কিশোরকণ্ঠ জাতীয় গল্প লেখা প্রতিযোগিতা ২০২০-এর
খ-গ্রুপে প্রথম স্থান অধিকারী গল্প
– তোর নাম জিলাপি কেন রে?
জিজ্ঞেস করে মঞ্জু মিয়া। এই প্রথম গ্রামে একটা ব্যাংকের শাখা খুলেছে। দোতালা বিল্ডিং। ওখানকার দারোয়ান মঞ্জু মিয়া। সপ্তাহখানেক হলো গ্রামে এসেছে। জিলাপির টঙ দোকানে চা খেতে খেতে জিজ্ঞেস করে,
– জিলাপি কি কারো নাম হয়?
জিলাপি চুপচাপ চা বানাতে থাকে। মনে হয় যেনো শুনতে পায়নি বা কিছু একটা চিন্তা করছে। একটু পর বলে,
– অইবো না ক্যান! রাখলেই তো নাম অয়। আপনের নাম মঞ্জু ক্যান?
– তা ঠিক। কিন্তু জিলাপি তো জিলাপির নাম। ওই জন্য বললাম। কিছু মনে করিস না।
মঞ্জু আর কথা বাড়ায় না। জিলাপির অনেক কাজ। কথা বলার সময় খুব একটা পায় না। ছোট্ট একটা শরীরে এই টঙ দোকানটা চালায়। নিজেই ভাড়া নিয়েছে। প্রতিদিন বিশ টাকা করে। দোকান বন্ধ থাকলে ওই দিন ভাড়া দিতে হয় না। মালিক ভালো।
জিলাপির বাবা-মা কে ও জানে না। ওর খালি মনে আছে চেয়ারম্যানের কথা। সে ওর আপন কেউ হয় না। কিন্তু লোকটা ওকে বিস্কুট, বনরুটি দিতো। চেয়ারম্যান মূলত ওর বন্ধু। সে একটা পাগল লোক। মানুষ তার নাম রেখে দিলো চেয়ারম্যান। পুরো গ্রামের লোকজন তাকে চেয়ারম্যান নামেই চেনে। এই পাগলটাই জিলাপিকে বাঁচিয়ে রেখেছে ছোটবেলায়। ওর আর কিছু মনে পড়ে না।
জিলাপি যখন একটু বড় হয়, এদিক সেদিক যাওয়া শিখে, তখন ও চেয়ারম্যানের সাথে একবার বাইরে যায়। সারাদিন ময়লা ঘেঁটে আর মানুষের কাছে চেয়ে ওরা কিছু খাবার পায়। ফেরার সময় রাস্তায় একদল ছেলেপেলে চেয়ারম্যানকে বলে,
– চেয়ারম্যান, জেব্বা বো কাইট্টালামু।
জিলাপি বোঝে না। চেয়ারম্যান খুব রেগে যায়। সে ওই ছেলেদের গালি দিতে থাকে। পুলিশের কাছে বিচার দেবে বলে। এসব দেখে জিলাপির খুব মন খারাপ হয়।
চেয়ারম্যান যে আসলে একটা পাগল মানুষ এটা ও জানতে পারে আরেকটু বড় হওয়ার পর। তার মাথায় একটু সমস্যা। সে স্বাভাবিক মানুষ না। কিন্তু জিলাপি জানে তার মনটা খুব ভালো। মাঝে মাঝে ওর মনে হয়, খারাপ মানুষ হওয়ার চেয়েও বড় মনের পাগল হওয়া অনেক ভালো। এই যে চেয়ারম্যান আসলে পাগল, অথচ কতো ভালো। লোকমুখে ও আরও শুনেছে, চেয়ারম্যান তার বউকে অনেক ভালোবাসে। তার বউও মানসিক সমস্যাগ্রস্ত। সে ভিক্ষা করে। দিনশেষে ফিরে আসে ভাঙা ছাউনির নিচে। বাজারের পাশে একটা পরিত্যক্ত ছাউনির নিচে ওরা থাকে। বর্ষায় আর শীতকালে। বছরের বাকি সময়টা যেখানে সেখানে কেটে যায়।
জিলাপিও ওদের সাথে থাকে। কিন্তু চেয়ারম্যানের বউয়ের সাথে ওর তেমন একটা সম্পর্ক নেই। তার কিছুই মনে থাকে না। সে শুধু চেয়ারম্যানকে চেনে। জিলাপিকে মনে রাখতে পারে না। ওরও এসব নিয়ে মাথা ব্যথা নেই। তবে একবার একটা ঘটনা ঘটে। জিলাপি চেয়ারম্যানকে জিজ্ঞেস করে,
– জেব্বা বউ কাইট্টালামু মানে কী?
