বারবার। দৃশ্যটি হলো ছোট্ট একটা শিশু খালি পায়ে পাড়ি দেয় মাইলের পর মাইল মেঠোপথ!…কে এই শিশুটি? সে উপন্যাসের নায়ক। কিন্তু সেই শিশুটির মাঝে যদি নিজের সমবয়সী সন্তানের ছবি ভেসে ওঠে? কিংবা নিজের হারানো ছোটবেলার দৃশ্যটি মনে পড়ে? তাহলে সমানুভূতির প্রতিঘাতে নিমিষেই চোখ অশ্রুসজল হয়ে উঠবে এতে কোনও সন্দেহ নেই। শিশুটির বাবা রিটায়ার্ড স্কুল মাস্টার। নৈতিক কারণে তিনি ঘুষ দিতে পারেন না তাই তার পেনশনের টাকাটাও তার পাওয়া হয় না। অথচ পেনশনের স্বপ্ন দেখে দেখে কাটে আনোয়ারের কষ্টের দিনগুলো।…

শুরুতে উপ-শিরোনামে যে গল্পটি রয়েছে; ‘বৃষ্টিভেজা পাখির কান্না’। কষ্টের শুরু এখান থেকেই। একটি পাখির গল্প। যে প্রকৃতির কাছে হেরে গেছে। বৃষ্টিতে আশ্রয়হীন পাখিটির জন্য আনোয়ারের দুঃখবোধ, পাখিটির সাথে আনোয়ারের বন্ধুত্ব, পাখিটির হৃদয়সংবেদন উপলব্ধি এতোটাই নিখুঁতভাবে তুলে ধরেছেন লেখক, যে গল্পের বা সাবপ্লটের শেষে যখন পাখিটি মারা যায় তখন পাঠক হিসেবে নিজেকেও কষ্টের সমুদ্রে আবিষ্কার করতে হয়। বুকের ভেতর চাপা কষ্টটা দীর্ঘশ্বাসে বেরিয়ে এসে বলে ‘পাখিটা কেন মরলো?’
সেই কষ্টে আনোয়ার আর্তনাদ করে উঠলো। আর আনোয়ারের মা ভাবেন ওটা শালিক নয়, তার হারিয়ে যাওয়া ছোট্ট শিশু আইয়ুব হোসেন।
একইভাবে শিশুমন পাখির কথা বা মনের অভিব্যক্তি বুঝতে পারে ‘সাগর ভাঙার দিনে’। এই পর্বে বৃষ্টিতে ভেজা আশ্রয়হীন পাখিটার সঙ্গে নিজের দুঃখ কষ্ট ভাগাভাগি করে আনোয়ার নামের ছোট্ট শিশুটি। পাখির বেদনা অসহায়ত্বকে উপলব্ধি করার চেষ্টা করে নিজের কষ্টের সাথে বসঢ়ধঃযু বা সমানুভূতির মাধ্যমে।

২.
‘সাগর ভাঙার দিন’ উপন্যাসের প্রধান বিষয় দারিদ্র্যপীড়িত পরিবারের দুঃখকষ্ট। আর এই দুঃখের অন্যতম কারণ হিসেবে দেখানো হয়েছে আবহমান বাংলার প্রকৃতিকে। তবে পুরো উপন্যাসে বৃষ্টি বা প্রকৃতির সাথে সাথে আর্থসামাজিক অবক্ষয়ের চিত্রটিও প্রাধান্য পেয়েছে। আনোয়ারদের দারিদ্র্যের অন্যতম কারণ তার বাবার রিটায়ারমেন্ট। কিন্তু যদি সামাজিক ব্যাধি দুর্নীতির কারণে, ঘুষের কারণে রিটায়ার্ড বাবার পেনশন আটকে না থাকতো তাহলে এত সব কষ্ট সইতে হতো না আনোয়ারদের পরিবারকে। একটা সময় ছিল যখন মানুষ নৈতিকবোধের কারণে ঘুষ দেওয়া থেকে বিরত থাকতো। অন্যদিকে মোটা অঙ্কের ঘুষের দাবিতে বছরের পর বছর পেনশন আটকে রাখা হতো। এমন অনেকের জীবনে ঘটেছে যারা জীবদ্দশায় পেনশনের টাকা উত্তোলন করে যেতে পারেননি। ঘুষের কারণে কতো শত পরিবার যে এভাবে ধুকে ধুকে দারিদ্র্যের সাথে লড়াই করে একসময় থমকে দাঁড়িয়েছে তার হিসাব নেই। লেখক কেবল একটি পরিবারের জীবনে ট্র্যাজিক হিস্ট্রি তুলে ধরে তৎকালীন শুধু নয়, চলমান ঘুষপ্রথার নির্মমতাকে তুলে ধরেছেন।

