Home স্মরণ প্রিয় কবি আল মাহমুদ -জাকির আবু জাফর

প্রিয় কবি আল মাহমুদ -জাকির আবু জাফর

একজন কবি যখন গ্রামে বেড়ে ওঠেন গ্রামের গন্ধ তার লেখায় জেগে থাকে। তার লেখা নাড়া দিলে বের হবে ফুলের সুবাস। ঝরবে পাতার রঙ। ভেসে উঠবে মাটির ঘ্রাণ। তার কবিতায় কখনো চাঁদের মুখ। কখনো জোছনা। কখনো অন্ধকার। কখনো থাকবে ধানের দুলুনি। তার কবিতায় জাগ্রত থাকবে গ্রামীণ নিসর্গ। আল মাহমুদ তেমনই একজন কবি। যিনি একেবারে গ্রাম ছুঁয়ে বেড়ে ওঠা একজন। যিনি গ্রামের আবহমান সৌন্দর্যের রূপকথার!
কাঁঠাল চাঁপা ফুলের কথা মনে পড়ে! মনে পড়ে তার মুগ্ধ গন্ধের কথা। কী সুন্দর রঙ তার! কী চমৎকার তার পাপড়ি! কী মনজুড়ানো ঘ্রাণ! আহা! দেখতে যেমন শুঁকতেও তেমন। তেমনি তার সৌরভ। বাংলাদেশের বন বাদাড়ে এ ফুলের দেখা মেলে। দেখি আমরা। চিনিও সকলেই প্রায়। চিনলে কি হবে। তার কথা বলতেও তো হয়! কিন্তু শুধু বললেই কি হয়। না। যেনতেন করে বললেই হয় না। তবে? তবে আর কি অন্যরকম করে বলার মজাটি তো অন্যরকম হবেই। আর সেটি যদি কোনো কবি বলেন? তাহলে তো আরও অন্যরকম হবে। তেমন অন্যরকম করেই বলেছেন আমাদের প্রিয় কবি আল মাহমুদ। কী যে মজা করে বলেছেন তিনি! যেমন তার ভাষা। তেমন তার শব্দ। তেমনই তার ছন্দ। মন দুলে ওঠে। হৃদয় ভরে ওঠে। ভরে ওঠে বুকের ভেতরটি। একবার পাঠ করা যাক তবে-
আম্মা বলেন পড়রে সোনা
আব্বা বলেন মন দে
পাঠে আমার মন বসে না
কাঁঠাল চাঁপার গন্ধে।

কেমন মজার কবিতা গো! কেমন মিলঝিল। কেমন দোল দেওয়া ছন্দের ঢেউ। কাঁঠাল চাঁপার গন্ধে মন বসে না লেখাপড়ায়! কী অবাক কথা! কী অদ্ভুত কথা! কী মিষ্টি কথা রে! এ যে গ্রাম বাংলার চির বহমান এক চিত্র।
গ্রামে যাদের জন্ম। এবং যারা গ্রামে বড় হয়েছেন তারা জানেন কাঁঠাল চাঁপার ঘ্রাণের খবর। কিভাবে ফোটে ফুলটি। জানেন কেমন তার ঘ্রাণ। সত্যি এক অন্যরকম অনুভূতির খবর এটি।
টিনের ঘর। বাঁশের বেড়া। বাঁশের বেড়া মানে ফাঁকফোকর থাকেই। থাকবেই। ঝিরিঝিরি বাতাস যখন কাঁঠাল চাঁপার গন্ধ নিয়ে ছুটে যায়। বাঁশের বেড়ার ফোকর গলে গন্ধ ঢুকে পড়ে পড়ার টেবিলে। এমন চমৎকার গন্ধ যখন নাকে লাগে, পড়ায় মন কি থাকে! থাকে না। থাকে না বলেই ফুলের গন্ধে মন হয়ে ওঠে ব্যাকুল।
ফুলের গন্ধে পাঠে মন বসে না যখন তখন কি ইচ্ছে করে! সেটি আমরা শুনি কবি আল মাহমুদের ভাষায়-
আমার কেবল ইচ্ছে করে
নদীর ধারে থাকতে
বকুল ডালে লুকিয়ে থেকে
পাখির মতো ডাকতে।