এরপর এক সপ্তাহ চেয়ারম্যান ওর সাথে কথা বলেনি। এক সপ্তাহ পর সে ভুলে যায়। সবকিছু আবার আগের মতো হয়ে যায়। পরে ও অন্যদের কাছ থেকে জানতে পারে ঘটনাটা। চেয়ারম্যানের বউয়ের নাম জেবা। পাগল বলে সমাজে তাদের কোনো দাম নেই। অনেকে ময়লা ছুড়ে দেয় তাদের গায়ে। কেউ কেউ গরম পানিও মেরে দেয়। এসব নিয়ে চেয়ারম্যান ভাবে না। কিন্তু জেবাকে নিয়ে কেউ কিছু বললে সে কষ্ট পায়। তার সাধ্যমত প্রতিবাদ করে। লোকজনও দেখে যে- বউকে নিয়ে বললে তামাশা জমানো যায়। তাই, সবাই এটাই বেশি বেশি বলতে থাকে। আস্তে আস্তে গ্রামের বাচ্চারাও খেলাটা শিখে ফেলে। জিলাপির মনে হয়, এই সমাজটা কেমন যেনো। অন্যকে কষ্ট দিয়ে মানুষ আনন্দ করে। ওর কাছে বিষয়টা খুব নিষ্ঠুর লাগে।
গ্রামের লোকজন আবার জিলাপিকে খুব ভালোবাসে। ও সবার উপকার করে। বয়স্কদের বাজারের ব্যাগ এগিয়ে দেয়, কারো কারো সদাই বাড়িতে পৌঁছে দেয়। সবার দু-এক টাকা করে দেওয়া বকশিশ জমিয়ে জমিয়ে ও চা বানানোর রসদ কেনে। একটা টঙ দোকান দেয়। গ্রামের স্কুল আর বাজারের মাঝখানে একটা মোড়। এখানেই ওর ছোট্ট দোকান। স্কুলের বাচ্চারাও আসে, বাজারে যাওয়ার পথে বড়রাও আসে। চা-বিস্কিট খেতে এসে জিলাপির খোঁজটা নিয়ে যায়।
ঈদের সময় এলে জিলাপির খুব কষ্ট হয়। ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা নতুন নতুন জামা পরে। এদিক সেদিক ঘুরে বেড়ায়। সুন্দর সুন্দর খেলনা কেনে। জিলাপির ওসবে লোভ নেই। কিন্তু ও যদি চেয়ারম্যানকে একটা নতুন জামা কিনে দিতে পারতো, ওর খুব ভালো লাগতো। তা ছাড়া ঈদের দিন চেয়ারম্যানকে ঈদগাহের সামনে চাদর পেতে বসিয়ে দেয় প্রভাবশালী কয়েকজন মিলে। অনেক টাকা পায় চেয়ারম্যান। জিলাপির মনে হয়, দশ হাজার টাকা হবে। কিন্তু ওই টাকা লোকগুলো নিয়ে যায়। চেয়ারম্যানকে একটা একশো টাকার লুঙ্গি কিনে দেয় বিনিময়ে। তাদের কেন ভিক্ষার টাকা নিতে হবে জিলাপি বুঝতে পারে না। এখন একটা ব্যাংক হলো গ্রামে। এর মধ্যে জিলাপি জেনে নিয়েছে ব্যাংকে কী কী হয়। ও সিদ্ধান্ত নিয়েছে একটা ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খুলবে। কিছু টাকা জমলে ওই টাকা দিয়ে চেয়ারম্যান আর তার বউকে তাদের জীবনের সেরা সারপ্রাইজটা দেবে। মঞ্জু মিয়া ওকে অ্যাকাউন্ট খুলতে সহযোগিতা করবে বলেছে।
দিন যায়। জিলাপির অ্যাকাউন্ট খোলা হয় না। ওর জন্মনিবন্ধন কার্ড নেই। চেয়ারম্যানেরও নেই কোনো জাতীয় পরিচয়পত্র। জিলাপি ভাবে, পরিচয়পত্র দিয়া কী অইবো। আমি কি আর ইসকুলে যামু!
