Home গল্প তালুতের যুদ্ধ -এস.এম রুহুল আমীন

তালুতের যুদ্ধ -এস.এম রুহুল আমীন

হজরত শামবিল আলাইহিস সালাম। আল্লাহর একজন নবী ছিলেন। কুরআনুল কারীমে কিন্তু তার নাম আসেনি। তবে বনি ইসরাইলের একজন নবী হিসেবে তিনি বেশ পরিচিত ছিলেন। এ সময়ে ফিলিস্তিনের শাসক ও সেনাপতি ছিলো জালুত। জালুত ছিলো ইতিহাসখ্যাত জালিম বা অত্যাচারী শাসকদের একজন। জালিম রাজাদের মতোই সে সুযোগ পেলে বনি ইসরাইলদের ওপর চালাতো জুলুম ও নির্যাতনের স্টিমরোলার।
বনি ইসরাইলদের সাথে জালুতের যুদ্ধ বলতে গেলে সারা বছর লেগেই থাকতো। তাই বনি ইসরাইলদেরও প্রয়োজন ছিলো একজন যুদ্ধবাজ বা বলিষ্ঠ শাসকের। হজরত শামবিল আ. অনুধাবন করলেন বিষয়টি। অবশেষে জাতির অভিজ্ঞ ও বিচক্ষণ ব্যক্তি হিসেবে সুপরিচিত ঈমানদার তালুতকে ঘোষণা করলেন বনি ইসরাইলের শাসক ও সেনাপতি হিসেবে। এবার হলো সেয়ানে সেয়ান। যেমন যুদ্ধবাজ জালুত তেমনই যুদ্ধে অভিজ্ঞ তালুত।
তালুত ছিলেন যেমন সাহসী তেমন ধার্মিক। তিনি ঐক্যবদ্ধ করলেন ঈমানদার বা বিশ্বাসী লোকদের। জাতির লোকদের নিয়ে গঠন করলেন শক্তিশালী এক সেনাবাহিনী। প্রতিহত করতে জালুতের অত্যাচার ও আক্রমণ। ইতোমধ্যেই একবার বেজে উঠলো যুদ্ধের দামামা। অনেক বড়োসড়ো দৈত্যমানব হিসেবেই পরিচিত। যুদ্ধবাজ জালুত রওয়ানা দিলো বীরের বেশে যুদ্ধ করতে। বসে থাকলেন না ঈমানদার তালুতও। তিনিও রওয়ানা দিলেন তার বিশাল ঈমানদার ও মুসলিম বাহিনী নিয়ে। কিন্তু কাজ হবে কি! বনি ইসরাইলের বেশির ভাগ লোক ছিলো নাফরমান বিশ্বাসঘাতক ও মুনাফিক। মাঝপথে গিয়ে তারা বেঁকে বসলো। করলো সেনাপতি তালুতের নির্দেশকে অমান্য। দলের অধিকাংশ লোক যুদ্ধে যেতে অস্বীকার করলো। তারা কেটে পড়লো যুদ্ধে যাত্রার মাঝ পথের ওখান থেকেই।
এক সময় যুদ্ধ হলো শুরু। তর্জন-গর্জন আর হুঙ্কার দিয়ে মাঠে নামলো জালুত। জালুত এগিয়ে আসলো যুদ্ধের ময়দানে। আহবান জানালো, বুকের পাটা ফুলিয়ে যুদ্ধের জন্য। কিন্তু, কার আছে বুকের পাটা? জালুতের সাথে যাবে লড়তে? জালুতের সাথে যাবে যুদ্ধে? বনি ইসরাইলের মধ্যে কারো হলো না এমন সাহস ও বুকের পাটা। কেউ এগিয়ে এলো না জালুতের সাথে যুদ্ধে লড়বার জন্য। হঠাৎই গর্জে উঠলেন এক বালক। সবাই তো অবাক। কে এই বালক? জালুতের সাথে যুদ্ধে যাওয়ার সাহস তার? সবাই বলাবলি করতে লাগলো, তার বুকের পাটা তো দেখছি কম নয়? সাহসও কলিজা জোড়া। সহসাই এগিয়ে এলেন একটি বালক। আসলে সে যোদ্ধাই নন। যুদ্ধে এসেছেন স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে। জালুতের আর চোখে ধরলো না। বালকটিকে মনে করলো সে একদম নস্যি। কোনো পাত্তাও দিলো না তাঁকে।
কিন্তু বেপরোয়া সে বালক। ধর্ম যুদ্ধের জন্য সে পাগল প্রায়। তার চেতনায় রয়েছে ‘শের দেগা নেহি দেগা আমামা’। বেপরোয়াভাবেই সে আঘাত হানা শুরু করলো দৈত্য মানব জালুতের ওপর। মারতে শুরু করলো একের পর এক গুলতি দিয়ে পাথর। পাথর মারতে মারতে সে বেহুঁশ করে ফেললো দৈত্যমানব ও যুদ্ধবাজ জালুতকে। সহসাই জালুত লুটিয়ে পড়লো মাটিতে। এতো বড় শক্তিশালী ও সাহসী সেনাপতি জালুত! ছোট্টবালকের কাছে হার মানলো সে। কুপোকাত হলো অল্পতেই। অবাক কাণ্ড! সাথে সাথেই মারা গেলো জালুত। অন্যান্য সেনাসদস্যরা দেখলো অবস্থা খুব বেগতিক। সেনাপতি জালুত গেলো মারা। সামান্য ও ছোট্ট একটি বালকের হাতে। যে কিনা কোনো যোদ্ধাও নয়। এসেছে বনি ইসরাইল তথা মুসলিম বাহিনীর সাথে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে। ভয়ে যুদ্ধের ময়দান ছেড়ে পালাতে শুরু করলো এবং অল্পসময়ের মধ্যেই পালিয়ে গেলো শক্তিশালী জালুত বাহিনী।
