Home গল্প একগুচ্ছ মালা -নুর আঙ্গেজ

একগুচ্ছ মালা -নুর আঙ্গেজ

গাড়ি ছুটে চলেছে তার গতিতে। এক এক করে পেরিয়ে যাচ্ছে শহরের কোলাহল, দোকানপাট, চলন্ত মানুষ, রিকশা, আরও কতো রকমের যানবাহন। জানালার বন্ধ কপাটের বাইরে এইসব কিছুই সামনে আসছে। আবার মিলিয়েও যাচ্ছে। আদিয়ান খুব যে একটা এইসব উপভোগ করছে তাও নয়। মন খারাপের ভাবটা এখনো যেন আরও কাটতে চাইছে না। একটা শূন্যতা নিজের ভেতর রয়ে যায়। আমাইরা সদ্য শেখা রাইমস এক মনে আওড়ে চলেছে।
টুইঙ্কল টুইঙ্কল লিটিল স্টার—
আবার কখনো পুতুল নিয়ে ব্যস্ত। গাড়িটা এইমাত্র কর্ণফুলী ব্রিজে উঠলো। আদিয়ানের ভাবনা যেন তার সঙ্গই ছাড়ে না। কোথায় ঠিক করা ছিল একজাম শেষে বন্ধুরা সবাই মিলে পিকনিকে যাবে। খুব মজা হবে। হৈহুল্লোড় হবে। শাসনের বাইরে নিজেকে স্বাধীন স্বাধীন মনে হবে। আদিয়ান কি আর ছোটটি আছে যে নিজের প্রতি খেয়াল রাখতে পারবে না। মা-কে ইচ্ছের কথাটা বলতেই অমনি মা বললো।
বন্ধুরা আছে একসাথে গল্প করো। আনন্দ করো, বুকস্টাডি করো। তাই বলে এতোদূর পিকনিকে যাওয়া! আমি তোমাকে এইভাবে একা ছাড়বো না।
একা কোথায় মা। বন্ধুরা সবাই তো আছে।
হ্যাঁ সবাই আছে তা মানি। তুমি এখন বড় হয়েছো। বন্ধুদের সঙ্গই তো এখন তোমার মন টানবে। এটাই স্বাভাবিক। আমি বলি কী আদিয়ান।
ওয়াজিহা খানম কাছে এসে ছেলের মুখটা দু’হাতে তুলে ধরে।
আমিও তো সেই কবে থেকে প্ল্যান করে রেখেছি। এবার তোমার একজাম শেষে আমরা সাগর দেখবো। ইনানী বিচে বসে প্রচণ্ড হাওয়ায় সমুদ্রের ঢেউ দেখবো। এই বদ্ধ ঘরে আমিও তো অস্থির হই। আমারও তো ইচ্ছে হয় কোথাও ঘুরে আসি। সংসার থেকে ছুটি নিয়ে। একজাম শেষে তোমাদের যেমন ছুটি থাকে।
মা এমনভাবে বললো। তাইতো বন্ধুদের মানাই করে দিলো আদিয়ান। এখন অবশ্য মন খারাপের ভাবটা তেমন আর নেই। মা কেমন খুশি হয়ে চারিদিক দেখছে। মাঝে মাঝে বাবার সাথে টুকটাক কথা। সঙ্গে আনা চিকেনরোল খাওয়ার পর বাবা এখন চা-তে চুমুক দিচ্ছে। আমাইরা তার ছোট্ট কামড় বসিয়েছে আপেলে।
নির্ধারিত হোটেলে আগে থাকতেই বুকিং থাকায় কোন ঝামেলাই পোহাতে হয়নি আদিয়ানদের। রুমে এসে লম্বা জার্নির ক্লান্তির ভাবটা জানান দিচ্ছে। মা একে একে সকালের কাপড় বের করে রাখছে খাটে, সোফায়। বাবা ওয়াশ রুমে গোসলে। আদিয়ান ভাবলো ফোন করে বন্ধুদের একবার খবর নিলে কেমন হয়। নাম্বার বের করে তুরাবকে ফোন দিতেই ওপাশ থেকে বলে ওঠে।
কিরে খোকাবাবু এখনো মায়ের খোকা হয়ে রইলি। মায়ের আঁচল ছাড়তে পারলি না। তুই আর কবে বড় হবি।
তুরাব যেন কাঁটা ঘায়ে নুনের ছিটা দিলো। এমনিতেই মায়ের সাথে এখানে এলেও মনতো বন্ধুদের মাঝেই পড়ে ছিল।
আদিয়ান কথাটাকে আমলেই আনলো না। জানতে চাইলো।
তোরা কী করছিস রে এখন?
এইতো ব্রেকফাস্ট শেষ করে রান্নার তোড়জোড় চলছে।
এই শুননা কাব্য কী বলেছে জানিস?
কেন কাব্য আবার নতুন কী ভাবলো। বড়লোক বাবার বিজনেসের একমাত্র উত্তরাধিকারী। কতো রকম ভাবনা ওর ভেতর উদয় হয়।
পুষে রাখা ক্ষোভটা তুরাবের ওপর ঝাড়লো আদিয়ান। আদিয়ানকে বলে কিনা কাব্য।
কতোদিন আর মান্ধাতা আমলের স্মার্টফোন ব্যবহার করবি? কী করে যে এই একই ফোনে এতোদিন পড়ে আছিস। তোর বাবাকে বলনা আইফোন কিনে দিতে।
কিরে চুপ হয়ে গেলি। জানতে চাইলি না প্ল্যানটা কী?
হুম বল্ আবার নতুন কী অ্যাড করলি। আদিয়ান জানতে চায়।
