Home বিজ্ঞান ও বিশ্ব হারিয়ে যাওয়া মূল্যবান আবিষ্কার -তারিক মাহমুদ

হারিয়ে যাওয়া মূল্যবান আবিষ্কার -তারিক মাহমুদ

সেই প্রাচীনকাল থেকেই মানুষ আবিষ্কার করেছে অনেক কিছু। প্রাচীনকালের বহু আবিষ্কার দিনে দিনে উন্নত হয়ে আজও পৃথিবীতে ব্যবহৃত হচ্ছে। আবার এমন কিছু আবিষ্কার রয়েছে যা এক সময় ব্যবহৃত হতো কিন্তু ধীরে ধীরে তা কালের গহ্বরে হারিয়ে গিয়েছে। সেসব হারিয়ে যাওয়া আবিষ্কারের মধ্যে এমন কিছু আবিষ্কার রয়েছে যা বর্তমান বিশ্বের উন্নত প্রযুক্তির মাধ্যমেও বিজ্ঞানীরা এখনো তৈরি করতে পারেননি।

নমনীয় কাচ
ইতিহাসে তিনটি স্থানে রহস্যময় একটি বস্তুর উল্লেখ পাওয়া যায়। বস্তুটির নাম হলো ‘ারঃৎঁস ভষবীরষব’, যার অর্থ হলো ‘নমনীয় কাচ’। সর্বপ্রথম এর অস্তিত্ব পাওয়া যায় ৬৩ খ্রিষ্টাব্দের রোমান রাজসভাসদ পেট্রোনিয়াসের বক্তব্যে।
তার লেখায় তিনি এক কাচের সামগ্রী প্রস্তুতকারীর কথা উল্লেখ করেন, যিনি সম্রাট টিবেরিয়াসের দরবারে একটি কাচের পাত্র নিয়ে আসেন। পাত্রটি রাজাকে উপহার দেওয়ার কিছুক্ষণ পর তিনি সেটি আবার তাকে ফেরত দিতে বলেন। রাজা কাচের পাত্রটি তাকে ফেরত দিলে তিনি সেটি নিয়ে মাটিতে আছাড় মারেন। কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার হলো, কাচের পাত্রটি ভেঙে না গিয়ে একটু বেঁকে যায়। তিনি তৎক্ষণাৎ সেটি আবার পিটিয়ে সমান করে দেন।
এই ঘটনা দেখে রাজা টিবেরিয়াস অবাক হয়ে যান। এমন জিনিসের প্রচলন ঘটলে মূল্যবান ধাতুগুলোর মূল্য হ্রাস পাবে ভেবে তিনি সেই আবিষ্কারককে শিরñেদ করার আদেশ দেন। ফলে সেই আবিষ্কারকের সাথে তার নমনীয় কাচ তৈরির প্রণালীটিও হারিয়ে যায়।
রোমান লেখক প্লিনি দি এল্ডারও এই গল্পটি উল্লেখ করেন। বর্তমানে অবশ্য ২০১২ সালে ‘কর্নিং’ নামে একটি কাচ প্রস্তুতকারী কোম্পানি ‘উইলোগ্লাস’ নামের নমনীয় এক ধরনের কাচ উদ্ভাবন করেছে, যা তাপ প্রতিরোধক ও নমনীয়। সৌর বিদ্যুতের প্যানেলগুলো তৈরিতে এটি ব্যবহৃত হয়। তবে সেই রোমান আবিষ্কারক কয়েক হাজার বছর আগেই এটি আবিষ্কার করেছিলেন।

গ্রিক ফায়ার
সপ্তম থেকে দ্বাদশ শতাব্দীর কথা। সে সময় বাইজেন্টাইনদের ছিল এক অদ্ভুত প্রাণঘাতী অস্ত্র। নাম গ্রিক ফায়ার। গ্রিক ফায়ার হলো নানা রাসায়নিক মিশ্রিত এমন একটি তরল যা কি না যেকোনো বস্তুর ওপর পড়লেই তাতে আগুন ধরে যেত। তবে যে বৈশিষ্ট্যটি একে সবার থেকে আলাদা করেছিল তা হলো, এটি পানিতে পড়লে পানির উপরেও এটি জ্বলতে থাকতো। এই কারণে বাইজেন্টাইনরা সামুদ্রিক যুদ্ধগুলোতে এটি ব্যবহার করতো।
একটি বিশেষ কামান বা পিচকারীর সাহায্যে এটি শত্রু বাহিনীর নৌবহরের ওপর ছুঁড়ে দেওয়া হতো। ফলে মুহূর্তেই আগুন ধরে যেতো শত্রু নৌবহরে। এটি এমনই মারাত্মক ছিল যে, কোনোভাবেই এটি নিভানো সম্ভব হতো না। কেবলমাত্র সিরকা, বালি ও মূত্র দিয়ে এই আগুন নিভানো যেতো, কিন্তু আগুন নিভানোর মতো বিশাল পরিমাণে এসব জিনিস পাওয়া যেত না তখন।
সে সময় গ্রিক ফায়ার ছিল এক আতঙ্কের নাম। আর এই গ্রিক ফায়ারের প্রস্তুতপ্রণালীও ছিল গোপন। বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্য এটিকে সামরিকভাবে কঠিন গোপনীয়তার মধ্যে প্রস্তুত করতো। হাতেগোনা অল্প কয়েকজন শুধু এটির প্রস্তুতপ্রণালী জানতো। এ ছাড়া এটি অনেকগুলো ধাপের মাধ্যমে প্রস্তুত করতে হতো। ফলে যারা এটি প্রস্তুত করতে জানতো তারা যখন মারা যায় তখন তাদের সাথে সাথে গ্রিক ফায়ারের প্রস্তুতপ্রণালীটিও হারিয়ে যায়।
পরবর্তীতে বহুবার এটি তৈরি করার চেষ্টা করা হয়েছে। তবে কেউই এটি তৈরি করতে সক্ষম হননি।

