চলে গেলেন কিংবদন্তি ফুটবলার ম্যারাডোনা। ৬০ বছর বয়সে গত বছর নভেম্বরের শেষ সপ্তাহে পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছেন তর্কসাপেক্ষে সর্বকালের সেরা ফুটবলার ডিয়াগো আরমান্ডো ম্যারাডোনা। তাই আমাদের এবারের আয়োজন ম্যারাডোনাকে নিয়ে।
ম্যারাডোনার ফুটবল ক্যারিয়ারের কথা উল্লেখ করলে সবার আগে আসবে ১৯৮৬ বিশ^কাপ ফুটবলের কথা। তবে ফাইনাল বা সেমিফাইনাল নয়, সম্ভবত সে বিশ^কাপের সবচেয়ে আলোচিত ম্যাচ ছিলো কোয়ার্টার ফাইনালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে আর্জেন্টিনার ম্যাচটি। ফকল্যান্ড দ্বীপ নিয়ে যুদ্ধের ঘা তখনো শুকায়নি আর্জেন্টাইনদের মন থেকে। আর্জেন্টিনার মূল ভূখণ্ডের খুব কাছের ওই দ্বীপটি জোর করে দখলে নিয়েছে ব্রিটিশ সেনারা। যুদ্ধে প্রাণ হারিয়েছে অনেক আর্জেন্টাইন সেনা। সেই থেকেই দুই দেশের মধ্যে প্রকাশ্য শত্রুতা। ম্যাচের আগের দিন সতীর্থদের ডেকে ম্যারাডোনা বললেন, আমাদের অর্থ নেই। অস্ত্রশস্ত্র নেই। আছে দরিদ্রতা, আর ফুটবল। এটাই আমাদের প্রতিশোধ নেওয়ার হাতিয়ার হতে পারে।
এরপর আসল কাজটি অবশ্য নিজেই করলেন। ১ লাখ ১৫ হাজার দর্শকের সামনে সেই ম্যাচে ম্যারাডোনার করা দু’টি গোল ফুটবল ইতিহাসে দুই রকমভাবে বিখ্যাত হয়ে আছে। ম্যাচের ৫১ মিনিটে চারজনকে কাটিয়ে নিজেই বল নিয়ে ঢোকেন ইংল্যান্ডের সীমানায়। সামনে ডিফেন্ডারদের দেয়াল দেখে ডান প্রান্তে এক সতীর্থকে পাস দেন। ইংল্যান্ডের এক ডিফেন্ডার ক্লিয়ার করতে গেলে শূন্যে উঠে যায় বল। ইংলিশ গোলরক্ষক লাফিয়ে উঠেছিলেন বল ধরার জন্য; কিন্তু তাকে কোন সুযোগ না দিয়ে হেড করার ভঙ্গিমায় লাফিয়ে উঠে হাত দিয়ে ম্যারাডোনা বলটি ঠেলে দেন ইংল্যান্ডের জালে।
সেকেন্ডেরও কম সময়ের মধ্যে দ্রুত ব্যাপারটি ঘটে যায়। তাই কাছে থাকা ইংলিশ গোলরক্ষক ছাড়া কেউ বুঝতেই পারেনি বিষয়টি। রেফারি গোলের বাঁশি বাজান। পরবর্তীতে ম্যাচের ভিডিও দেখে সাংবাদিকরা বিষয়টি জানতে চাইলে ম্যারাডোনা বলেন, সেটি ছিলো ঈশ^রের হাত। এরপর থেকে ওই গোলটি ইতিহাসে বিখ্যাত হয়ে আছে ‘হ্যান্ড অব গড’ গোল হিসেবে। তবে বিতর্কিত সেই গোলের মাত্র ৪ মিনিট পর ম্যারাডোনা দেখান তার সেরা জাদুটি। করেন ফুটবল ইতিহাসের সেরা গোলটি। মাঝমাঠ থেকে বল নিয়ে দৌড়ে যাওয়ার পথে ৫ ফুটবলারকে ছয়বার এবং শেষমেশ গোলরক্ষককেও কাটিয়ে বলটি ঠেলে দেন জালে। সারা বিশে^র ফুটবলদর্শকদের ভোটে এই গোলটি শতাব্দীর সেরা গোল হিসেবে স্বীকৃতি পায়। সেবার ম্যারাডোনার হাতেই ওঠে বিশ^কাপ। ফাইনালে পশ্চিম জার্মানিকে হারিয়ে কাপ জেতে আর্জেন্টিনা।
