রাজকীয় ফুল রাজ অশোক। এই ফুলের অন্য একটি নাম উর্বশী। যার অর্থ শ্রেষ্ঠ সুন্দরী। এটি যেমন সুন্দর, মোহনীয়, তেমনি দুর্লভ একটি উদ্ভিদ।
উর্বশীকে উদ্ভিদ জগতের অন্যতম সুন্দর উদ্ভিদ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। কোনো কোনো প্রকৃতিবিদ একে গ্রীষ্মমণ্ডলীয় অঞ্চলের পুষ্প প্রদানকারী উদ্ভিদদের মধ্যে সুন্দরতম বলেও অভিহিত করেছেন। উর্বশী গাছ দেখতে যেমন সুন্দর তেমনই সুন্দর এর ফুলগুলো।
ব্রিটিশ ভারতের সাবেক গভর্নর জেনারেল উইলিয়াম আর্মহাস্টের স্ত্রী ও প্রকৃতিপ্রেমী লেডি সারাহ আর্মহাস্ট, যিনি উনিশ শতকের গোড়ার দিকে এশীয় উদ্ভিদের সংগ্রাহক হিসেবে পরিচিত ছিলেন। তার নামানুসারে এই উদ্ভিদটির বৈজ্ঞানিক নামকরণ করা হয় Amherstianobilis।
উদ্ভিদটির অন্যান্য স্থানীয় নামের মধ্যে রাজ অশোক, পারিজাত, কুইন অব দ্য ফ্লোয়ারিং প্লান্টস, ট্রি অব হ্যাভেন, প্রাইড অববার্মা, অর্কিড ট্রি ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।
রাজ অশোক মাঝারি আকৃতির বৃক্ষ, সাধারণত ৮ থেকে ১০ মিটার পর্যন্ত উঁচু হতে পারে। মজার বিষয় হচ্ছে আমাদের কমন অশোক আর হলুদ অশোকের সাথে এই রাজ অশোক ফুলের কোন মিল নেই। এই ফুলের সাথে কৃষ্ণচূড়ার কিছুটা মিল আছে।
রাজ অশোক ফুল অর্কিডের মতো প্রশাখাময় হয় বলে একে Orchid tree বলা হয়। এদের পাতাগুলো পক্ষল ও যৌগপত্র। ৬ থেকে ৮ সেন্টিমিটার দৈর্ঘ্য বিশিষ্ট পাতাগুলো অনেকটা অশোকের পাতার মতো ডাল থেকে ঝুলে থাকে।
উর্বশী আমাদের দেশে প্রচলিত উদ্ভিদ নয়, এটি সাধারণত গ্রীষ্মমণ্ডলীয় অঞ্চলের আর্দ্র এবং উর্বর মাটি বিশিষ্ট, রোদ ও আংশিক ছায়াযুক্ত স্থানে জন্মে থাকে। এই উদ্ভিদের আদি নিবাস মিয়ানমারে। তবে বর্তমানে একে ভারত, বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা, আমেরিকা ও ইউরোপের কিছু কিছু উদ্যানে সংরক্ষিত পরিবেশে চাষ করা হয়।
এই ফুল হেমন্ত থেকে বসন্ত পর্যন্ত ফুটতে থাকে। এমনকি গ্রীষ্মকালেও মাঝে মাঝে ফুল দেখা যায়।
উর্বশী ফুলগুলো বেশ বাহারি। গাছের উপরিভাগের কাণ্ড ও ডালপালা থেকে লম্বা মঞ্জরি দণ্ড বের হয়। সোনালুর মতই নিচের দিকে ঝালরের মতো ঝুলে থাকে। এদের কচি পাতাগুলো দেখতে খুবই সুন্দর, তামাটে রঙের পাতার কোল থেকে বড় বড় পুষ্পমঞ্জরি বের হয়।
মঞ্জরি দণ্ডে বিপরীত দিকে চার-পাঁচটি ফুল থাকে। এর বৃহৎ পাপড়িগুলো ৭.৫ সেন্টিমিটার পর্যন্ত লম্বা এবং ৪ সেন্টিমিটার পর্যন্ত চওড়া হতে পারে। মঞ্জরির গোড়ার দিকের ফুলটি প্রথমে ফোটে, তারপর ক্রমশ পরের কলিগুলো ফোটে। মঞ্জরিতে লাল ফুলগুলো চমৎকার দর্শনীয় ভঙ্গিমায় গাছ থেকে এমনভাবে ঝুলে থাকে যেন দেখে মনে হয় পাখা মেলে বসে আছে লাল রঙের ছোট ছোট কিছু পাখি।
এরা খুবই কম পরিমাণে ফল দেয়। এর লাল ও সোনালি-হলুদ বর্ণের কচি ফল দেখতে অনেকটা শিমের মতো মনে হয়, যা কি না ১১ থেকে ২০ সেন্টিমিটার পর্যন্ত দীর্ঘ হয়ে থাকে।
এই প্রজাতির উদ্ভিদগুলো মাটির নির্দিষ্ট কিছু ব্যাকটেরিয়ার সাথে সিম্বায়োটিক সম্পর্ক গড়ে তোলে, এই ব্যাকটেরিয়াগুলো গাছের শিকড়ে নোডিউল তৈরি করে যা বায়ুমণ্ডল থেকে নাইট্রোজেন সংবন্ধন করে উক্ত গাছের নাইট্রোজেনের চাহিদা পূরণ করে।
প্রাকৃতিক পরিবেশে উর্বশী গাছের দেখা পাওয়াটা খুবই দুর্লভ। বার্মার বনাঞ্চল থেকে বন্য অবস্থায় একে কেবল দুই বার সংগ্রহ করা হয়েছিল। বাংলাদেশের নড়াইলে, মিরপুরের জাতীয় উদ্ভিদ উদ্যানে এবং পুরান ঢাকার বলধা গার্ডেনে সংরক্ষিত অবস্থায় কিছু উর্বশী গাছের দেখা পাওয়া যায়।
বাংলাদেশের ২০১২ সালের বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা আইন অনুযায়ী এ প্রজাতিটি সংরক্ষিত। এই প্রজাতিটির বিলুপ্তির কথা চিন্তা করে বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক একে সংরক্ষিত উদ্ভিদ হিসেবে ঘোষণা করেছে।