তাপ-রশ্মি অস্ত্র
গ্রিক গণিতবিদ আর্কিমিডিসের কথা আমরা প্রায় সবাই জানি। তিনি পাইয়ের মান হিসাব করার মতো গণিতে অনেক অবদান রেখেছিলেন। তবে তিনি গণিতের পাশাপাশি আরো অনেকযন্ত্রও আবিষ্কার করেন।
রোমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে তিনি নানা অস্ত্র তৈরিতে সাহায্য করেন। খ্রিষ্টপূর্ব তৃতীয় শতাব্দীতে তিনি তাপ-রশ্মি ব্যবহার করে এক অস্ত্র তৈরি করেন। এটি ‘আর্কিমিডিসের মৃত্যু রশ্মি’ নামেও পরিচিত ছিল।
এই যন্ত্রটিতে অসংখ্য আয়না এমনভাবে লাগানো থাকতো যাতে সূর্য রশ্মি একত্রিত হয়ে এতটাই তীব্রভাবে প্রতিফলিত হতো যে তা দিয়ে সমুদ্রতীর থেকে ১,০০০ ফুট দূরে অবস্থিত রোমান জাহাজে নিমেষেই আগুন ধরিয়ে দেওয়া যেত।
প্রাচীন ইতিহাসবিদ গ্যালেনের জানান, এই মৃত্যু রশ্মি সাইরাকসের রোমান অবরোধের সময় ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়। এর তীব্র ও অরোধ্য রশ্মির আঘাতে ধ্বংস হয়ে যায় শত শত জাহাজ। কিন্তু কিভাবে এটি তৈরি করা হতো তার সমস্ত প্রণালীটি হারিয়ে গিয়েছে কালের গর্ভে।

দামেস্কোর ইস্পাত
মধ্যযুগে তরবারি তৈরির জন্য একটি ভিন্ন ধরনের ইস্পাত ব্যবহৃত হতো। দামেস্কের ইস্পাত নামে পরিচিত ছিল এটি। এই ইস্পাত তৈরি হতো মধ্যপ্রাচ্যে। এটি তৈরি করতে ‘উটজ স্টিল’ নামে একটি বিশেষ কাঁচামাল ব্যবহৃত হতো যা আসতো এশিয়া থেকে। এই বিশেষ ইস্পাতের তৈরি অস্ত্রগুলো হতো অসম্ভব মজবুত ও দৃঢ়।
দামেস্কোর ইস্পাত দিয়ে তৈরি অস্ত্রগুলোর পাতে থাকতো বিশেষ এক ধরনের প্যাটার্ন। রহস্যময় বিখ্যাত এই ইস্পাতের তৈরি অস্ত্রগুলো হতো মারাত্মক ধারালো। অন্য যেকোনো সাধারণ তরবারি এই ইস্পাতের তৈরি তরবারির আঘাতে দু’টুকরা হয়ে যেতো। বলা হতো, এই তরবারি এত ধারালো ছিল যে এর ওপর মানুষের একটা চুল রাখলেও সেটি মাঝ থেকে কেটে দু’টুকরা হয়ে যেত। কারো কারো মতে, এ ইস্পাতে নির্মিত তরবারিগুলো আক্ষরিকভাবেই ভাঙা অসম্ভব ছিল।
এই ইস্পাতের অসাধারণ বৈশিষ্ট্যগুলোর কারণে এটি ছিল খুব দুর্লভ। খুব কম সংখ্যক অস্ত্রের কারিগর এই ইস্পাত তৈরির নিয়ম জানতো। তৎকালীন সময়ে কড়া পাহারায় ও গোপনীয়তায় এই ইস্পাত তৈরি করা হতো। ফলে সেই কারিগররা যখন মারা যায় তখন দামেস্কের ইস্পাত তৈরির প্রক্রিয়াটিও হারিয়ে যায়।
তবে দামেস্কের ইস্পাতের তৈরি কিছু অস্ত্র গবেষকরা খুঁজে পেয়েছেন। যা গবেষণা করে দেখা গিয়েছে বিশেষ এই ইস্পাত কয়েকটি বিশেষ গাছের ছাল, রস ও তার সাথে ভ্যানাডিয়াম, ক্রোমিয়াম, ম্যাংগানিজ, কোবাল্ট, নিকেল ও ভারত থেকে আগত দুর্লভ কিছু ধাতুর সংমিশ্রণে তৈরি করা হতো। তবে এত কিছুর পরও এখন পর্যন্ত রহস্যময় সেই দামেস্কের ইস্পাত পুনরায় তৈরি করতে সক্ষম হননি কেউই।
এভাবেই ধীরে ধীরে হারিয়ে গেছে মূল্যবান সব আবিষ্কার। তবে বর্তমানে বিজ্ঞানীরা চেষ্টা করছেন সেগুলো পুনরায় আবিষ্কার করার। যদিও সেটি সময়সাপেক্ষ তবুও তারা আশাবাদী।

SHARE

Leave a Reply