৩.
সাগর ভাঙার দিন উপন্যাসের তৃতীয় পরিচ্ছেদের উপ-শিরোনাম হচ্ছে ‘মাঠের পরে মাঠ চলেছে।’
এখান থেকে চরিত্র হিসেবে খুবই অনালোকিত থাকা ‘বাবা’ চরিত্রটি বিকশিত হতে শুরু করে।
আনোয়ার ও সানোয়ারের বাবা দরাজ গলায় আবৃত্তি করতে পারেন। ‘তার কবিতা আবৃত্তির ঢংটা খুবই চমৎকার।’ এই বর্ণনা লেখকের অন্তর্যামী দৃষ্টিকোণের। আনোয়ার বা সানোয়ার কিন্তু এটা করেনি। বরং তৃতীয় কেউ বলে দিচ্ছে আনোয়ার-সানোয়ারের বাবা আবৃত্তি করতে পারেন। এখানে কবিতাকে ইলিমেন্ট বা উপাদান হিসেবে ব্যবহার করে যশোর অঞ্চলের (লেখকের নিজের এলাকার) ঐতিহ্যকে তুলে আনা হয়েছে। উঠে এসেছে বাংলা কাব্য সাহিত্যে আধুনিকতার প্রবর্তক মাইকেল মধুসূদনের কথা ও কৃতিত্ব। কবিতাটি ঐতিহ্যবাহী কপোতাক্ষকে নিয়ে। লেখকের এই জাতীয়তাবোধের প্রতি শ্রদ্ধা দেখে পাঠক হিসেবে আমার মনে হয়েছে বইটি শিশু-কিশোরদের পাঠ্যবই হিসেবে মর্যাদা পাওয়ার যোগ্য। এই গল্পের মধ্যে অত্যন্ত প্রচ্ছন্নভাবে, পরোক্ষভাবে এমন এমন সব উপদেশ বা শিক্ষণীয় বিষয় রয়েছে যা শিশু-কিশোরদের জীবনের জন্য খুবই উপযোগী।
যেমন ভাইয়ে ভাইয়ে যে অসাধারণ সম্পর্কের চিত্র লেখক তুলে ধরেছেন; এমন দৃশ্য সমবয়সী শিশু-কিশোরদের দারুণভাবে প্রভাবিত করতে সক্ষম। ভাইয়ে ভাইয়ে ঝগড়া নয়, বিবাদ নয়, একে অপরকে ভীষণভাবে মিস করা, ফিল করা, একে অপরের জন্য কষ্ট পাওয়া, অভাব অনুভব করা…সবমিলে অসাধারণ এক সম্পর্ক ঠাঁই পেয়েছে এই উপন্যাসে। আমার তো মনে হয়েছে আমাদের শ্রদ্ধেয় কবির সঙ্গে তার সাবেক সংসদ সদস্য ভাইয়ের এমনই মধুর সম্পর্ক ছিল! যে কারণে এই দু’টি চরিত্রের মধ্যে এমনই ভালোবাসার উষ্ণতা তিনি ফুটিয়ে তুলেছেন; যাতে পাঠকের হৃদয় বারবার অশ্রুকাতর হয়ে পড়তে বাধ্য।

৪.
শিশু-কিশোররা সাধারণত বীরত্বের কাজ খুব পছন্দ করে। এই গল্পের চরিত্রদ্বয়ও তাই বিভিন্ন বীরত্বব্যঞ্জক কাজের মধ্য দিয়ে পাঠককে আকৃষ্ট করে। একটানা বৃষ্টি। ঘর থেকে কেউ বের হচ্ছে না। এদিকে কপোতাক্ষের ওপারে আটকে পড়েছে দু’ভাই। গিয়েছিল এক আত্মীয়বাড়ি দাওয়াত খেতে। এবার নদী কিভাবে পার হবে? নৌকাতো ওই পারে!… বড় ভাই সানোয়ার বলে তুই এই পারে থাক আমি সাঁতরে গিয়ে নৌকা নিয়ে আসি। কিন্তু ছোটভাই বড় ভাইকে কষ্ট করতে দিতে চায় না। বলে,
– না ম্যাভাই (‘মিয়া ভাই’ এর কথ্যরূপ)। তুই এপার থাক। আমি যাই।
– পাগল! তুই না ছোট্ট মানুষ। আমি তো বড়। আমি যাই।
– না ম্যাভাই, আমি যাব। তুই যদি সোতের মদ্যি পানিতে ডুবি যাস!
– আর তুই? তুই তো আমার চেয়েও ছোট। তুই ডুববিনে?

