Home বিশেষ রচনা হিম হিম পরশ নিয়ে আবার এলো শীত -হারুন ইবনে শাহাদাত

হিম হিম পরশ নিয়ে আবার এলো শীত -হারুন ইবনে শাহাদাত

শীত শব্দটির সাথে জড়িয়ে আছে হিম হিম এক মজার পরশ। ছয় ঋতুর বাংলাদেশে পৌষ-মাঘ এই দুই মাস শীতকাল। আমাদের প্রিয় বাংলাদেশে বছর ঘুরে শীতকাল আসে মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে অনেক মজার মজার উপহার নিয়ে। কিন্তু এবারের শীত কেমন হবে তা নিয়ে আছে আতঙ্ক। আছে করোনাভাইরাস বেড়ে যাওয়ার শঙ্কা ও ভয়। তারপরও আমরা আশা করি, এই মহামারীর সময় শীতের আগমন তোমাদের আমাদের সবার জন্য হোক নিরাপদ ও আন্দনময়। কিন্তু চাইলেই কি হয়? অবশ্যই না। এর জন্য প্রয়োজন আল্লাহর রহমত। আল্লাহর রহমত পেতে হলে অবশ্যই স্বাস্থ্যবিধি মেনে দুই হাত তুলে তাঁর সাহায্য কামনা করতে হবে। উষ্ণতার পরশ ছাড়া শীতকাল খুবই কষ্টের। তাই গরম কাপড় আর রুমহিটারের উত্তাপে বসে যারা শীতের মজার মজার পিঠা, পুলি, পায়েস খাবে বলে চিন্তা করছো, তাদেরকে অবশ্যই তোমার আশপাশের বঞ্চিত আর দরিদ্র মানুষগুলোর কথা ভাবতে হবে।
পৌষ-মাঘ এই দুই মাস শীতকাল হলেও অগ্রহায়ণ মাস থেকেই গ্রামবাংলার প্রকৃতিতে আসে শীতের হিম হিম পরশ। তবে হাড়কাঁপানো তীব্র শীত আসে পৌষ-মাঘ মাসে। এমনকি ফাল্গুনের শেষাবধিও তার রেশ থেকে যায়, তবে দাপট অনেক কমে যায়। শীতে বাংলাদেশের গ্রাম-প্রকৃতি সন্ধ্যার আগে থেকেই শিশির আর কুয়াশার চাদর মুড়ি দিতে শুরু করে। বাংলাদেশের যশোর-খুলনাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় খেজুর গাছ থেকে রস সংগ্রহ ও গুড়-পাটালি তৈরি হয়। শুধু গুড়-পাটালি-পিঠেপুলি-পায়েস আর মোয়া নয়, হরেক রকম সতেজ তরিতরকারি, শাকসবজি সম্ভারে ভরে উঠে বাড়ির পাশের ক্ষেত-খামার আর বাগান। লাউ-কুমড়ো-ফুলকপি-বাঁধাকপি, মূলো, পালংশাক, শালগম, বেগুন, টমেটো, মেটে-আলু, পেঁয়াজের কলি এসব তরকারি রাশি রাশি। কী তরতাজা আর কী স্বাদ সেগুলোর! বিল-বাঁওড় আর নদী-খালের মিঠেপানির হরেক রকমের মাছ আমাদের শীতকালের আরেকটি উপহার। শুধু গ্রামে নয়, শহর-গঞ্জের বিভিন্ন বাজারেও শীতের নদী-খাল, বিল-বাঁওড় থেকে ধরা টাটকা ও ‘লাফানো-মাছ’ দেখা যায়, কিনতে পারা যায়। বড় বড় শৈল-বোয়াল-গজার-টাকি, শিং-মাগুর-কৈ-মেনি, খয়রা-পটুটি-সরপটুটি-বাইন-পাবদা-ট্যাংরা ইত্যাদি মাছের স্বাদ যেন শীতকালে অনেক বেড়ে যায়। বিশেষ করে, গ্রামের গেরস্থ বাড়িতে রাতে রান্না করে-রাখা বড় বড় তারাবাইন, শৈল, কৈ, পাবদা কিংবা সরপটুটি-মেনি সকাল বেলায় ঠালা কড়কড়ে ভাত দিয়ে খাওয়ার যে কী মজা তা যে খেয়েছে সে ছাড়া অন্য কাউকে বলে বোঝানো যাবে না।