একটা অ্যাকাউন্ট খুললে কতো ভালো হতে পারতো। কিন্তু যার নাম জিলাপি, যার বাবা-মায়ের কোনো নাম নেই, তার পরিচয় হবে কিভাবে। জিলাপি আর এগোয় না। তবে পরিচয়ের একটা মৃদু শোক চিনচিন করে ওর বুক বেয়ে ওঠে। ও অনেক বড় নিঃশ্বাস ফেলে বলে, হায়রে পৃথিবী!
জিলাপি চা বানাচ্ছে। সাইকেল চালিয়ে বাজারের দিকে যাওয়ার সময় একটা লোক জিলাপিকে ডাকে। বলে,
– ওই ব্যাটা, তুই চা বেচিস, সরকারি মোড়ের সামনে দেখলাম চেয়ারম্যানরে খুব মারতেসে লোকজন।
জিলাপি তাড়াহুড়ো করে দোকান গুটিয়ে চলে যায়। সরকারি মোড়ে গিয়ে দেখে চেয়ারম্যান অসাড় হয়ে পড়ে আছে। জিলাপি এগিয়ে যায়। জিজ্ঞেস করে কী হয়েছে? চেয়ারম্যানকে গ্রামের এক প্রভাবশালী লোক বাজারে দেখে। ওই লোক কিছু মাছ তার বাড়িতে পৌঁছে দেওয়ার জন্য চেয়ারম্যানকে দেয়। সঙ্গে দশ টাকা বকশিশ দেয়। সে মাছগুলো পৌঁছে দিতেই যাচ্ছিলো। কিন্তু গ্রামের কিছু যুবক ছেলে তার পথরোধ করে। মাছ এবং বকশিশ কেড়ে নিয়ে গিয়ে বলে এগুলো নাকি সে চুরি করে এনেছে। জিলাপি আর কিছু না বলে একটা রিক্সা ডেকে তাকে স্থানীয় ক্লিনিকে নিয়ে যায়।
খালপাড়ে জিলাপি বসে আছে। ওর খুব মন খারাপ। ওর মনে হয় এই পৃথিবীটা আসলে সবার জন্য না। মানুষে মানুষে কতো বৈষম্য। অথচ পাখিরা কতো সুন্দর। এক সাথে চলে। পশুপাখির মধ্যে যেনো কোনো ধনী-গরিব ভেদাভেদ নেই। ওরা যেনো চিরসুখী। খালপাড়ে মৃদু বাতাস বইতে থাকে। শরতের সাদা মেঘের আকাশে একঝাঁক চড়ুই জিলাপির মাথার ওপর দিয়ে কিচিরমিচির করতে করতে উড়ে যায়। হঠাৎ ওর খুব পাখি হতে ইচ্ছে করে।
বছর ঘুরে গিয়ে আবার ঈদের সময় হয়েছে। জিলাপির ব্যবসা আগের চেয়ে ভালো চলে। এখন ও চা-বিস্কুটের সাথে ইফতার বিক্রি করে। সারাদিন তো বিক্রি বন্ধ। বিকেলে ছোলা ভাজা, মুড়ি, আলুর চপ ইত্যাদি নিয়ে বসে। তবে ওর দোকানে সবচেয়ে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে জিলাপি। জিলাপির জিলাপি সবাই আহ্লাদ করে কেনে। অনেকে বলে রোজা শেষ হয়ে গেলেও যেনো জিলাপি রাখে ও।