বন্ধুরা সবাই মিলে আজ সিগারেটের ধোঁয়ায় কুণ্ডলী উড়াবো। জীবন শুরুর প্রথম নেশা। কী চার্মিং তাই না।
কথাটা কানে যেতেই স্তব্ধ হয়ে যায় আদিয়ান। বড়লোক ছেলের ইচ্ছেগুলোয় যেন জীবনের বাঁক ঘুরিয়ে দেওয়া জীবন। নিজেদের বখে যাওয়ার সাথে সাথে অন্যদের ও দখল করে নেয়।
একবার যারা এইপথে যায়। তারা কি সহজে ফিরতে পারে? মুহূর্তে মন খারাপটা কর্পূরের মতো উড়ে যায়।
শীতের দিনে দুপুর না গড়াতেই বিকেল হাজির। এই প্রথম কক্সবাজার এসে সমুদ্র দেখা। আজ সেই কাক্সিক্ষত সমুদ্র ছুঁয়ে দেখবে। হাঁটু ভিজিয়ে পানিতে হাঁটবে। এসব ভাবনাতেই কখন গাড়ি এসে থামলো কক্সবাজার বিচে।
কতো কতো দেশ থেকে কতো রকমের মানুষে ভরপুর বিচ। দু’পাশে গাছের সারির মাঝ রাস্তা দিয়ে আসার অনুভূতিই অন্য রকম। রাশি রাশি বালির স্তূপ পেরিয়ে সমুদ্রের কাছে আসা। আমাইরার হাত ধরে ভিজে বালিতে মা হাঁটছে। পাশাপাশি বাবাও। খানিকটা সময়ের পর বাবা মা বিচে পেতে দেওয়া আরাম চেয়ারে বসে। আমাইরা চিপস চিবুচ্ছে আপন খেয়ালে।
মা ঐ দেখো ঘোড়া। কতো মানুষ ঘোড়ায় চড়ছে। আদিয়ান বলে ওঠে।
হ্যাঁ মানুষকে ঘোড়ায় চড়িয়ে টাকা নেয়। এটা ওদের জীবিকা। মানুষ কতো রকমভাবে তার সংসার ধরে রাখে। তুমি চোখ রাখলেই দেখতে পাবে তোমার চাইতেও ছোট বয়সের ছেলে মেয়ে তাদের বয়ে আনা পটেটো চিপস, বাদাম, ঘরে বানানো পিঠা মানুষের কাছে বেচার জন্য কতো অনুনয় বিনয় করে। কেবলমাত্র বাবা মাকে সাহায্য করার জন্য। এদের আর তোমাদের বেড়ে ওঠায় কতো পার্থক্য তাই না আদিয়ান?
মুহূর্তে ভাবনায় আবার কাব্য এসে সামনে দাঁড়ায়।
সেদিন সব বন্ধুদের সাথে হেসে হেসে কথা বলছিল।
আজ আমি কাজের ছেলেটাকে জোরে এক লাথি বসিয়েছি। আমার পায়ে যখন মোজা পরাচ্ছিলো তখনও জুতো জোড়া মুছা হয়নি। ছোটলোকের বাচ্চা।
একই রক্তে গড়া মানুষে মানুষে কতো তফাত হয়। আজ মায়ের সাথে এখানে না এলে অজানাই থেকে যেতো।
মা এবার আমি সাগরে হেঁটে আসি। বেশি দূর যাবো না।
মায়ের অনুমতির অপেক্ষা না করে একটু জোরেই পা চালায়। সূর্য তখন অনেকটা পশ্চিমে। হাঁটু পানিতে নেমে আপন মনে হাঁটছে। দূর থেকে মস্ত বড় ঢেউগুলো তীরে এসে ছোট হয়ে আদিয়ানকে ভিজিয়ে দিলো। খুশিতে আধখানা আদিয়ান দেখে। ছোট ছোট ডিঙি নৌকায় কতো মানুষ ঢেউকে উপেক্ষা করে কিছু দূর গিয়ে ঘুরে আসছে। আদিয়ান যখন তার দেখায় মগ্ন ছিল ঠিক তখনি তার চাইতে ছোট বয়সের মেয়েটি বললো।
ভাইয়া মালা নিবে। খুব সুন্দর মালা।
চকিতে ফিরে চায় আদিয়ান। এক হাতে ঝুলানো অনেকগুলো মালা। অন্য হাতটি আছে কিন্তু সেই হাতের কব্জিই নেই।
আচ্ছা এও কি জীবিকার সন্ধানে এই পথে? এই বয়সে তো পড়ালেখায় ডুবে থাকার কথা। পার্থক্যটা যেন আজ পীড়া দেয় আদিয়ানকে।
পৃথিবীর সব মা-ই তো সন্তানকে আদরে বড় করতে চায়। কেন অসহায় হতে হয় সেইসব সন্তানকে। গরিব বলে? কাব্যের কথায় মাকে যখন আইফোনের কথা বলেছিল। মা খুব করে বুঝিয়েছিল। কখনো লোভ করবে না। লোভ মানুষকে ধ্বংসের পথে টেনে নামায়। যখন বড় হবে তখন নিজেই নিজের শখ মিটিয়ে নিও। প্রয়োজন মিটানোর জন্য ফোন আছেই।
আর সামনে দাঁড়ানো মেয়েটির হাতের কব্জিই নেই।
করুণা নয়। মালার উপযুক্ত দাম দিয়ে মাকে বলবে সবকটা মালা কিনে নাও মা।
হাত বাড়িয়ে মালাসহ হাতটি ধরে আদিয়ান।
এসো আমার সাথে।

SHARE

Leave a Reply