বিশ^কাপে বিখ্যাত ওই দু’টি গোলের মতো ম্যারাডোনার জীবনটাও বৈপরীত্যে ভরা। যেন মুদ্রার ভিন্ন দুটি পিঠ। এক দিকে সাফল্য তার হাতে যেমন ধরা দিয়েছে তেমনি ব্যক্তিগত জীবনে একের পর এক বিতর্কের জন্ম দিয়েছেন। নিষিদ্ধ ড্রাগ নিয়ে শেষ হয়েছে তার আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার। তার আগেও ইতালির নাপোলি ক্লাবে খেলার সময় একবার কোকেন সেবন করে নিষিদ্ধ হয়েছিলেন ১৫ মাসের জন্য। ব্যক্তিগত জীবনে ছিলো না কোন শৃঙ্খলা। সংসার ভেঙেছে অনেকবার। সন্তানদের স্বীকৃতি নিয়ে আদালতে পর্যন্ত যেতে হয়েছে। কর ফাঁকিসহ বিভিন্ন ইস্যুতেও আইনি ঝামেলা পোহাতে হয়েছে অনেকবার।
এগুলো সবই খেলার বাইরের ম্যারাডোনা; কিন্তু খেলার ম্যারাডোনা ছিলেন সম্পূর্ণ ভিন্ন আরেকজন। যার পায়ে বল গেলে প্রতিপক্ষের সব খেলোয়াড় তাকে ঠেকানোর জন্য সামনে দাঁড়িয়ে যেত। আর দর্শকরা নিষ্পলক তাকিয়ে থাকতো পায়ের জাদু দেখার জন্য। ড্রিবলিং, পাসিং, প্লেসিং কিংবা প্রতিপক্ষকে বোকা বানিয়ে বল নিয়ে বেরিয়ে যাওয়া- যারা দেখেছে শুধু তারাই বলতে পারবে ম্যারাডোনা কেন সেরা ছিলেন।
ম্যারাডোনার জন্ম আর্জেন্টিনার বুয়েনেস আইরেস প্রদেশের লানুস শহরের এক দরিদ্র পরিবারে। শৈশবে ভালো খাওয়া কিংবা ভালো পোশাক পরার সুযোগ ছিলো না তার; কিন্তু ছিলো প্রতিভা এবং সেটি বিকশিত করতে চেষ্টার কমতি ছিলো না। দরিদ্রতাও তাই বাধা হতে পারেনি এ ক্ষেত্রে। মাত্র ৮ বছর বয়সের সময় বাড়ির কাছের এক ক্লাবের মাঠে খেলতে গিয়ে একটি ফুটবল স্কাউট দলের নজরে আসেন ম্যারাডোনা। যারা বিভিন্ন জায়গা থেকে ফুটবল প্রতিভাদের খোঁজ দেয় ক্লাবগুলোকে। সেই সূত্র ধরে রাজধানী শহর বুয়েনেস আইরেসের ক্লাব আর্জেন্টিনোস জুনিয়রস-এ নাম লেখান ম্যারাডোনা। অল্প দিনেই ক্লাবটির জুনিয়র দলের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড় হয়ে ওঠেন তিনি। ১৯৭৬ সালে ১৬তম জন্মদিনের ১০ দিন আগে ক্লাবটির সিনিয়র দলের হয়ে পেশাদার অভিষেক তার। তিনি ছিলেন আর্জেন্টিনার প্রিমিয়ার ডিভিশনের ইতিহাসে সবচেয়ে কম বয়সী খেলোয়াড়।