কি মজা করেই না বললেন কবি। নদীর আকাশ আহা কি বিশাল! কি উদার! কি মায়াবী! সে আকাশের নিচে নদীর কূলে থাকার আনন্দ কি মজার যে একবার নিজেকে হাজির করেছে সেখানে সে বোঝে। আবার বকুল ডালে লুকিয়ে থাকার কাহিনীও অন্যরকম আনন্দের।

এরপর কবির কবিতাটিতে আরও আনন্দের কথা আছে। তিনি লিখেছেন-
সবাই যখন ঘুমিয়ে পড়ে
কর্ণফুলীর কূলটায়
দুধ ভরা ওই চাঁদের বাটি
ফেরেশতারা উল্টায়!

এ এক অদ্ভুত উপমা টেনেছেন তিনি। চাঁদকে বলেছেন দুধভরা বাটি। এবং সে বাটি ফেরেশতারা উল্টায়। গোটা বাংলা কবিতায় এমন উপমা ছিল না। নেই। এখানে আল মাহমুদ একদম আলাদা একজন। একেবারে নতুন উপমার রাজা।

তার আরেকটি কিশোর কবিতার কথা বলা যাক-
নারকেলের ঐ লম্বা মাথায়
হঠাৎ দেখি কাল
ডাবের মতো চাঁদ উঠেছে
ঠাণ্ডা ও গোলগাল।

এখানে তিনি বলেছেন চাঁদটি ডাবের মতো গোলগাল এবং ঠাণ্ডা। এ যে ডাবের মতো চাঁদটি ঝুলে থাকে আকাশে। একেও অদ্ভুত উপমা বলা যায়। এমন উপমাও নেই আগের বাংলা কবিতায়।

অন্য একটি কবিতায় চাঁদকে বলেছেন-
মস্ত নীলের তস্তরিতে
সি মোরগের আণ্ডা।

চাঁদ যখন সি মোগের আণ্ডা অর্থাৎ সি মোরগের ডিম হয় তাকে অবাক উপমা কেন বলা হবে না!
কিশোর কবিতায় আল মাহমুদ এক অনন্য নাম। এক অসাধারণ কবিতার স্রষ্টা তিনি। তার কিশোর কবিতায় কিশোর মনের ভাবনা এবং স্বপ্ন উপচে পড়া। একেবারে টইটই, ভরপুর! একেবারে অন্যরকম করে লেখার ক্ষমতা আল মাহমুদকে সবার চেয়ে আলাদা করে দিয়েছে।

তার একটি কবিতার শিরোনাম অংক নিয়ে। এ কবিতায় তিনি লিখেছেন-
আব্বা হলেন কাকতাড়ুয়া
আম্মা হলুদ পাখি
বুবুরা সব ভুঁই কুমড়ো
পাতায় ঢেকে রাখি।
সবাই যখন বদলে গেছে
নিজের ঘরে নাই
আমি তখন ইচ্ছে মতোন
খোকন থেকে যাই।

এই যে বর্ণনা এই যে উপস্থাপনা ভাবলে বিস্ময় জাগে বৈকি!