অগ্রহায়ণ মাসে সীমিত আকারে আমন ধান কাটা শুরু হলেও পৌষের শুরুতে ধান কাটা পুরোদমে শুরু হয়ে যায় গাঁয়ের মাঠে মাঠে। মাঠভরা থোকা থোকা আমন ধানের সারি সারি গাছগুলো হাওয়ায় দোলে। মাথাভরা যেন ছোট ছোট সোনার টুকরো, সোনার ধান। চাষিদের স্বপ্নের প্রতীক। খুশি আর আনন্দের বার্তাবহ। সোনালি ধানের সোনালি আভা লক্ষ লক্ষ চাষির মুখে হাসি ছড়ায়। বুকে আশা জাগায়। তাইতো মাঠজুড়ে ধান কাটার ব্যস্ততা, যেন আগামী দিনের নতুন স্বপ্নপূরণের মহোৎসব। সেই ধানে ভরে ওঠে কৃষকের গোলা, আউড়ি, ডোল। চাল তৈরির কল এখন গ্রামে পৌঁছে যাওয়ায় ঘরে ঘরে ঢেঁকিতে আর আগের মতো ধান ভানার দৃশ্য দেখা যায় না। তার পরও শীতকালে এখনও গ্রামবাংলার গেরস্থ বাড়িতে ঢেঁকিতে চিঁড়ে কোটার ধুম লাগে। বানানো হয় চাউলের গুঁড়ি পিঠেপুলির জন্য। ঢেঁকির একটানা ঢুকুর ঢুকুর শব্দ শুনতে বেশ লাগে। উঠোনের কোনায় বড় চুলোয় নতুন চালের মুড়ি ভাজার ব্যস্ততাও চোখে পড়বে। সকালের মিষ্টি রোদে বসে খেজুরের রসে ভেজানো মুড়ি, গুড়-মাখানো মুড়ির মোয়া কিংবা নোলেন পাটালি দিয়ে মচমচে মুড়ি খাওয়ার কথা মনে হলেই জিবে পানি এসে যায়।
আমরা যারা ইসলাম ধর্মের অনুসারী তাদের জন্য শীতকালকে আল্লাহর নৈকট্য লাভের জন্য হাদিসের উদ্ধৃতি দিয়ে বসন্তকাল বলে উল্লেখ করেছেন ইসলামী স্কলাররা। ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা হজরত উমর ফারুক রা. বলেন, ‘শীতকাল আবেদ বান্দাদের জন্য গনিমতস্বরূপ।’ বিশিষ্ট সাহাবী আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. শীতকালকে স্বাগত জানিয়ে বলেন, ‘শীতকালকে স্বাগতম! এ ঋতুতে বরকত নাযিল হয়। এ সময়ে ইবাদাত বন্দেগির জন্য রাত্রি দীর্ঘ হয় এবং দিন ছোট হয় যা রোযার জন্য সুবিধাজনক। বিশিষ্ট তাবেয়ি হাসান বসরী রহ. বলেন, ‘মুমিনের জন্য উত্তম কাল হলো শীতকাল। সে এর দীর্ঘ রাতে ইবাদাত বন্দেগি করে এবং ছোট দিনে রোযা রাখে।’ হজরত উবায়েদ বিন উমাইর রহ. শীতকালের আগমনে বলেন, ‘হে কুরআনের অনুসারীগণ। কুরআন পড়ার জন্য তোমাদের রাত দীর্ঘ হয়েছে। অতএব তোমরা কুরআন পাঠ করো। রোযার জন্য দিন ছোট হয়েছে। অতএব তোমরা রোযা রাখো।’ হযরত আবু যর গিফারী রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘নবী করিম সা. শীতকালের কোন একদিন বের হলেন, যখন গাছের পত্র-পল্লব ঝরে পড়ত। অতঃপর তিনি গাছের দু’টি ডাল ধরলেন, ফলে পাতাগুলো ঝরে গেল। তখন রাসূল সা. বললেন, যখন কোন মুসলমান বান্দা আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টির উদ্দেশে নামায আদায় করে, তখন তার থেকে পাপরাশি ঝরে পড়ে যায় যেমনভাবে এ গাছটির পাতা ঝরে পড়েছে।’ এই বিষয়গুলো মনে রেখে সবার উচিত শীতকালের রহমত বরকত হাসিল করতে সচেষ্ট হওয়া।
আমাদের দেশের শীতকালের আরেকটি উল্লেখযোগ্য অনুষঙ্গ হলো, রাতের বেলায় তাফসির ও ওয়াজ মাহফিল। কিশোর-তরুণ থেকে নিয়ে সব বয়সের নারী-পুরুষ এই মাহফিল থেকে শিক্ষা নিয়ে ধর্মীয় জ্ঞানের আলোয় নিজেদেরকে আলোকিত করার সুযোগ পায়। তবে করোনার কারণে এ বছর সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে সীমিত আকারে হচ্ছে সকল উৎসব ও অনুষ্ঠানের আয়োজন। তাই ছোট্ট বন্ধুরা, এবারের শীতে অবশ্যই তোমরাও বিশেষ সতর্ক থাকবে মা-বাবার কথার অবাধ্য হবে না। স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলবে।

SHARE

Leave a Reply