ঈদের পাঁচ দিন আগে ও চেয়ারম্যান আর জেবার জন্য ভালো দেখে জামা-কাপড় কেনে। রাতে ফিরে গিয়ে যখন ওদের হাতে দেয়, জেবা খুব খুশি হয়। জেবার খুশি দেখে চেয়ারম্যানের চোখ ছলছল করে। দুজনে ছোট্ট জিলাপিকে বুকে জড়িয়ে রাখে অনেকক্ষণ। জিলাপির চোখ থেকে গড়িয়ে একফোঁটা পানি পড়ে।
ঈদের আগের রাত। চারিদিকে একটা উৎসব বয়ে যাচ্ছে। ছোট ছোট বাচ্চারা খেলছে। ঈদ মোবারক বলে বলে চিৎকার করছে। জিলাপির আজ আর দোকান করতে ইচ্ছে করছে না। ও দোকান বন্ধ করে দেয়। এমন সময় কেউ একজন পেছন থেকে ওর হাত ধরে।
– আরে, মঞ্জু চাচা। কিসু লাগবো নাকি?
– আমার সাথে চল। একটু কাজ আছে।
– কই যাইবেন? কী কাজ?
– পরে কথা বলিস। এখন চল।
ওরা হাঁটতে হাঁটতে বাজারের ভেতরে যায়। একটা বড় দোকান হয়েছে এবার। নাম ঈদ মার্কেট। জিলাপি মার্কেট অর্থ জানে না। ও ভেবেছিলো মার্কেট হয় শুধু শহরে। মঞ্জু মিয়া জিলাপিকে নিয়ে ঈদ মার্কেটে ঢুকে।
জিলাপির জীবনে এরচেয়ে বড় সারপ্রাইজ কখনোই ছিলো না। ও খুব অবাক হয়। উচ্ছ্বাসে ওর কথা জড়িয়ে যায়। কত দিন ইচ্ছে হয়েছে, একটা প্যান্ট আর একটা শার্ট কেনার। কিন্তু ওই সুন্দর জামা-কাপড় তো শুধু বড়লোকের ছেলেমেয়েরা পরে। জিলাপি কখনও ভাবেনি ও কখনো এমন দামি আর সুন্দর জামা পরতে পারবে। অথচ আজ অল্প বেতনের চাকরি করা একজন অভাবগ্রস্ত চাচা কিনে দিলেন। তাও একদম বেশি দামেরটা! আনন্দে ও মঞ্জু মিয়াকে জড়িয়ে ধরে।
এক দৌড়ে ও পুকুরপাড়ে যায়। চিৎকার করে বলে ঈদ মুবারক। পুকুরের ছোট ছোট পুঁটিমাছগুলো লাফিয়ে ওঠে। জিলাপি আবার বলে, ঈদ মুবারক। আবার মাছেরা লাফিয়ে ওঠে। ও আবারও বলে। বারবার বলে। বলতেই থাকে। আর মনের খুব গভীরে, কিছুটা অস্পষ্ট কিন্তু ভীষণ তীব্র একটা ইচ্ছে উঁকি দেয়। মঞ্জু মিয়ার মতো কেউ যদি একদিন হাত ধরে নিয়ে স্কুলে দিয়ে আসতো!