এবার বুঝা গেল নদীটা পার হওয়া সাধারণ কোনও ব্যাপার না! মৃত্যুর ঝুঁকিও আছে! আর তারপর যখন দুই ভাই-ই কেউ কারও বারণ না শুনে নদী সাঁতরে পার হয় তখন কিন্তু গায়ের রোম কাঁটা দিয়ে ‍ওঠে। সারাদিন বৃষ্টি! চারিদিকে মানুষ জন নেই! নীরব সুনসান! আর সেই সময় নদী পার হচ্ছে দুই কিশোর! সাঁতার কেটে!… আসলে তাদেরও হয়তো ভয় হচ্ছিল। কিন্তু একে অপরের প্রতি ভালোবাসার টানে সেই ভয়কে তারা জয় করে ফেলেছে।…
গল্পের ঠিক এই স্থানটিতে এসে আমার ফুপাতো বোনের দুই ছেলের একসাথে পানিতে ডুবে মরার ঘটনাটি মনে পড়ে গেলো। প্রথমে ছোটভাই পুকুরে পড়ে যায়, তাকে বাঁচাতে বড় ভাইও পুকুরে ঝাঁপ দেয়। সেও সাঁতার জানে না। সাত আর দশ বছরের দুই ভাই। এভাবেই পুকুরে ডুবে মারা যায়। সাঁতার না জানা সত্ত্বেও ভাই ভাইকে বাঁচাতে পানিতে ঝাঁপ দেয়। ভালোবাসা এমনই। মৃত্যুর ভয়ও সেখানে মূল্যহীন।…
এখানে সানু নদী পার হতে গিয়ে পেছনে ফিরে দেখে ছোটভাইও নদীতে নেমে গেছে। ভাইকে সে নদীতে একা ছেড়ে দিতে রাজি নয়। যা হোক সানু আর আনু দু’জনেই হাঁপাতে হাঁপাতে নদী পার হয়। তারপর বাড়ি ফেরে।
একটি পরিবারের এরকম মিষ্টি গল্প দিয়েই সাজানো ‘সাগর ভাঙার দিন’ বইটি।
কিন্তু এসব আনন্দের মাঝেও কাঁটা হয়ে বিঁধে থাকে অভাব এবং নিদারুণ দারিদ্র্যের কষাঘাত। তারপরও এই পরিবারটি নৈতিকভাবে ভেঙে পড়ে না, ঘুষ দিয়ে নিজের হকের পেনশনের টাকা তোলার চেষ্টা করে না, অপেক্ষা করে কবে মানুষের বিবেক হবে, কবে মানুষ অন্যায় থেকে রক্ষা পাবে। এমনকি এই পরিবারের দুই কিশোরও অত্যন্ত নৈতিকতাবোধসম্পন্ন। তারা দুরন্ত, তারা সাহসী, তারা একে অপরের প্রতি ভালোবাসায় ভীষণভাবে আবদ্ধ, কিন্তু কিছুতেই মিথ্যে তারা বলে না। এই যে পারিবারিক আদর্শ, নৈতিক ভিত। এতেও প্রমাণিত হয় এই বইটি সত্যিই পাঠ্য তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হওয়ার যোগ্য।

৫.
এই উপন্যাসে সবচেয়ে সফল ও সুন্দর চিত্রায়ন হচ্ছে আনোয়ার ও সানোয়ার দুই ভাইয়ের মধ্যকার সম্পর্ক। আনোয়ার ভাইকে অনেকদিন না দেখে থাকতে পারে না। তাই সে বড়ভাই সানোয়ারের লজিং বাড়িতে যায়। ভাইকে অনেকদিন না দেখে শীত গ্রীষ্মের নানান স্মৃতি মনে করে দশ মাইল পথ হেঁটে সে ভাইয়ের কাছে যায়। যাদের পিঠাপিঠি ভাই আছে তারাই বুঝবে ভাইয়ে ভাইয়ে এই টান মোটেও আরোপিত নয় বরং অতীব বাস্তব। কথায় বলে না, ভাই বড় ধন রক্তের বাঁধন।
দশ মাইল হেঁটে ছোট ভাই গেছে বড় ভাইয়ের কাছে। ভাই তো তাকে পেয়ে বুকে জড়িয়ে ধরেছে। কিন্তু একই সাথে লজিং বাড়িতে ভাইকে সাদর অভ্যর্থনা করতে সে কিছুটা লজ্জাবোধ বা সংকোচও করছে! ভাই যখন বলে কী ব্যাপার! হঠাৎ যে চলে এলি? ভাইয়ের এমন প্রশ্নে আনুর খুব কষ্ট লাগে। তার কান্না পায়।…
এই উপন্যাসের অভাব অনটনের যে দৃশ্যটা আমাকে খুব কষ্ট দিয়েছে, যা আগেও বলেছি, সেই করুণ দৃশ্যটি হলো-
“আনুর পায়ে জুতা নেই। খালি পায়ে সে এসেছে। সানুর আছে মাত্র এক জোড়া স্পঞ্জের স্যান্ডেল। স্যান্ডেল জোড়াটি সে হাতে করে নিলো।”
কী এক সহানুভূতি!…ছোটভাইয়ের খালি পা বলে বড় ভাইও জুতা পায়ে না দিয়ে তা হাতে নিয়ে নিলো!… লেখকের ভ্রাতৃত্ববোধের ছোট ছোট এই বর্ণনাগুলো গল্পের করুণ রসকে এতোটাই বাড়িয়ে তোলে যে পাঠক বারবার অশ্রুসজল হয়ে উঠতে পারে। আমি কখনও নিজেকে সেই খালি পায়ে দেখতে পাই, কখনও আমার ছেলেকে দেখতে পাই খালি পায়ে। আমি কিছুতেই দৃশ্যটা সহ্য করতে পারি না। বারবার ভাবনায় পড়ে যাই। আনুর কষ্ট যেন আমাদেরই কষ্ট। আমার ছেলেটাই আনু। তার দরিদ্র বাবার সামর্থ্য নেই ছেলেকে জুতা কিনে দেওয়ার!…