তার আরেকটি কবিতার নাম- রসায়নের রান্না। এ কবিতায় গোটা বিশ্বের প্রাকৃতিক পরিবেশ নিয়ে বলেছেন। বলেছেন নান্দনিক শব্দ ছন্দ ও অন্তমিলে। পড়ে দেখা যাক-
গ্লোবের পেটে কান লাগিয়ে
খোকন শোনে কান্না
বিশ্ব গোলক ফুঁপিয়ে ওঠে
আর পারি না আর না।
মানুষ নামের বিজ্ঞানীরা
আমায় নিয়ে খেলছে
আমার সাগর পাহাড় নদী
রোলার দিয়ে বেলছে।

এ কবিতায় তিনি যে চিত্রকল্প এঁকেছেন তার তুলনা হয় না। আমার সাগর পাহাড় নদী রোলার দিয়ে বেলছে, বিস্ময়কর! বিস্ময়কর!

আল মাহমুদের নোলক কবিতাটির কথা তো সবারই জানা।
আমার মায়ের সোনার নোলক
হারিয়ে গেলো শেষে
হেথায় খুঁজি হোথায় খুঁজি
সারা বাংলাদেশে।
নদীর কাছে গিয়েছিলাম
আছে তোমার কাছে?
হাত দিও না আমার শরীর
ভরা বোয়াল মাছে।

আহা কি চমৎকার একটি কবিতা। কি অসাধারণ সুন্দর তার চিত্রকল্প। কি যে পরিষ্কার তার বাণী। হাত দিও না আমার শরীর ভরা বোয়াল মাছে এ কথা খুব ছোট কথা নয়। এ বাণী কোনো সাধারণ বাণী নয়। এটি বাংলাদেশের ভেতরের চিত্র।
আল মাহমুদ দেশকে ভালোবাসতেন খুব। হৃদয় দিয়ে ভালোবাসতেন। দেশের জন্য তার ছিল অন্যরকম অনুভূতি। সে অনুভূতির প্রকাশ ছিল দেশ নিয়ে নানান কবিতায়! নোলক তারই একটি অন্যতম কবিতা। এ কবিতার শেষ দুটি লাইনে তিনি দেশের প্রতি অঙ্গীকার করেছেন। বলেছেন-
এলিয়ে খোঁপা রাত্রি এলেন ফের বাড়ালাম পা
আমার মায়ের গয়না ছাড়া ঘরকে যাবো না।

মায়ের গয়না ছাড়া ঘরে না ফেরার শপথ নিলেন তিনি। এটি গুরুত্বপূর্ণ খুব।

আল মাহমুদ জন্ম নিয়েছেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগর থানায়। ১৯৩৬ সালের ১১ জুলাই ছিল তারিখটি। লেখালেখি শুরু হয় কিশোরকাল থেকেই। ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনের তুমুল সময়ে চলে আসেন ঢাকায়। ঢাকাতেই তার সবকিছু। কবিতা, ছড়া, গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ, নিবন্ধ, কলামসহ সাহিত্যের বিভিন্ন বিষয়ে লিখেছেন তিনি। সব বিষয়ে প্রকাশিত বই সংখ্যা একশ’র বেশি।
তিনি আমাদের প্রিয় কবি। তার কবিতা আমাদের বাংলাদেশের মাটি ও মানুষের কথা বলে। তার সাহিত্য বিশ্বাসের কথা বলে। ২০১৯ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি পৃথিবী থেকে বিদায় নিলেন তিনি।
আল মাহমুদকে জানতে হবে আমাদের। জানতে হলে পড়তে হবে তার রচনা। তার কবিতা পাঠ করতে হবে। করতে হবে গভীরভাবে। তিনি যা লিখেছেন তার ভেতর তাকে আবিষ্কার করা যাবে। একজন লেখক তার লেখায় বেঁচে থাকেন। একজন কবি বেঁচে থাকেন তার কবিতায়। কবিতার ভেতর দিয়ে তিনি ভবিষ্যতের মানুষের কাছে পৌঁছে যান।
আল মাহমুদও বেঁচে থাকবেন তার লেখায়। তার কবিতায়। তার রচনায়। সময় যতো যাবে আল মাহমুদ ততোই উজ্জ্বল হয়ে উঠবেন।

SHARE

Leave a Reply