১৯৭৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে হাঙ্গেরির বিপক্ষে আন্তর্জাতিক ম্যাচে অভিষেক হলেও ১৯৭৮ সালে দেশের মাটিতে বিশ^কাপে তাকে দলে নেওয়া হয়নি। কোচ লুইস মেনোত্তির যুক্তি ছিলো, আর্জেন্টাইনদের প্রচুর ফাউল করে প্রতিপক্ষ। এই অবস্থায় ১৭ বছরের একটি কিশোরকে বিশ^কাপে নামানো হলে তার ক্যারিয়ারটাই শেষ হয়ে যেতে পারে। পরের বছর ফিফা যুব চ্যাম্পিয়নশিপের শিরোপা এনে দেন আর্জেন্টিনাকে। ছয় ম্যাচে করেন ছয় গোল।
১৯৮২ সালের বিশ^কাপে খেলতে নামেন আকাশি-সাদা জার্সি গায়ে। তার আগেই অবশ্য ওই সময়ের রেকর্ড ৫ মিলিয়ন বা ৫০ লাখ ইউরো ট্রান্সফার ফিতে তাকে দলে ভেড়ায় স্পেনের এফসি বার্সেলোনা। স্পেনে অনুষ্ঠিত ওই বিশ^কাপে দ্বিতীয় রাউন্ড থেকে বিদায় নেয় আর্জেন্টিনা। তবে বার্সেলোনার হয়ে প্রথম মৌসুমেই রিয়াল মাদ্রিদকে হারিয়ে কোপা ডেল রে ও অ্যাতলেটিকো বিলবাওকে হারিয়ে জেতেন স্প্যানিশ সুপার কাপের শিরোপা। দুই মৌসুম পর ম্যারাডোনা যোগ দেন ইতালির নেপলস শহরের ক্লাব নাপোলিতে। সেটিও ছিলো ট্রান্সফার ফির রেকর্ড।
নাপোলিতেই ম্যারাডোনা কাটিয়েছেন ক্লাব ক্যারিয়ারের সেরা সময়। সাদামাটা একটি ক্লাবকে এনে দিয়েছেন বিশ^জোড়া খ্যাতি। নেপলস শহরটি ছিলো দক্ষিণ ইতালির দারিদ্র্যপীড়িত ও মাফিয়াদের শহর। বড় কোন তারকা ছিলো না এই শহরের ক্লাব নাপোলিতে। ম্যারাডোনা নাপোলিতে খেলতে যাওয়ায় অনেকেই অবাক হয়েছিলেন; কিন্তু গরিব শহরের মানুষগুলোকে তিনি আপন করে নিয়েছিলেন।
১৯৮৬-৮৭ মৌসুমে ইতালির দক্ষিণাঞ্চলীয় কোন ক্লাব হিসেবে প্রথম লিগ শিরোপা জেতে নাপোলি। ৮৯-৯০ মৌসুমে ক্লাবটিকে দ্বিতীয় শিরোপা এনে দেন ম্যারাডোনা। এর মাঝখানের দুই মৌসুমে লিগে দুইবার রানার্সআপ হয়েছে নাপোলি। এ ছাড়া ১৯৮৭’র কোপা ইতালিয়া, ৮৯-এ উয়েফা কাপ এবং ৯০-এ ইতালিয়ান সুপার কাপ জেতান ক্লাবটিকে। অর্থাৎ ম্যারাডোনার খেলা পুরো সময়টাতেই ক্লাব ফুটবলে প্রচণ্ড দাপট ছিলো নাপোলির। মধ্যম সারির একটি ক্লাব ম্যারাডোনার ছোঁয়ায় হয়ে ওঠে বিশ্বসেরা।