৬.
এতসব কষ্ট কি সারাজীবন বয়ে চলবে এরা? না, লেখক শেষ পরিচ্ছেদটির শিরোনামেই বলেছেন ‘এই রাত শেষ হবে’। এই অভাব শেষ হবে। কিন্তু পরিচ্ছেদটির শুরুই হলো হতাশা দিয়ে। হয়তো হতাশাকে স্থায়ীভাবে ঝেড়ে ফেলার জন্যই এক এক করে একত্রিত করা।
“অনেক চেষ্টার পরও আব্বা তার পেনশনের টাকাটা পেলেন না। তারা ঘুষ চায়। আব্বা কিছুতেই ঘুষ দেবেন না। অফিসের এক কেরানি আব্বাকে আশ্বাস দিয়েছিল, সামান্য কিছু টাকা দিলে সে যাবতীয় কাজ করে দেবে। আব্বা তাতেও রাজি হননি।”
গল্পের মূল মেসেজটা এখানেই। গল্পের মূল ফ্যাক্টর এটাই। ঘুষ দানবের হাতে কিভাবে একটি পরিবার ধীরে ধীরে নিস্তেজ হয়ে পড়েছে, অসহায় হয়ে পড়েছে, তারই চিত্র এটা। একই সাথে অভাবের সাথে এতো লড়াই করেও শেষমেশ অন্যায়ের কাছে মাথানত করেননি, নৈতিকতাকে বিলিয়ে দেননি আনু-সানুর বাবা। ন্যায়ের পথে অটল থেকেছেন। একজন শিক্ষক তার মহান পেশাকে কলঙ্কিত করেননি। নিজের চরিত্রকে কলুষিত করেননি। এমনকি আনুর মাও ঘুষ দিয়ে পেনশনের টাকা তোলার পক্ষে নন। অথচ তিনি ঝড় বাদলে ভাঙা ঘর নিয়ে লড়াই করতে করতে ক্লান্ত।
হঠাৎ কোনও নাটকীয়তা দিয়ে শেষ হয় না উপন্যাসের। শেষ হয় না আনুদের অভাব। কিন্তু তাদের চোখে অবারিত স্বপ্ন। এই অভাবের দিন একদিন শেষ হবে। কিন্তু আদৌ শেষ হলো কি না, কবে শেষ হলো, তা জানা যায়নি। জীবনের পূর্ণতা, ঘটনা বা উপন্যাসের পরিসমাপ্তি না টেনে তিনি পাঠককে ঠেলে দিয়েছেন স্বপ্নের দিকে। কাহিনীর সমাপ্তিটা নিজেদের মতো করে ভেবে নিতে পারেন পাঠক। হয়তো এমনটিই হবে…

“এই রাত শেষ হবে থেমে যাবে ঝড়
মেঘ ফুঁড়ে উড়ে যাবে বেদনার খড়।
সাহসী জোয়ার এলে ভরে যাবে কূল
নবীন তারার চোখে সাতরঙা ফুল।

পাথরে পারদ জ্বলে, জলে ভাঙে ঢেউ
ভাঙতে ভাঙতে জানি গড়ে যাবে কেউ।”

মূলকথা, আশা জাগানিয়া স্বপ্ন দিয়েই এই অসাধারণ কাব্যিক উপন্যাস- ‘সাগর ভাঙার দিন’-এর সমাপ্তি।
উপন্যাসটি শেষ হলেও আশা ও স্বপ্ন বিরাজমান। এখানেই উপন্যাসটির সফল সার্থকতা।

SHARE

Leave a Reply