জালুতের করুণ মৃত্যুর মধ্য দিয়ে পরাজয় হলো শক্তিধর জালুত বাহিনীর। বিজয়ের মালা গলে পড়লো তালুত বাহিনী। আল্লাহর আরেক নবী দাউদই আ. যে জালুতকে ধরাশায়ী করলো সে কথা কুরআনুল কারীমে এসেছে এভাবে। দাউদই জালুতকে হত্যা করলো। শক্তিশালী জালুতকে হত্যার মাধ্যমে সকলের দৃষ্টিতে পড়ে যান দাউদ। আকৃষ্ট হয়ে পড়েন নিজ বংশ বনি ইসরাইলেও। দিন দিন বেড়ে যায় তাঁর জনপ্রিয়তা। অল্প সময়ের মধ্যেই তিনি হয়ে ওঠেন জনপ্রিয় ‘এক জননেতা’। রাজা তালুতের মেয়ে বিয়ে করেন দাউদ আ.। রাজা তালুতের মৃত্যুর পর জনগণ শাসক হিসেবে নির্বাচিত করেন দাউদকে।
এ সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেন, ‘হে দাউদ! আমি তোমাকে পৃথিবীতে করেছি আমার প্রতিনিধি। মানুষের মাঝে তুমি ন্যায়সঙ্গতভাবে বিচার ফয়সালা ও রাজত্ব করো। এ কাজে তুমি তোমার খেয়াল খুশি ও শয়তানের অনুসরণ করো না। তাহলে তুমি সরে যাবে আল্লাহর পথ থেকে। আর যারা আল্লাহর পথ থেকে সরে যায়, তাদের জন্য রয়েছে ভয়াবহতম কঠিন শাস্তি। এর কারণ হলো, তারা হিসাবের দিবস মানে কিয়ামতকে ভুলে যায়।’
মহান আল্লাহ তা’য়ালা দাউদের শাসনকালকে সোনালি শাসন আমলে পরিণত করেন। দান করেন অনেক শিল্পোন্নতি। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো গার্মেন্টস বা পোশাক শিল্প। এ ছাড়াও তার জামানায় উন্নতি ঘটেছিল লৌহ শিল্পের। তাকে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’য়ালা দান করেছিলেন যথেষ্ট পরিমাণ প্রকৌশলগত বা ইঞ্জিনিয়ারিং জ্ঞান। আর এ জন্যই হজরত দাউদ আ.-কে বলা হয় পৃথিবীর প্রথম ইঞ্জিনিয়ার।
ছেলেবেলা থেকেই হজরত দাউদ আ. ছিলেন অত্যন্ত ভদ্র, নম্র ও আল্লাহভীরু। আল্লাহর দাসত্বসহ বহু মানবিক গুণাবলি ছিল তাঁর মাঝে। তিনি ছিলেন আল্লাহর অতি প্রিয় বান্দা। আল্লাহ তা’য়ালা তাঁকে দান করেছিলেন নবুয়ত। হিদায়াতের পাথেয় হিসেবে দিয়েছিলেন যাবুর নামক আসমানি কিতাব। হজরত দাউদ আ. ছিলেন মধুরকণ্ঠ আর মিষ্টি ভাষার অধিকারী। তিনি যখন যাবুর শরীফ তিলাওয়াত করতেন তখন তা কান পেতে শুনতো পাহাড়-পর্বত আর গাছ-গাছালি, পশুপক্ষী এমনকি তার সুর লহুরিতে যাবুর শরিফ শুনতে আসতো পুকুর এবং নদীর মাছও। তাঁর সুরের পাগল ছিল সৃষ্টি জগতের সবাই। হজরত সুলাইমান আ. ছিলেন তার যোগ্য উত্তরাধিকারী বা সুযোগ্য সন্তান।
হজরত দাউদ আ. ছিলেন বহুগুণের গুণধর এক ব্যক্তিত্ব। স্পষ্টভাষা ও বিচক্ষণতার সাথে বিচার ফয়সালার অসাধারণ ক্ষমতা ছিল তাঁর। ইবাদাত বন্দেগিতে ছিলেন তিনি সবার সেরা। প্রায় সময়ই ইবাদাত বন্দেগিতে মশগুল থাকতেন তিনি। নিজের হাতে পরিশ্রম করে জীবিকা নির্বাহ করাও ছিল তাঁর গুণের অন্যতম একটি। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’য়ালা হজরত দাউদ আ.কে অনেক শক্তিশালী বলে উল্লেখ করেছেন কুরআনুল কারীমে। আসলেই তিনি বেশ শক্তিশালী ছিলেন। তাঁর সে শক্তির উৎস ছিল মহান আল্লাহর প্রতি মজবুত ঈমান। তাঁর একনিষ্ঠ ইবাদাত, উন্নত নৈতিকতা, জীবন যাপনে সহজ-সরলতা, স্বচ্ছতা, আল্লাহ প্রদত্ত সুকণ্ঠ ও সুভাষণ সর্বোপরি সুনিয়ন্ত্রিত রাষ্ট্রশক্তি। মহান আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’য়ালা আমাদেরকে তাঁরই নবী হজরত দাউদ আ.-এর গুণাবলিতে ভূষিত করুন। এটাই আমাদের করুণ আর্তি।
(সূরা আস সোয়াদ অবলম্বনে)

SHARE

Leave a Reply