নাপোলিবাসীও ম্যারাডোনার মাঝেই পেয়েছিল ত্রাণকর্তার দেখা। ফুটবল পাগল শহরবাসী ম্যারাডোনাকে বসিয়েছিল ঈশ্বরের আসনে। পরবর্তীতে নাপোলি তাদের টিম থেকে ম্যারাডোনার সম্মানে ১০ নম্বর জার্সিটিকে চিরদিনের জন্য অবসরে পাঠিয়েছে। এখনো নেপলসের রাস্তায় ম্যারাডোানর ম্যুরাল দেখা যায় এখানে সেখানে। শোনা যায়, আশির দশকের শেষ দিকে নেপলসে যত ছেলের জন্ম হয়েছে, শতকরা আশি শতাংশের নামের প্রথম অংশই ডিয়াগো রাখা হয়েছিল। ইতালির জাতীয় নির্বাচনে প্রায় ২০ হাজার মানুষ কাউকে ভোট না দিয়ে ব্যালট পেপারে ‘ম্যারাডোনার জয় হোক’ লিখে দিয়ে এসেছিলেন। নব্বইয়ের বিশ্বকাপে নাপোলির অনেকেই নিজের দেশ বাদ দিয়ে আর্জেন্টিনাকে সমর্থন দিয়েছিলেন ম্যারাডোনার জন্য।
১৯৮৬তে বিশ^কাপ জেতার পর ১৯৯০ আসরেও আর্জেন্টিনাকে ফাইনালে তুলেছিলেন ম্যারাডোনা; ফাইনালে জার্মানি ফাউলের পর ফাউল করে রীতিমতো ছিনিয়ে নিয়েছে কাপটা। ম্যারাডোনার কান্না সেদিন ছুঁয়ে গিয়েছে সারা বিশে^র ফুটবল ভক্তদের। আর চার বছর পর ১৯৯৪ বিশ^কাপটা এসেছিলো ম্যারাডোনার ক্যারিয়ারের জন্য অভিশাপ হয়ে। দুই ম্যাচ খেলার পর ডোপ টেস্টে পজেটিভ প্রমাণিত হয়ে আর খেলতে পারেননি। আর্জেন্টিনাও সেবার বিদায় নেয় দ্বিতীয় রাউন্ড থেকে।
এরপর ক্লাব ফুটবলে ফিরলেও আন্তর্জাতিক ফুটবলে আর ফেরা হয়নি। মাদকের নেশা আরো জেঁকে বসেছিল তার। উচ্ছৃঙ্খল জীবন যাপন আরো বেড়েছে। ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত আজেন্টাইন ক্লাব বোকা জুনিয়র্সের হয়ে খেললেও ছিলেন আসলে নিজের ছায়া হয়ে। ফুটবল ছাড়ার পর কোচিংয়ে যুক্ত হন ম্যারাডোনা। ২০১০ বিশ^কাপে তার অধীনেই খেলেছে লিওনেল মেসিরা।
আরো অনেক বিষয়ের মতো রাজনীতি নিয়েও প্রচণ্ড সচেতন ছিলেন ম্যারাডোনা। ফিলিস্তিনের নিপীড়িত মানুষের প্রতি তার ছিলো ভালোবাসা। নিজেকে মনে করতেন ফিলিস্তিনের নিপীড়িত জনতার একজন। ২০১৮ সালের জুলাইয়ে ফিলিস্তিনের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাসকে জড়িয়ে ধরে ম্যারাডোনা বলেছিলেন, হৃদয় থেকে আমি একজন ফিলিস্তিনি।
ফিলিস্তিনিদের প্রতি সমর্থন ব্যক্ত করে বলেছিলেন, প্রেসিডেন্ট আব্বাসের একটি দেশ রয়েছে, সেই দেশটিরও আছে অধিকার। এই মানুষটি ফিলিস্তিনে শান্তি চায়। ম্যারাডোনা আশা করতেন ফিলিস্তিন একদিন বিশে^ সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করবে।